‘গগণে গরজে মেঘ ঘন বরষা। কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা…’ কাটিতে কাটিতে ধান এলো বরষার মতোই ফিরে আসে ১১ ডিসেম্বর। দিনটি ভাই সাংবাদিক মঞ্জুরুল হকের চীর বিদায়ের দিন। আজো সে অনেকের মনে গভীর মমতার বাঁধনে জড়িয়ে আছে। ভক্ত শিশ্যদের কাছে আজো তিনি গুরু, মামা। ডিসেম্বর স্বজন হারানোর কষ্ট আর বিজয়ের আনন্দে মাখা নানা স্মৃতির মাস। অনেকেই ডুবে যান এই মাসের নানা স্মৃতির সাগরে। ছোট বেলায় ধবধবে ফরসা টোপা টোপা গোলাপী গাল, কুচকুচে কালো কোঁকড়ানো মাথা ভরা চুলের শান্ত ছেলে ছিলেন মঞ্জুর। শুরুতে যেমন ছিলেন, তার শেষটা ছিলো অন্যরকম। আব্বা জহির উদ্দিন বিশ্বাস ছিলেন ওপার বাংলার নাম করা রাজনীতিবিদ, আইনবিদ। তিনি ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রথমসারির নেতা। অখণ্ড ভারতে তখন চলছিলো ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন।
আমি আর মঞ্জুর তখন অনেক ছোট। তেমন কিছুই না বুঝলেও ওকে সারাদিন মুখস্থ করাতাম ‘ব্রিটিশ ভারত ছাড়ো, লাড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’। ও ছোট কাঠিতে চাঁদ তারা আঁকা সবুজ পতাকা নিয়ে বাড়ির উঠানে মিছিল করে বলতেন ‘বিতিস ভারত ছাড়’। একবার বড়দের মিছিলে গিয়ে হাঁটতে না পেরে কাঁদতে থাকলে বড় একজন কোলে নিয়ে বলেন, আমাদের লিডারের ছেলে। আদিবাসীদের মাটির পাহাড়ে কী আছে দেখতে গিয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় দুইজনে মিলে কাঁদার সময় পরিচিত একজন বাড়িতে পৌঁছে দিলেন। ছোটবেলায় ওর খুব ইচ্ছা ছিলো অনেক দূরে গিয়ে নতুন কিছু দেখার, শেখার। বৈশাখ মাসে ভাগিরথি নদীতে পানি থাকত না। বড় ভাই (ভাষা সৈনিক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলী) এর সঙ্গে প্রতিদিন বিকালে ‘আমাদের ছোট নদী…’ কবিতা শুনতাম আর বেড়াতাম। ও পানি ভয় করত। জোর করে ওকে পানিতে হাটিয়ে ভয় ভাঙিয়েছিলাম। শ্মশানের আগুন দেখে ভূত মনে করে দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গিয়ে বাড়ি ফিরে মার কাছে বকা খেয়েছিলাম। তবুও পাহাড়ে কী আছে, নদীর ওপারে কী আছে জানার আগ্রহ শেষ হয়নি। কিন্তু সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি। সার্কাস দেখে এসে ও সঙ্গীদের নিয়ে সার্কাসের মতো খেলা করার সময় বড় ভাই (দাদা) সহযোগিতা করতেন। দুজনে পুকুরে গোসল করার সময় পানির মধ্যে কী আছে আমি তা দেখার চেষ্টা করলেও ও চোখ খুলতোনা। গামছা দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করতাম। চার-পাঁচটা চিংড়ি ছাড়া কিছুই পেতাম না। শাপলা পাতায় মাছগুলো যত্ন করে বাড়িতে আনতাম। আমরা কখনো কেউ কাউকে ছাড়তাম না। কপালে ছিলো টিপ বুক ভরা ভালোবাসা, আর চোখ ভরা পানি। পুতুলের বিয়েতে পুতুলের পোশাক নিয়ে মারামারি করলে মায়ের মার খেয়ে দুজনে কাঁদতাম। আব্বা মাকে বলতেন ওরা ছোট, থাক না। রাগ করে দুজনে লেবু গাছের নিচে দিদি (বড় বোন) ও মায়ের আয়া সুখি মায়ের জন্য অপেক্ষা করতাম। মঞ্জুর ছিলো খুবি পাতলা। দাদু তাই আদর করে ওকে ডাকতেন তাল পাতার সিপাই। ফুটবল, ব্যাডমিন্টন কখনোই খেলতে না পারলেও প্রচুর উৎসাহ ছিলো।
অখণ্ড ভারত ভেঙে গেলো। আব্বা গ্রেফতার হলে অনেক কাঁদলাম। মঞ্জুর খুবই ভয় পেয়েছিলো। আব্বা সসম্মানের সঙ্গে মুক্তি পেলে আমরা পুর্ব পাকিস্তানের রাজশাহীতে চলে আসি। প্রখ্যাত চলচিত্রকার হৃতিক ঘটকের শ্বশুর বাড়ির পরিবার আর আমরা এক পরিবার হয়ে গেলাম। বেশ কিছুদিন পর আমরা চলে এলাম সোনাদীঘির পারে। মঞ্জুরের হাত ধরে জানালায় দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখার সময় প্রতিদিন এক বুড়ো পানি নিয়ে জাবার সময় হেসে আমাকে বলত খুকি ভাইটাকে দাও, মিষ্টি দেবো। ধমক দিয়ে বলতাম তুমি যাও ভাইকে দেবো না। আব্বা কচুরি ও রসগোল্লা খাইয়েছেন। একদিন মঞ্জুর হঠাৎ করে মাকে বলে মা বিতিশ কই? ব্রিটিশ চলে গেছে শুনে ও বলে মা এটা আমাদের দেশ? ওকে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করা হয়। একদিন মাকে বলে স্কুলে মিলাদ হবে স্যারেরা ছোট ভাইদের নিয়ে যেতে বলেছেন। আমার ভাই নেই শুনে উনারা বোনকে নিয়ে যেতে বলেছেন। বোন টুকুকে সবুজ সিল্কের শেরওয়ানি, মাথায় জিন্নাহ টুপি পায়ে লাল নাগ্রায় পরিয়ে মিলাদে নিয়ে গেলে বন্ধুরা তাকে অনেক আদর করেন। মিলাদ শেষে দুজনে খুশি হয়ে মিলাদের সিন্নি বাড়িতে নিয়ে আসে। পৃথিবীতে ছোট ভাই বাবু আসার পর অসুস্থ হয়ে পড়লে বড়দের সঙ্গে ও সারা রাত জেগে ছিলো। খিটখিটে হলেও মনটা ছিলো স্নেহময়ী ও সাহসী। অল্প পড়াতেই তার পড়া মুখস্থ হয়ে যেতো। কিন্তু সে ছিল প্রচণ্ড অস্থির স্বভাবের। পয়সা পেলেই বন্ধু রাজ্জাক, অদুদ ও আমাকে নিয়ে দৌড়ে ফারুক লাইব্রেরিতে গিয়ে গল্পের বই কিনত। ‘অজানার উজানে’ বইটা পড়ে ওর ইচ্ছে হয় বড় হয়ে আমাদের নিয়ে অজানার উজানে গিয়ে অনেক কিছু দেখবে। কিছুটা বড় হলে স্কুল জীবনেই সাংবাদিকতার সঙ্গে হয়ে যায়। তখনো ক্লাস এইটের ছাত্র। একদিন অনেক রাতে ডিসি সাহেবের গাড়ি তাকে বাড়ি পৌঁছে দিলে ও গল্প শুনাতে থাকে ওকে নিয়ে চিন্তায় বড় ভাই (দাদা) সারা রাত ঘুমাতে পারেননি। আব্বার ইচ্ছা ছিলো ও ডাক্তার হবে। বড় ভাইয়ের ইচ্ছা ছিলো ও আইনবিদ হবে। কিন্তু ও হয়ে গেলো সাংবাদিক। নিজের কথা ভাবত না। সবসময় অন্যের উপকার করতো। মায়ের বকা খেয়ে বলত ‘সোনাদীঘির এপারে মা আর ওপারে আমি…’ একসময় প্রেসক্লাব হয়ে গেলো তার সব কিছু। বড় বড় নেতা, বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিলো। বিজয়ের পর সাংবাদিক আহম্মেদ সফিউদ্দিন ও অন্যান্যদের সঙ্গে বদ্ধভুমি শহিদ ও শহিদ পরিবারের কথাগুলো তার লেখনীতে তুলে ধরে। বঙ্গবন্ধু তাকে চিনতেন ও জানতেন ও তিনি বঙ্গবন্ধুকে ‘বড়ভাই’ সম্বোধন করতেন। তার সহযোগিতায় গড়ে উঠতে থাকে সাংবাদিক। অনেকে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকেন। অনেকে চলে যান দেশের বাইরে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ভাষাসৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধের সংঘটক সাংবাদিক লেখক ওমর ২১ নিয়ে সেই ওমর গানের রচয়িতা আব্দুল গাফফার চৌধুরী প্রতিবাদ হিসেবে কলকাতা থেকে ‘সোনার বাংলা’ প্রকাশ করেন। সেটি বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মরহুম ওস্তাদ হারুন অর রসিদ খানের মাধ্যমে তার কাছে আসতে থাকলেও সেগুলো রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ‘রাজশাহী বার্তা’ অফিসে সংরক্ষণ করতো। সেখান থেকে সেগুলো ওস্তাদ হারুন অর রসিদ খান (পরে বিএনপিতে যোগদান) ও রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব সাবেক ছাত্রলীগ নেতা চৌধুরী খুরশিদ বিন আলম বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের কাছে পৌঁছে দিতেন। মঞ্জুর ‘আজাদী’, উর্দু সংবাদ পত্র ‘জং’ , ‘দৈনিক পাকিস্তান’, ‘দৈনিক বাংলা’, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শহিদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান হেনার ‘দৈনিক জনপদ’, ‘দৈনিক দেশ’ এ কাজ করেছে। রাজশাহী প্রেসক্লাবে সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ছিলো। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে একটি রাজনৈতিক দলের জ্ঞানহীন ক্যাডার নামধারীরা সরকারি সংস্থার সংবাদকে কেন্দ্র করে রাজশাহীর প্রেসক্লাবে হামলা করলে ও এবং সাইদুর রহমান আক্রান্ত হয়। প্রশাসন, বিভিন রাজনৈতিক দলের নেতাসহ অনেকে ব্যবস্থা নেবার কথা বললেও তারা কিছুই করেননি। এর প্রতিবাদে প্রেসক্লাব বন্ধ থাকে। মঞ্জুর অসুস্থ হয়ে পড়ে। সাবেক ভুমি মন্ত্রী, সাবেক মেয়র দুঃখ প্রকাশ করে অনেক কিছু বলেন। কিন্তু মঞ্জুর আর বেশি অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকেন। ১১ ডিসেম্বর তরী বেয়ে কে যেনো এসে সকলের অজান্তে তাকে নিয়ে চলে গেলো। সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও অন্যান্যরা তাকে রেখে এলেন তরু ছায়া ঘ্রেরা ক্ষেত্রে।
লেখক: বাংলাদেশ বেতার রাজশাহীর সাবেক স্টাফ আর্টিস্ট
শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।