এইএসসি ও সমমানের বাকী পরীক্ষাগুলো না দিয়ে পরীক্ষার্থীদের এক অংশ (পাচ থেকে ছয়শত শিক্ষার্থী) গত ২০ আগস্ট সচিবালয়ে প্রবেশ করেন। তার আগের দিন তারা ঢাকা শিক্ষাবোর্ড ঘেরাও করেন। সচিবালয়ে ঢুকে বিক্ষোভ শুরু করে তারা সচিবালয়ের প্রবেশপথ আটকে দেন। এতে জরুরী বৈঠকে বসেন শিক্ষা উপদেষ্টা। তারা প্রথমে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে প্রকাশ করা সুচি স্থগিত করে আরো দুই সপ্তাহ পরে স্থগিত পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আর পরীক্ষার সময় ঠিক রেখে বাকি বিষয়গুলোর পরীক্ষা অর্ধেক প্রশ্নোত্তরে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন । কিন্তু পরীক্ষা বাতিলের আন্দোলনে অংশগ্রহনকারী শিক্ষার্থীরা তা না মেনে বিক্ষোভ করতে থাকেন। পরে আন্দোলনের এক পর্যায়ে এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করা হয় এবং শিক্ষার্থীদের প্রস্তাব অনুযায়ী অটোপাসের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
আমরা জানি, ২০২৪ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয় গত ৩০ জুন। কিন্তু সে সময় সিলেট বিভাগে বন্য থাকায় ৮ জুলাই পর্যন্ত ওই বোর্ডের পাশাপাশি মাদরাসা ও কারিগরি বোর্ডের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। ওই তিন বোর্ডের পরীক্ষা শুরু হয় ৯ জুল্ইা। তারা যে চারটি আবশ্যিক পত্রের পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি তা সব পরীক্ষা শেষে নেয়ার কথা ছিল। ফলে বাকি আটটি সাধারন শিক্ষাবোর্ডে অর্ধেকের বেশি পরীক্ষা নেয়া হলেও ওই তিন বোর্ডের শিক্ষার্থীরা তিন থেকে চারটি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে পেরেছে। কোটা আন্দোলনের কারণে ১৮ জুলাই, তারপর ২১,২৩ ও ২৫ জুলাইয়ের পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়। এরপর ২৮ জুলাই থেকে ১ আগস্ট পর্যন্ত পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। পরে ১১ আগস্ট থেকে নতুন সময়সূচিতে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত ছিল, সেটিও স্থগিত করে ১১ সেপ্টেম্বর পরীক্ষা নেয়ার সূচিও প্রকাশ করা হয়েছিল। সবকিছু শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বাতিল করা হলো।
এদিকে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তকে ’ অযৌক্তিক’ বলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। তিনি বলেন, ’ যারা এইচ এস সি বা সমমানের পরীক্ষা বাতিলে চেয়েছেন তারা মেধার মূল্যায়ন করেন না। পরীক্ষা নেয়া উচিত ছিল। এই সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক।’ নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থীাও বলেছেন যে, তারা এই সিদ্ধান্ত মানেন না। পরীক্ষা নিতে হবে। পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলনের আহবায়ক রাখাল রাহা বলেন, ‘ সারা দেশে প্রায় ১৪লাখ পরীক্ষার্থী আছে। এমন একটি সিদ্ধান্তের আগে সরকারের পক্ষ থেকে একটি জরিপ পচিলানা করা উচিত ছিল। আহত শিক্ষার্থীদের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ন। সরকার চাইলে জেলা প্রশাসন এবং শিক্ষা বোর্ডগুলোর মাধ্যমে তাদের তথ্য সংগ্রহ করে তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারত। কিন্তু এভাবে পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তটি যৌক্তিক হয়নি। এতে শিক্ষার্থীদের পরবর্তী শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে বিরূপ পরিস্থিতি হলেও সমাধান হিসেবে আবারো অটোপাসের দাবি আসার সম্ভাবনা।’ আমরাও এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারছিনা, কারন এত অল্প স্বার্থের কারনে শিক্ষার্থীদের বিরাট অর্জনে কালিমা পড়ুক এটি আমরা চাইনা।
পরীক্ষা বাতিল করার বিষয়কে কখনোই সমর্থন করেন না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যএকজন সমন্বযক হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘ এইচ এসসি পরীক্ষার্থীরা সচিবালয়ে শিক্ষাসচিব মহোদয় থেকে শুরু করে আমাদের সবাইকে অবরুদ্ধ করে। সেজন্য সচিব মহোদয় শিক্ষা উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করে পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেন। পরীক্ষা ছাড়া একজন শিক্ষার্থীকে কখনোই মূল্যায়ন করার সুযোগ নেই। পরীক্ষাই হচেছ মেধা মূল্যায়নের একমাত্র মাধ্যম। এই যে পরীক্ষা ছাড়া মুল্যায়নের মধ্য দিয়ে যারা প্রকৃত মেধাবী, যারা সারা বছর ধরে পড়াশুনা করেছেন, তাদেরকে মূলত অনুৎসাহিত করা হলো। সুতরাং আমরা চাইব কার কখনোই যেন এ ধরনের ডিসিশনের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।’ আমরাও সারজিস আলমের সাথে একমত পোষণ করছি। এই অটোপাসে প্রকৃত মেধাবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং তাদেরকে অবমূল্যায়ন করা হলো।
এ ধরনের সিদ্ধান্তের জেরে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত শিক্ষা ও কর্মজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। নতুন রুটিন প্রকাশের পর থেকেই শিক্ষার্থীদের একাংশ প্রতিবাদ শুরু করেন। তাদের বক্তব্য ছিল, আন্দোলনে আহত অনেক শিক্ষার্থী এখনো চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন এবং অনেকে মানসিকভাবে এর ধাক্কা এখেেনা কাটিয়ে উ্ঠতে পারেননি। এটি আমরা অবশ্যই মানি এবং তাদরেকে শ্রদ্ধা করি, তাদের জন্য আমাদের সমবেদনা আছে এবং তাদের ক্ষেত্রে ভিন্ন একটি ব্যবস্থা রাখা দরকার ছিল। সহপাঠীদের রেখে তারা বাকি পরীক্ষা দিতে চাননা এবং বিকল্প পদ্ধতিতে ফলাফল চান। এই বিকল্প পদ্ধতিতে ফলাফল আশা করা এক ধরনের খারাপ কালচার । পরিশেষে বলতে চাই, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, আত্মত্যাগ ও বিশাল অর্জনকে আমরা সাধুবাদ জানাই, স্যালুট করি তাদের অবদানকে কিন্তু সামান্য লাভের আশায় বা সামান্য স্বার্থে সেটি কোনোভাবে যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, ম্লান হয়ে না যায় সেটি জাতিকে যেমন দেখতে হবে, তেমনি শিক্ষার্থীদের বিষয়টিতে বেশি গুরুত্ব প্রদান করা উচিত চিল।
লেখক: মাছুম বিল্লাহ, ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক