অতঃপর স্বাধীনতা এবং আমরা - দৈনিকশিক্ষা

অতঃপর স্বাধীনতা এবং আমরা

বুলবুল আহমেদ |

অতঃপর স্বাধীনতা! ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চের পর থেকে রাজশাহীর লক্ষীপুর এলাকার বড় ভাইরা বাসায় নষ্ট হয়ে যাওয়া বাল্ব এনে দিতে বলতেন। আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেই নষ্ট হয়ে যাওয়া বাল্ব জোগাড় করে দিতাম। সেই বাল্ব দিয়ে বোমা বানানো হতো। সেই বোমা কতোটা শক্তিশালী হতো তা জানা ছিল না। তবে, সেই বোমার ওপরে রাখা আস্থাই এনে দিয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। আমি তখন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের সপ্তম শ্রেনীর ছাত্র।  

৭ এপ্রিল দুপুরে ৩০ থেকে ৪০ জন ইপিআর আমাদের কোয়ার্টারের দিকে আসলেন। বাবাকে বললেন, এই এলাকা এখন মুক্ত। পাকিস্তানের আর্মি এখন উপশহরে। আমরা ক্ষুধার্ত, আমাদের জন্য চাল, ডালের ব্যবস্থা করেন। মা তখন ধামায় কিছু চাল, ডাল, আলু ও আরও অনুষাঙ্গিক কিছু জিনিস দিলেন। তারা নিজেরাই রান্না করলেন। আর খাওয়া শেষে অনেকগুলো বাংকার তৈরি করলেন। মাঝে মাঝে মা ইপিআরদের জন্য খাবার পাঠাতেন। আমরা গাছের কলা, তরমুজ এগুলো নিয়ে বাংকারে দিয়ে আসতাম।

ইপিআর পুলিশ ও সাধারণ জনতার সমন্বয়ে গঠিত প্রতিরোধ বাহিনী শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন নগরবাড়ী ঘাটেও। রাজশাহীতে অবস্থানরত পাকিস্তানী আর্মিদের উপশহরে ঘেরাও করে রাখার পাশাপাশি তারা নগরবাড়ী ঘাট হয়ে উত্তরবঙ্গে পাকিস্তানীদের ঢোকা প্রতিহত করছিলেন। কিন্তু এক পর্যায়ে বিমান হামলা করে ফেরি পার হয়ে নগরবাড়ী আসে পাকিস্তানীবাহিনী। তাদের প্রতিহত করতে পথে গাছ কেটে বেরিকেড দেয় প্রতিরোধ বাহিনী। কিন্তু পাকবাহিনী তা সরিয়ে দুই দিনেই রাজশাহী পৌঁছায়।

এদিকে রাজাশাহী শহরের পাকিস্তান আর্মিদের প্রতিরোধবাহিনী ক্যানটনমেন্টে আটকে রাখে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত। ১৪ এপ্রিল ইপিআররা যাবার সময় হাসপাতালের সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলেন। অনেকে আগেই হাসপাতালের কর্মকর্তা কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমার বাবা আব্দুল বারি হাওলাদার কয়েকজন কর্মচারীকে অনুরোধ করেন হাসপাতালে থাকার জন্য। কারণ ৬০-৭০ জন রোগী তখনও হাসপাতালে ভর্তি ছিল। বাবার কথা ছিল, সবাই চলে গেলে হাসপাতালের রোগীরা না খেয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। তিনি এও বলেছিলেন, হাসপাতাল কম্পাউন্ডে রেডক্রসের পতাকা ওড়ানো, তাই আমাদের কেউ আক্রমণ করবে না। 

এদিকে আমাদের সরকারি কোয়াটার্রটি রেললাইনের একদম পাশে ছিল। কিছুটা নিরাপদ থাকাতে আমাদের পরিবার হাসপাতালের খালি থাকা নার্সেস হোস্টেলে এসে উঠি। কিন্তু সে আশাকে মিথ্যে প্রমাণ করে ১৪ এপ্রিল দুপুরে পাকিস্তানের আর্মি আসে টিবি হাসপাতাল কম্পাউন্ডে। প্রথমে তারা এসে চলে গেলেও তার একটু পর আবারও ফিরে এসে লাথি দিয়ে দরজা ভেঙে ফেলে নার্সেস হোস্টেলের দরজা। নামাজরত অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনী আমার বাবা, হাসপাতালের আরও দুইজন স্টাফ আব্দুল কাইউম ও হাবিবুর রহমানকে সবার সামনেই গুলি করে। পাশের ঘরে আমার বড় ভাই মাহমুদ হোসেন বাদল, মোহাম্মদ সেলিম ও আবুল ফজলকেও গুলি করে। আমরা তখন দিশেহারা। কি করবো? হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স নেই। রক্তাক্ত পুরো ঘর। বাড়িতে ডেটল তুলা গজ যা-ই ছিল তা দিয়ে রক্তে বন্ধ করতে চেষ্টা করি। আমাদের হাতের ওপর কাইউম, সেলিম মারা যায়। বাবা সন্ধ্যায় মারা যান। আমরা যখন বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত তখন বড় ভাই মাহমুদ হোসেন বাদল গুলিবিদ্ধ অবস্থায় খোড়াতে খোঁড়াতে অন্ধকারে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের চেষ্টা করেন। কিন্তু তখন কোনো ভাবেই সম্ভব ছিল না হাসপাতালে বাদল ভাইয়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। এদিকে হাবিব ও ফজল খোঁড়াতে খোঁড়াতে মেডিকেলে যান।

আমরা তখন তিনটি লাশ নিয়ে কি করবো কুল কিনারা পাচ্ছি না। বাইরে ঝড়-বৃষ্টি। শরীর রক্তে ভেজা। মা আমাদের নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে রক্ত মাখা এক কাপড়ে আম বাগানের ভিতর দিয়ে পালানো শুরু করলেন। সারারাত হেঁটে একটি গ্রামে পৌঁছাই। পরে হাসপাতালের পরিচিত কয়েকজন আমাদের নিয়ে যান তাদের গ্রাম মাঙ্গোনপুরে। এক চেয়ারম্যানের বাড়িতে আমাদের আশ্রয় হয়। তখন রেডিওতে মাঝেমাঝেই ঘোষণা আসতে থাকে। যারা সরকারি চাকরি করেন তাদের ২১ এপ্রিল থেকে  কর্মস্থলে যোগদান করার জন্য ঘোষণা দেয়া হয়। একুশে এপ্রিল আমরা তিন ভাই সরকারি কর্মচারীদের সাথে রাজশাহীতে ফিরে আসি। কারণ, আমরা সবাই এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। আমাদের কাপড় এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনার দরকার ছিল। যে তিনটি লাশ রেখে এসেছিলাম তাদের কি অবস্থা সেটাও জানা দরকার ছিল। গিয়ে দেখি লাশ তিনটি ফুলে পঁচে গন্ধ ছড়াচ্ছে। অনেক দূরে থেকেই গন্ধ পাচ্ছিলাম। বাড়িতে গিয়ে দেখি পুরো বাড়ি লুট হয়ে গেছে। কিছুই নেই। খাবারের থালা বাসন পর্যন্ত নেই। ভাত খাওয়ার থালা, পানির পাত্রটিও হানাদারদের নজর এড়ায়নি। লাশ দাফন করার জন্য কাফনের কাপড় খুঁজে পেলাম না কোথাও।

উপায় না পেয়ে টিবি হাসপাতাল কম্পাউন্ডেই একটি গর্ত খুড়ি। বাড়ির পুরনো ছেড়া চাদর, দরজা জানালার পর্দায় লাশগুলো মুড়িয়ে ভাঙা দরজা ওপরে একটা একটা করে বাইরে নিয়ে আসি। সে গর্তটিতেই আমরা তিনজনকে রাখলাম। তারপর আবার বেলা থাকতেই ফিরে গেলাম সেই মঙ্গোনপুর গ্রামে।

সেখানে আমরা মাস দুয়েক ছিলাম। তারপর ফিরে আসি নিজেদের কোয়ার্টারে। তখন আমাদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। বাবা নেই, টাকা নেই, খাবার নেই। আমরা খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছিলাম। ওইদিকে বড় ভাই হাসপাতালে থেকে একটু সুস্থ হয়ে আমাদের খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় খুঁজে বেড়াচ্ছেন। 

ভাইয়ের সন্ধান পাই অনেক পরে। তিনি তখন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। আমরা স্বাধীনতার পর ডিসেম্বরের শেষ দিকে ঢাকায় চলে আসি। তারপর থেকে প্রতিবছরই ১৪ এপ্রিলকে সামনে রেখে রাজশাহী টিবি হাসপাতালে বাবার কবর জিয়ারত করতে যেতাম। কবরটি বেড়া দিয়ে ঘেরাও করে আসতাম। আমরা আসার পর বেড়াগুলো কে বা কারা খুলে নিয়ে যেতো আমরা না জানলেও জানতো জাতির বিবেক।

যাই হোক ১৯৯৭ সালে আমি তখন ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার চিফ ফটো জার্নালিস্ট। আমার সম্পাদক আমাকে বললেন, একজনকে রাজশাহীতে অ্যাসাইনমেন্টে পাঠাতে। আমি ইচ্ছা করেই অ্যাসাইনমেন্টটি নিলাম। কারণ অফিসের খরচে বাবার কবরটা জিয়ারত করে আসতে পারবো। আমার সাথে আমার সহকর্মী টিটু দত্তগুপ্ত ছিলেন। আমি যখন টিবি হাসপাতালের বাবার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে জিয়ারত করছি আমার সহকর্মী টিটু দত্ত বারবার আমাকে বলছেন, কি করছেন এখানে দাঁড়িয়ে জঙ্গলের মধ্যে ! আমি ওকে বললাম, অনেক স্মৃতি আছে এই গাছের নিচে। তুমি আশেপাশে ঘোরো, আমি আসছি পরে।

আমরা টিবি হাসপাতালের তৎকালীণ পরিচালক সাহেবের সাথে তার কোয়ার্টারে গিয়ে দেখা করি। তখন হাসপাতাল ঠিকঠাক করার কাজ চলছে। আমরা পরিচালক সাহেবকে প্রশ্ন করলাম, এই হাসপাতলে মুক্তিযুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি কি হয়েছিল? কে কে মারা গিয়েছিল? কেউ আহত নিহত হয়েছিলেন কিনা? উনি বললেন এখানে মুক্তিযুদ্ধে কোন স্টাফ আহত বা নিহত হয়নি। হলে আমি জানতাম। কারণ এই হাসপাতলে আমি ৪ বছর ধরে কর্মরত আছি। আর এর ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ইন্টার্নি করতাম। এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।

আমি তাকে আবার প্রশ্ন করি আপনার হাসপাতালের একজন নাইটগার্ড আছেন সম্ভবত হাবিবুর রহমান নাম উনার দুই পা কাটা হুইলচেয়ারে ঘুরে বেড়ান। কিভাবে হাসপাতালে ডিউটি করেন? উনার সামনে পুরো হাসপাতাল চোর চুরি করে নিয়ে গেলেও তো  কিছু করতে পারবেন না?

ডিরেক্টর সাহেব উত্তর দিলেন সম্ভবত কোন দুর্ঘটনায় তার পা কাটা গিয়েছে, সরকারি চাকরি করে তাই হয়তো চাকরিটা যায় নাই। আমি আবারও প্রশ্ন করলাম আপনার এখানে আবুল ফজল নামে আরেকজন লোক চাকরি করেন যার দুটো পা নেই, হুইলচেয়ারে চলাচল করেন। উনি বললেন হ্যাঁ আমাদের হেড বাবুর্চি, এলপিআরয়ে যাবেন কিছুদিনের মধ্যেই। আমি বলি এত বড় পাতিল এর মধ্যে রোগীদের জন্য রান্না কিভাবে করেন তিনি? উনার পা কিভাবে কাটা গেল? উনার উত্তর ছিল, সরকারি চাকরি পেতেও কষ্ট, যেতেও কষ্ট। যেকোনো দুর্ঘটনায় তাদের পা কাটা গিয়েছিল।

আমি আবার প্রশ্ন করি এখানে ডাক্তার  আব্দুল বারী হওলাদার নামে একজন লোক চাকরি করতেন, ঐ কোয়ার্টারে থাকতেন; আপনি কি চিনতেন তাকে? উনি বললেন হ্যা উনিতো ঢাকাইয়া, আমি তাকে খুব ভালো করে চিনতাম। আমি জিজ্ঞাসা করলাম উনি এখন কোথায়? তিনি উত্তরে বললেন উনি তো এতদিনে রিটায়ার্ড করেছেন। আমি বললাম হ্যা রিটায়ার্ড করেছেন। পরিচালক সাহেব আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কি তাকে চেনেন? তাকে আমি বললাম হ্যাঁ ভালো করে চিনি। জিজ্ঞাসা করলেন উনি  কোথায় আছেন? আমি বললাম ওই যে সামনে দেখছেন আমগাছটি ওই গাছের নিচে। 

অবাক হয়ে পরিচালক সাহেব বললেন, ‘মানে!?’ আমি বললাম ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল বুধবার। পাক হানাদার বাহিনী সেইদিন এখানে ৬ জনকে গুলি করে। তিনজন মারা যান। যে তিনজন বেঁচে আছেন সেই তিনজনের দুইজন হলেন ফজল এবং হাবিব। আরেকজন বারী সাহেবের ছেলে বাদল। আর বারী সাহেব কাইয়ুম এবং সেলিম তিনজনকে সাতদিন পরে একটি গর্ত করে একসাথে দাফন করা হয়। উনি শুনে খুব আশ্চর্য হলেন এবং বললেন আমি এখানে চার বছর ধরে কর্মরত আছি কেউই আমাকে কথাগুলো বলেনি। আপনারা সাংবাদিক তাই অনেক তথ্য আপনাদের কাছে আছে। 

আমি বললাম, আমি শুধু সাংবাদিকই না সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। পুরো ঘটনা আমার চোখের সামনেই ঘটেছিল। কারণ আমি বারী সাহেবের ছেলে। উনি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে স্নেহের সঙ্গে বললেন তুমি বারী সাহেবের ছেলে এই পরিচয় তো আমার কাছে সবচেয়ে বড়। শুধু সাংবাদিক না, আরও বড় কিছু হলেও তুমি আমাদের সন্তান। আমি বললাম, কাকু একটু আগে যখন বাবার কবর জিয়ারত করছিলাম, আমার সহকর্মী টিটু দত্ত গুপ্ত জানতো না যে এখানে আমি একটি কবর জিয়ারত করছি। আমাকে বারবার এখান থেকে চলে আসার জন্য বলছিলো। আপনি যদি আমাকে অনুমতি দেন আমি এই কবরটি ঘেরাও করে যেতে চাই। একটু ঘেরাও করেও দিতে চাই যাতে লোকজন না বুঝে তিনজন শহীদকে অসম্মান না করে। 

এখানে তিনজন শহীদ শুয়ে আছেন।  তাদের একটু সম্মান দিতে চাই। উনি বললেন চলো আমাকে দেখাও। আমি গিয়ে তাকে পুরো জায়গাটা দেখালাম। উনি আমাকে বললেন, আগামীকাল সকাল ১১ টার দিকে হাসপাতালে যেয়ে তার সাথে দেখা করতে। আমি আর টিটু পরের দিন সকালে তারসাথে দেখা করতে হাসপাতলে যাওয়ার পথেই দেখি কবরের চারধারে একহাত পরিমাণ দেওয়াল গাঁথা হয়ে গেছে। আমি পরিচালক সাহেবের সঙ্গে দেখা করতেই উনি আমাকে বললেন তোমার কথাগুলো শুনে আমি সব কর্মচারী কর্মকর্তাদেরকে ডেকে কথা বলি। তারা সবাই বললেন, হ্যাঁ ঘটনা সত্য।

তুমি যে কবরটি পাকা করতে চাও সে বিষয়টিও আমি তাদের বলেছি। কিন্তু তারা বললেন, আমরাই এই কবরটি ঘেরাও করে দেবো যত টাকা লাগে। যে কনট্রাকটর সাহেব পুরো হাসপাতালে রেনোভেশন করছিলেন উনি বললেন, কয়টা ইট বালি সিমেন্ট লাগবে আমরাই এটা করে দেব আপনাদের কাউকে কিছু করতে হবে না। পরবর্তীতে কবরটি ঘেরাও হয়ে গেল। আমাকে শুধু বললেন, তুমি ঢাকা থেকে তিন জন শহীদের নামের একটি পাথরের ফলক তৈরি করে নিয়ে আসবে। সেই কথামতো আমি ঢাকা থেকে একটি নামফলক লিখে রাখি এবং বড় ভাই বাদলকে সব ঘটনা খুলে বলি। কারণ মা প্রতিবছরই বাবার কবর জিয়ারত করতে আসতে চাইতেন। কিন্তু এই জঙ্গলের মধ্যে তিনজন শহীদ শুয়ে আছে সেটি মাকে দেখালে মা কষ্ট পাবেন। তাই মাকে আনা হয়নি। তখনই বড় ভাই বললেন, চল জুলাই মাসে আমরা সব ভাইবোন ভাতিজা ভাতিজী ভাগিনা ভাগনি একসাথে বাবার কবর জিয়ারত করতে যাই।

কবরের জন্য তিন জন শহীদের নামের পাথরের ফলকটি নিয়ে আমি তিন দিন আগে চলে যাই রাজশাহীতে। ফলকটিতে লেখা ছিল, ‘১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল বুধবার মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে শাহাদাত বরণকারী দেশমাতৃকার জন্য চরম উৎসর্গের সাক্ষ্য হয়ে পরম নিশ্চিন্তে এখানে ঘুমিয়ে আছেন শহীদ আব্দুল বারী হাওলাদার, শহীদ আব্দুল কাইয়ুম, শহীদ মোহাম্মদ সেলিম। তাদের প্রতি সালাম ও শ্রদ্ধার্ঘ্য।’ 

অতঃপর ধর্মীয় আচার। একটি গরু চারটি খাসি এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কেনা। উদ্দেশ্য ছিল ওখানে গরীব এবং বাবার সহকর্মীদের সাথে বসে এক বেলা খাব। ওখানকার হাসপাতালে রান্নাঘরে যত কর্মচারী ছিল তারা বলল আমরা নিজেরাই স্যারের রান্না করে খাওয়াবো। এজন্য ডেকোরেটরের দরকার নেই। আপনি শুধু টাকা দিন আমরাই বাজার করে যা যা লাগে সব করে রাখবো। কথামতো সব ঠিকঠাক করে রাখলো তারা। ঢাকা থেকে পুরো একটি বাস ভর্তি করে আমাদের পুরো পরিবার রাজশাহীতে আসলেন। সেদিন কোরান খতম পড়ানো হল, মিলাদ পড়ানো হলো। স্মৃতিচারণমূলক কথা বলেলেন বাবার সহকর্মীরা। তারা শোনালেন  কি হয়েছিল সেই দিন, তাদের সহকর্মী হিসেবে কেমন লোক ছিলেন এই তিনজন, তারা বর্ণনা করলন পাক হানাদার বাহিনী কি ধরনের নির্যাতন করেছে সাধারণ মানুষের ওপর। আমার সন্তান তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ে। সে জানালো তার দাদার মৃত্যু কিভাবে হয়েছে। পাক হানাদার বাহিনী কিভাবে নির্যাতন করে তাকে হত্যা করেছে।

কিছুদিন পর আমার পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের আমন্ত্রণে পাকিস্তানে ১০ দিনের একটি ভ্রমণ করতে যাওয়ার কথা। তা শুনে আমার মেয়ে আমাদের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম চৌধুরীকে ফোন করে বলে, কাকু ৭১ সালে আমার দাদাকে এই পাকিস্তানিরা গুলি করে হত্যা করেছে, বাবাকে পাকিস্তানে পাঠাবো না। তার পরিবর্তে অন্য কাউকে পাঠাও। একথাটি আমি জানতে পেরেছি অনেক পরে। কারণ তখন ট্যুর ছিল ভারত নেপাল পাকিস্তান থাইল্যান্ড। আমার চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম চৌধুরী আমাকে পাকিস্তান না পাঠিয়ে থাইল্যান্ডের পাঠান। থাইল্যান্ড এ গিয়ে আমাকে বলেন তোমার যাওয়ার কথা ছিল পাকিস্তানে, তুমি কেন থাইল্যান্ডের আসলে- জানো? আমি বললাম না। উনি বললেন, তোমার মেয়ে তন্বী আমাকে ফোনে বলল, তোমার বাবাকে পাকিস্তানিরা গুলি করে হত্যা করেছে যেটা আমি জানতাম না। ওর অনুরোধে আমি তোমাকে পাকিস্তান না পাঠিয়ে থাইল্যান্ড এ পাঠালাম।

যাই হোক আমার বাড়িতে আমার সন্তানরা পাকিস্তানের কোন ফল, ফুল, কাপড় বা গিফট ঘরে ঢুকতে দেয় না। পাকিস্তানের কোন গান বা টিভি চ্যানেল দেখতে দেয় না। আমার সন্তানরা পাকিস্তানকে ঘৃণা করে, তাই আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। 

লেখক : বুলবুল আহমেদ, ফটো এডিটর, দৈনিক আমাদের বার্তা

 

পুলিশ ভেরিফিকেশনে রাজনৈতিক পরিচয় না দেখার সুপারিশ - dainik shiksha পুলিশ ভেরিফিকেশনে রাজনৈতিক পরিচয় না দেখার সুপারিশ সড়ক-রেলপথ ছাড়লেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha সড়ক-রেলপথ ছাড়লেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা ফেসবুকে সতর্কবার্তা দিলেন সারজিস আলম - dainik shiksha ফেসবুকে সতর্কবার্তা দিলেন সারজিস আলম আওয়ামী আমলে শত কোটি টাকা লুট শিক্ষা প্রকৌশলের চট্টগ্রাম দপ্তরে - dainik shiksha আওয়ামী আমলে শত কোটি টাকা লুট শিক্ষা প্রকৌশলের চট্টগ্রাম দপ্তরে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে কমিটি গঠন করা হয়েছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে কমিটি গঠন করা হয়েছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির তালিকা - dainik shiksha শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির তালিকা ছাত্ররা রাজনৈতিক দল ঘোষণা করবে কি না জনগণ নির্ধারণ করবে - dainik shiksha ছাত্ররা রাজনৈতিক দল ঘোষণা করবে কি না জনগণ নির্ধারণ করবে কুয়েটে ভর্তি আবেদন শুরু ৪ ডিসেম্বর, পরীক্ষা ১১ জানুয়ারি - dainik shiksha কুয়েটে ভর্তি আবেদন শুরু ৪ ডিসেম্বর, পরীক্ষা ১১ জানুয়ারি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033919811248779