রাশিয়ায় জন্মগ্রহণকারী প্রখ্যাত মার্কিন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখক ও জৈব রসায়নের অধ্যাপক আইজাক আসিমভের আজ মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি মূলত বিজ্ঞান কল্পকাহিনী এবং জনপ্রিয় বিজ্ঞান বিষয়ক রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন এবং এক্ষেত্রে তার সাফল্য গগনচুম্বী। যোগ্যতা বিবেচনায় তাকে বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর গ্র্যান্ড মাস্টার আখ্যায় ভূষিত করা হয়েছে।
আসিমভ ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ২ জানুয়ারি আরএসএফএসআর (রাশিয়ান সোভিয়েত ফেডারেটেড সোশালিস্ট রিপাবলিক)-এর স্মলেন্স্ক ওব্লাস্ট অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত পেত্রোভিচি রাজ্যে জন্মগ্র্রহণ করেন। বর্তমানে এই রাজ্যটি বেলারুশ প্রজাতন্ত্রের Mahilyow প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত। আসিমভের বাবা জুডাহ আসিমভ এবং মা আন্না রাচেল বের্মান আসিমভ। ইহুদি এই পরিবার তৎকালীন রাশিয়ার ক্ষুদ্র কারখানা মালিক শ্রেণির অন্তর্গত ছিলো। তার জন্ম তারিখ নিশ্চিত করে বলা যায়না গ্রেগরীয় এবং হিব্রু বর্ষপঞ্জির পার্থক্য এবং সুষ্ঠু রেকর্ড সংরক্ষণের অভাবে। আসিমভ নিজে তার জন্মদিন সবসময় জানুয়ারি ২ পালন করতেন। তার পারিবারিক ও বংশীয় উপাধিটি এসেছে রাশিয়ান ভাষার শব্দ (ওজিমিয়ে) থেকে। এটি এক ধরনের শীতকালীন শস্য যা তার দাদা চাষ করতেন। অবশ্য এই শব্দটির সঙ্গে পিতৃপুরুষ সূত্রে প্রাপ্ত অণুসর্গ যুক্ত হয়ে তবেই আসিমভ শব্দটি উৎপন্ন হয়েছে। তার তিন বছর বয়সে তাদের পরিবার রাশিয়া থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হিসেবে চলে যায় এবং নিউ ইয়র্ক সিটির ব্রুকলিনে বসতি স্থাপন করে। পরিবারের ভিতরে সবাই ইদিশ এবং ইংরেজি ভাষায় কথা বলতো। এ কারণে আসিমভ কখনই রাশিয়ান ভাষা শিখেননি। তিনি ইদিশ এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই সমান পারদর্শী ছিলেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে নিজে থেকে গল্প লিখতে শুরু করেছিলেন এবং ১৯ বছর বয়সে সেগুলো বিজ্ঞান কল্পকাহিনী পত্রিকার কাছে বিক্রি করতে শুরু করেন। এস্টাউন্ডিং সাইন্স ফিকশন পত্রিকার সম্পাদক জন ডব্লিউ ক্যাম্পবেল তার জীবনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন এবং পরবর্তিতে তার বিশ্বস্ত বন্ধুও হয়ে যান।
আসিমভের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ রচনা হচ্ছে ফাউন্ডেশন সিরিজ। তার অন্যান্য প্রধান সিরিজের মধ্যে রয়েছে গ্যালাক্টিক সাম্রাজ্য সিরিজ এবং রোবট সিরিজ যে দুটিকে পরবর্তিতে তিনি ফাউন্ডেশন সিরিজের অন্তর্ভুক্ত করেছেন ভবিষ্যৎ ইতিহাস বিনির্মাণের জন্য। ভবিষ্যৎ ইতিহাস নির্মাণের এই প্রক্রিয়ার অগ্রদূত ছিলেন কর্ডওয়েইনার স্মিথ এবং পাউল এন্ডারসন। তার অসংখ্য ছোটগল্পের মধ্যে নাইটফল গল্পটি ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে সাইন্স ফিকশন রাইটার্স অব আমেরিকা কর্তৃক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান কল্পকাহিনী শীর্ষক ছোটগল্পের সম্মানে ভূষিত হয়। তিনি পল ফ্রেঞ্চ ছদ্মনামে ছোটদের জন্য লিখতেন। আসিমভের অধিকাংশ বিজ্ঞান গ্রন্থ এবং গল্পেই বৈজ্ঞানিক ধারণাসমূহ ইতিহাসের আবহে বর্ণীত হয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি হয়ত সুদূর ভবিষ্যতের কোন সময় থেকে শুরু করেছেন আর ফিরে গেছেন তখন পর্যন্ত যখন কিনা সেই ধারণাটি ছিলোইনা বা থাকলেও ছিলো একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে; যখন মানব সভ্যতা ছিলো একেবারে সরল। ৫০২০ আসিমভ নামক গ্রহাণু, আসিমভ্স সাইন্স ফিকশন নামক সাময়িকী এবং আইজাক আসিমভ পুরস্কার নামে একাধিক পুরস্কারের মাধ্যমে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে।
১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে আইজাক আসিমভ আসিমভ নিউ ইয়র্ক সিটির সরকারি স্কুলগুলোতে প্রাথমিক অধ্যয়ন শুরু করেন যার মধ্যে ছিলো ব্রুকলিনের বয়েজ হাই স্কুল। পরে যান কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখান থেকে ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এখান থেকেই ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
ডক্টরেট সম্পন্ন করার পর আসিমভ বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিনে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। অনেকদিন এখানেই কর্মরত ছিলেন। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তার শিক্ষকতার ঝোঁক কমে আসে এবং পূর্ণোদ্যমে লেখালেখি শুরু করেন। লেখালেখির মাধ্যমে শিক্ষকতার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ পেতেন। শিক্ষকতার সময়েই তিনি সহযোগী অধ্যাপক পদ পান এবং ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয় তার লেখার প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাকে জৈব রসায়নের পূর্ণ অধ্যাপক পদ প্রদান করে। ১৯৬৫ থেকে পরবর্তী সময়ে আসিমভের ব্যক্তিগত রচনা ও পত্রাদি মুগার মেমোরিয়াল লাইব্রেরির সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে। কিউরেটর হাওয়ার্ড গটলিয়েবের অনুরোধে তিনি এই গ্রন্থাগারে কিছু অনুদান দিয়েছিলেন। সেখানে তার রচনাগুলো মোট ৪৬৪টি বাক্স দখল করে আছে এবং তাকটির মোট দৈর্ঘ্য ৭১ মিটার।
আসিমভের ক্লসট্রোফিলিয়া ছিল, অর্থাৎ ছোট আবদ্ধ স্থানে থাকতে ভালবাসতেন। তার আত্মজীবনী গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে উল্লেখ করেছেন, তিনি ছোটবেলায় এমন একটি ম্যাগাজিন স্ট্যান্ডের মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন যা নিউ ইয়র্ক সিটি সাবওয়ে স্টেশনে অবস্থিত এবং যেখানে তিনি নিজেকে আবদ্ধ রেখে চলমান ট্রেনের শব্দ শুনতে পাবেন। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আইজাক আসিমভ মৃত্যুবরণ করেন।