অন্তর্বর্তী সরকার ঢাকায় বসে আছে উল্লেখ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, সরকারকে মাঠে যেতে দেখলাম না। মাঠে যাওয়া দরকার।
সোমবার (১১ নভেম্বর) রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে দৈনিক বণিক বার্তা আয়োজিত ‘তৃতীয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলন ২০২৪’-শীর্ষক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, দৃশ্যমান দুর্নীতি কমেছে, তবে কাজের গতি কমে গেছে। হয়রানি দুর্নীতির চেয়ে ভয়াবহ। উপদেশ দিয়ে ঠিক করা যাবে না। সেটা কার্যকর করে দেখাতে হবে।
তিনি বলেন, বৈষম্য বহুমাত্রিক। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ একটি অধ্যায়ের মধ্যদিয়ে গেছে। যেখানে শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনীতি থেকেও প্রতিযোগিতা হারিয়ে গেছে। তিনি বলেন, চারটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। সেগুলো হলো-সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য, বিনিয়োগবান্ধব, সামপ্রতিক আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসহ সবার কর্মসংস্থান ও মুদ্রাস্ফীতি কমানো। বর্তমান সরকার সেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, বিনিয়োগকারীদের কথা শোনাটা খুব জরুরি। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ওটাকে গুরুত্ব দেয়নি। উনাদের শোনার আগ্রহ দেখা যায়নি। শোনার মাধ্যমেই তো উদ্যোক্তারা তথা ব্যবসায়ীরা আগ্রহ দেখাবে। কারণ তারাই তো বিনিয়োগ করবে। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ঢাকায় বসে আছে, ঘরে বসে আছে। মাঠে যেতে দেখলাম না। মাঠে তাদের পদচারণা কেন নাই? মাঠে যাওয়া খুব দরকার। সদিচ্ছার ঘাটতি নিয়ে বলছি না, কিন্তু কার্যক্রম নিয়ে বলছি।
তিনি আরো বলেন, দৈনন্দিন জীবনে বাজার নিয়ন্ত্রণের জায়গায় মনিটরিং কমে গেছে। মনিটরিং মানে সাজা দেয়া নয়। মনিটরিং মানে আগাম তথ্য ও ব্যবস্থা নেয়া, সমস্যা চিহ্নিত করা। সেটা দেখা যায় না।
অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ছাত্র-জনতার দেয়া দায়িত্ব আমরা যথাসম্ভব পালন করার চেষ্টা করছি। আমাদের কোনো ব্যক্তিগত এজেন্ডা নেই। আমাদের এজেন্ডা হচ্ছে দেশের স্বার্থ। যা করা হচ্ছে তা দেশের স্বার্থেই করা হচ্ছে। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আমরা কাজগুলোকে ৩টি ধাপে ভাগ করেছি। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কাজ। আমরা হয়তো মধ্যমেয়াদি কাজ শুরু করতে পারবো। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কাজগুলো পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার যারা আসবেন তারা করবেন। তবে আমরা কিছু কিছু দীর্ঘমেয়াদি কাজও করার চেষ্টা করবো।
গরিব মানুষজন সুযোগের বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, গ্রামের অনেক মানুষই জানেন না সরকারি সুযোগগুলো কোথায় পাওয়া যাবে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রেও বৈষম্য হচ্ছে। গরিব মানুষকে শুধুমাত্র ভিটামিন এ ক্যাপসুল আর কলেরার টিকা দিলেই হয় না। তারও মরণব্যাধি হয়। কিন্তু তার জটিল রোগের চিকিৎসা কোথায় করাবে সেটি নির্দিষ্ট নয়। তাকে ঘটিবাটি বিক্রি করে ঢাকা আসতে হচ্ছে। আবার শিক্ষা খাতেও অনেক সময় তারা গুণগত শিক্ষা পান না।
উপদেষ্টা বলেন, যোগ্য পরিচালকের অভাবে বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়ে গেছে। কারণ, সেগুলো চালাতে সময়মতো ভালো লোক দেয়া হয়নি। আবার তারা প্রফেশনাল জায়গাগুলোতে নন প্রফেশনাল কন্সিডারেশনও হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের সিস্টেমগুলোও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অটোমেশন হয়নি। স্মার্ট বাংলাদেশ, ডিজিটাল বলা হলেও বাস্তবে এতটা নয়। সেজন্য এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
বাণিজ্য এবং বস্ত্র ও পাট উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন বলেন, ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা নিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে যে লিভারগুলো ব্যবহার করা হয়েছে চাহিদা ও জোগানের মাঝে তা প্রশংসার যোগ্য। আমার ধারণা মূল্যস্ফীতির ব্যাপারটাতেও আমাদের একই ধরনের লিভার ব্যবহার করতে হবে। এ লিভারগুলো চিহ্নিত করতে হবে। হোসেন জিল্লুর রহমান যেভাবে দেশ জুড়ে ঘুরে ঘুরে মানুষের সঙ্গে সংযোগ রাখতে বললেন, সেভাবে মানুষের সঙ্গে মিশে লিভারগুলোকে চিহ্নিত করে সক্রিয় করতে হবে যেন বাজারে জোগান সংক্রান্ত যে মূল্যস্ফীতি রয়েছে তা মোকাবিলা করা সম্ভব হয়।
তিনি বলেন, আমদানি দিয়ে হোক বা স্থানীয় উৎপাদন বা বাজারের সময়কাল ইত্যাদি আরও যা যা নিয়ামক আছে এ নিয়ামকগুলোকে যদি আমরা সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারি ইনশাআল্লাহ আমরা একটি পরিবর্তন দেখতে পাবো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমরা শ্রীলঙ্কা হয়ে যাইনি। আমাদের গ্রোথ (অগ্রগতি) কমেনি। যেকোনো পলিসি ইমপ্লিমেন্ট (প্রয়োগ) করলেও মূল্যস্ফীতি এক বছরের আগে কোনো দেশেই কমে না। মাত্র ৪ মাস সময় পার করছি। আমাকে আরও ৮ মাস সময় দিতে হবে। আমরা শুধু মুদ্রানীতির উপর নির্ভর করছি না। সব প্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি খোলা রয়েছে। প্রয়োজন অনুসারে, শুল্ক শিথিল করা হয়েছে।
ব্যাংক নিয়ে তিনি বলেন, বিগত সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আমাদের ব্যাংক খাত। এখন যদি দ্রুত সংস্কার বা সমাধান চাওয়া হয় আমার চাকরি ছেড়ে দিতে হবে। কারণ, এক ব্যাংকের ২৭ হাজার কোটি টাকার অ্যাসেট এক পরিবারের হাতে ছিল। তারা ২৩ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। আমার হাতে ম্যাজিক নেই। তবে আমি বলতে পারি, কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না। কারণ তাদের তারল্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে। অর্থ পাচার নিয়ে তিনি বলেন, দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে দেশ থেকে কয়েক লাখ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। এটা ফিরে পাওয়া কঠিন। তবে আমাদের জাল ফেলা হয়েছে। এখন গোটানো বাকি। এরইমধ্যে আমরা দেশ ও দেশের বাইরেও যোগাযোগ করেছি। আমাদের সহযোগিতার জন্য চলতি সপ্তাহে আমেরিকার প্রতিনিধি আসছে, যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধি আসবে, বিশ্বব্যাংক আসবে এবং সিঙ্গাপুরের সঙ্গেও কথা হবে। আমরা চাই না কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা শিল্প বন্ধ হয়ে যাক। কারণ, সেখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। আবার কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হিসাবও জব্দ করা হয়নি, হবেও না।
গভর্নর বলেন, গত ৩ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে কোনো নগদ সহায়তা দেয়া হয়নি। কারণ ম্যাক্রো ইকোনমি স্ট্যাবল রাখতে হবে। এটা স্ট্যাবল না হলে কোনো বিনিয়োগ হবে না। এজন্য ব্যবসায়ীদের ধৈর্য ধরতে হবে। আমাদের উদ্দেশ্য যারা ব্যাংকের টাকা মেরেছে তারা ব্যাংকের সঙ্গে থেকে টাকা ফেরত দেয়। বাইরে যে টাকা চলে গেছে সেসব কীভাবে আইনগত প্রক্রিয়ায় ফেরত আনা যায় সেই চেষ্টা চলছে। তিনি আরও বলেন, ফরেন এক্সচেঞ্জ শর্টেজ এখন নেই। আমি মনে করি, সাপ্লাই সাইডে যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ব্যাংক রেজুলেশন অ্যাক্ট নিয়ে আসতে চাইছি। ব্যাংকিং খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যে বিনিয়োগ হওয়া উচিত, তা না হওয়ায় বর্তমানে বাংলাদেশের আউট অফ পকেট এক্সপেন্ডিচার আফগানিস্তানের চেয়েও বেশি। এই বিপুল পরিমাণ টাকা মেগা প্রকল্পে বিনিয়োগ হচ্ছে, যা দেশের জন্য ক্ষতিকর।
আমীর খসরু আরো বলেন, অর্থনীতি ডেমোক্রেটাইজেশন করতে হবে। না হলে সাধারণ মানুষকে মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রয়ক্ষমতার ঘাটতির মধ্যে পড়তে হবে। তিনি বলেন, সরকারের বাজেটের রিসোর্স অ্যালোকেশন ভুল হচ্ছে এবং ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পেতে হলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্ব দিতে হবে। এ সময় রাজনৈতিক জবাবদিহিতার অভাবও তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা থাকতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে বিনিয়োগ করতে চান। কারণ তারা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য এক ধরনের স্থিতিশীল পরিবেশ আশা করেন।
এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি এবং বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, দেশে বেসরকারি খাতে সংকোচিত মুদ্রানীতি নেয়া হয়, কিন্তু সরকারি খাতে খরচের সময় সমপ্রসারিত নীতি চলেছে। এ বৈষম্যের কারণে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, এ সংকোচিত মুদ্রানীতি বেসরকারি খাতকে গলা টিপে ধরছে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না।
বিএনপি’র এ ভাইস চেয়ারম্যান আরো বলেন, আমাদের সমাজে অনেক বৈষম্য। যা কমাতে সম্পদ সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু যারা বা যে ব্যবসায়ীরা দেশের সম্পদ সৃষ্টি করে, সেটা বিলি বণ্টনের ক্ষমতা তাদের নেই। আবার এক শ্রেণি এটা বিলি বণ্টন করছেন, তারা আবার সেটা লুণ্ঠন করছে। সম্পদ সৃষ্টিকারী ও লুণ্ঠনকারী দু’টি দল হয়েছে। আবার যারা লুণ্ঠন করে তারা সব সময় ব্যবসায়ীদের দোষারোপ করে যায়। এটা ঠিক নয়। এগুলো ঠিক করতে আমাদের সামাজিক মূলধন দরকার। আইনের সঠিক প্রয়োগ দরকার। এ সমাজে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। একে অপরকে শত্রু মনে করে। এ দেশে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা অর্থনীতি নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের বিরোধী মনে করে। আবার অর্থনীতির লোকগুলোও সেটা করে। কিন্তু দেশের অর্থনীতি ভালো করতে হলে ভালো রাজনীতির বিকল্প নেই। সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক সরকার ছাড়া কোনোভাবে ভালো অর্থনীতি সম্ভব না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান ও আইআরডি সচিব মো. আবদুর রহমান খান বলেন, পলিসি তৈরিতে এনবিআর জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। এ কারণে গত তিন মাসে নিত্যপণ্যের কর ও শুল্কে অনেক ছাড় দেয়া হয়েছে। কোনো পলিসির কারণে এনবিআরের স্বার্থ (রাজস্ব সংগ্রহ) ক্ষুণ্ন হলেও রাষ্ট্রীয় স্বার্থকেই আমরা প্রাধান্য দেই। তবে দেশের মানুষের মধ্যে এখনো মিথ্যা হলফনামা তৈরির প্রবণতা রয়েছে। এটি দূর করতে হবে। এটি অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।