ছায়াঘেরা পাখিডাকা শান্ত স্নিগ্ধ নিভৃত পল্লীর শ্যামল কোলে একটি শিশুর জন্ম হলো। সময়টি ছিলো ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ। পরাধীন ভারতবর্ষ। চারিদিকে স্বদেশি আন্দোলনের ডামাডোল। এই সময় শিশুটির জন্ম নেয়াটা যেনো ছিলো অনিবার্য। পিতা-মাতা আদর করে খোকা নামে ডাকতেন। আর পাঁচটা সাধারণ শিশুর মতো বেড়ে উঠলেও বিশেষ কিছু গুণের জন্য তিনি অসাধারণ হয়ে উঠলেন। নজর কাড়লেন অন্যদের। সমবয়সীদের মধ্যে তিনি নেতা। গরিব ও সাধারণ মানুষের প্রতি দরদ, তাদের দান করা, কারো বিপদে-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়া, খেলাধূলায় পারদর্শিতা ইত্যাদি ব্যতিক্রমী গুণের জন্যই তিনি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, হয়ে উঠেছিলেন দশজনের একজন।
বাল্যকাল থেকেই ছিলেন অকুতোভয়। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অদম্য সাহসীকতার পরিচয় রেখে গেছেন। নেতৃত্বের গুণাবলীর মধ্যে রয়েছে- সাহসিকতা, সহনশীলতা, প্রত্যুৎপন্নমতিতা, দূরদর্শিতা, সহানুভূতিশীল, কোমলতা, কঠোরতা, সততা, সত্যবাদিতা, স্নেহশীলতা, স্পষ্টবাদিতা, আত্মবিশ্বাস, যোগাযোগ দক্ষতা, সংবেদনশীলতা, ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা, ঝুঁকি গ্রহণের দক্ষতা, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, উদারতা, সময়নিষ্ঠা, কষ্টসহিষ্ণুতা, দৃঢ়চেতা ইত্যাদি। এই সবগুলো গুণই তার মধ্যে বর্তমান ছিলো। নেতৃত্বের সহজাত গুণাবলি নিয়েই তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাইতো তিনি টুঙ্গিপাড়ার খোকা থেকে বিশ্বনেতায় পরিণত হয়েছিলেন। আমাকে বেশি আকর্ষণ করে তার সাহসিকতার দিকটি। খুব ছোট বেলাতেই অন্যান্য গুণের মধ্যে এই গুণটি তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রকাশ পেয়েছে।
একটি ঘটনা। তখন তিনি গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। স্কুল পরিদর্শনে এলেন বাংলার বাঘ, তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক আর অবিভক্ত ভারতবর্ষের জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্কুলের একটি ভবনের ছাদ ছিলো জরাজীর্ণ। বর্ষাকালে পানি পড়তো। যেকোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো। বালক শেখ মুজিবুর রহমান স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ স্থানীয় নেতাদের অনুরোধ করে রেখেছিলেন তারা যেনো ছাদ সংস্কারের দাবিটি উত্থাপন করেন। কিন্তু কেউ এই ন্যায্য দাবিটি উত্থাপন করার সাহস পেলেন না। বালক বঙ্গবন্ধু তখন কয়েকজন সহপাঠী ও বন্ধুদের নিয়ে ওই সব বাঘা বাঘা নেতাদের পথ আটকালেন। এই সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষকেরা এবং স্থানীয় নেতারা ভয়ে তটস্থ হয়ে বালকদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু জাতীয় নেতারা বালকদের কথা শুনতে চাইলেন। বালক নেতা শেখ মুজিব দাবিটি পেশ করলেন এবং তা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি আদায় করলেন।
মানবকল্যাণ আর বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে খোকা বড় হতে থাকেন। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন, পরিণত হলেন ছাত্র নেতায়, সকলের প্রিয় মুজিব ভাই। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা, আটচল্লিশ থেকে বায়ান্ন ভাষা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়া, ছেষট্টিতে ছয় দফা প্রবর্তন এবং ততোদিনে বলিষ্ঠ নেতৃত্বের গুণে অবিসংবাদিত জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিলেন।
৭ মার্চ ১৯৭১। আমরা আবারো পেলাম তার প্রজ্ঞা ও সাহসীকতার পরিচয়। চারিদিকে উদ্যত স্টেনগান, কামান, মাথার ওপর সামরিক হেলিকপ্টারের মহড়া। নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে দৃপ্ত কণ্ঠে লাখো মুক্তিপাগল জনতাকে স্বাধীনতার ডাক দিলেন। দিলেন দিক নির্দেশনা, কোন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে।
এরপর এলো ভয়াল ২৫ মার্চ কালরাত্রি। বর্বর পাকিস্তানিরা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু করলো। সবাই ঢাকা ছাড়ছে। বঙ্গবন্ধু অবিচল। তিনি নেতাদেরকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা দিলেন। পাকিস্তানিরা তার বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। সবাই বঙ্গবন্ধুকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। বঙ্গবন্ধু কারো কথায় কর্ণপাত করলেন না। তিনি হিমালয়ের মতো অবিচল। পাকিস্তানিরা তাকে অতর্কিতে আক্রমণ করে হত্যা করতে পারতো। নিজ জীবন সংশয়ের কথা তিনি ভাবলেন না। তিনি ভাবলেন নিরস্ত্র বাঙালিদের কথা। তাদের অরক্ষিত রেখে তিনি পালাতে পারেন না। নিজ জীবনকে তুচ্ছ করে স্বেচ্ছায় গ্রেফতার হলেন। কতো বড় বুকের পাটা!
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের পাঞ্জাব রাজ্যের মিয়ানওয়ালি কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। সামরিক ট্রাইব্যুনালে প্রহসনের বিচারে তার মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হলো। জেলখানায় তার সেলের সম্মুখে তাকে দেখিয়ে কবর খোঁড়া হলো। বঙ্গবন্ধু বিচলিত হলেন না। তিনি পরাজয় মানলেন না। শুধু বললেন, মৃত্যুর পর তোমরা আমার লাশটা আমার বাংলায় পৌঁছে দিও’। পূর্ব পাকিস্তানে তখন কী হচ্ছে তিনি কিছুই জানতেন না। তাই সহজেই তিনি আত্মসমর্পণ করে বিবৃতি দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে দেশের স্বাধীনতার জন্যে নিজ জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হলেন। এবারও তিনি অসীম সাহসের বিরল নজির স্থাপন করলেন।
সর্বশেষ ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট জীবনের অন্তিম লগ্নে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি সাহস হারালেন না। ওইদিন ভোরে নরঘাতকরা বঙ্গবন্ধু ভবন আক্রমণ করলো। নিচতলায় অনেকক্ষণ ধরে গোলাগুলি চললো। ঘাতকরা নিচ থেকে হত্যা করতে করতে দোতলার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। বঙ্গবন্ধু সময় পেয়েছিলেন, ইচ্ছা করলে পালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু নিজের পরিবার-পরিজন, কর্মচারী ও কাজের লোকদের বিপদের মুখে রেখে নিজে বাঁচতে চাননি। তিনি দোতলার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে সিংহের মতো গর্জন করে উঠলেন, ‘কী চাস তোরা’?
ঘাতকের উদ্যত স্টেনগানের সামনে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তিনি এতোটুকু সাহস হারাননি। নরপিশাচরা বুলেটের গুলিতে সেই বজ্রকণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দিলো।
লেখক: প্রভাষক, সরকারি ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা ডিগ্রি কলেজ, ফকিরহাট, বাগেরহাট