হাইকোর্টের আদেশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তকে অমান্য করে মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সি অ্যান্ড ডি কমিটির সদস্য ড. এ কে এম রেজাউল করিমকে ছাড়াই বিভাগীয় 'সি অ্যান্ড ডি' মিটিং করেছে একই বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোঃ কামাল উদ্দিন।
মিটিংয়ে একই বিভাগের আরো দুই সি অ্যান্ড ডি সদস্য অধ্যাপক ড. আয়েশা সুলতানা ও মিস আরিফা রহমান উপস্থিত হননি বলে জানা যায়। 'সি অ্যান্ড ডি' বা কোঅরডিনেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কমিটি মিটিং মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যা বিভাগের এক-তৃতীয়াংশ সিনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত।
এই অমান্য করাকে আদালত অবমাননসহ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের শামিল উল্লেখ করে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন জানিয়েছেন অধ্যাপক রেজাউল করিম। গতকাল রোববার (২৪ সেপ্টেম্বর) এ আবেদন জানান তিনি।
জানা যায়, গত বছর মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামাল উদ্দিন ‘স্টোরকিপার’ নিয়োগে দুর্নীতির করার অভিযোগ করে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান রেজাউল করিমসহ সাত শিক্ষক। এই অভিযোগের জেরে গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর একাডেমিক কমিটির সভায় সমঝোতার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় First Statutes of the University এর Article 45 (3) ও (4) হবে অমান্য করে একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় ওই অধ্যাপককে। পরে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হলে গত ৪ এপ্রিল অব্যাহতির সিদ্ধান্ত স্থগিত করে হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের রায়ের পাঁচ মাস অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি আদেশ অযৌক্তিকভাবে অব্যাহত রাখায় গত ২৩ আগস্ট জীবন আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯'শ শিক্ষককে মেইল করেন ওই অধ্যাপক। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে গত ৭ সেপ্টেম্বর একটি নিউজ প্রকাশিত হওয়ার পর গত ১০ সেপ্টেম্বর শিক্ষা কার্যক্রম থেকে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত স্থগিত করে বিভাগীয় সমস্ত কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অনুমোদন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
আবেদনপত্রে বলা হয়, "মহামান্যা হাই কোর্টের ০৪/০৪/২০২৩ তারিখের আদেশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ১০/০৯/২০২৩ তারিখের সিদ্ধান্ত ও আদেশ না মেনে আমাকে বাদ রেখেই মনোবিজ্ঞান বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোঃ কামাল উদ্দিন ২১/০৯/২০২৩ তারিখে 'সি অ্যান্ড ডি' সভা করেছেন যা আদালত অবমাননাসহ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের শামিল।"
দ্বিতীয়ত উল্লেখ করে আরও বলা হয়, "উক্ত 'সি অ্যান্ড ডি' সভায় সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগের সারসংক্ষেপ বিবেচনা সম্পর্কে একটি গুরুতপূর্ণ অ্যাজেন্ডা ছিল। বিশ্বস্তসূত্র মোতাবেক, উক্ত পদে আবেদনকারীদের মধ্যে অন্য একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরিরত ব্যক্তি এবং বিজ্ঞাপিত পদের শর্তাবলী পূরণ করেন না এমন প্রার্থীও রয়েছেন। মনোবিজ্ঞান বিভাগের একজন সিনিয়র শিক্ষক ও 'সি অ্যান্ড ডি' কমিটির সদস্য হিসেবে আমি ২৪/০৯/২০১৩ তারিখে বিভায় সভার সিদ্ধান্তসমূহ এবং সেই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ বরাবর নিয়োগ সম্পর্কিত প্রেরিত নোট/চিঠির কপি দেখতে চাই। কিন্তু আমাকে এর কোনটিই দেখানো হয়নি।"
অধ্যাপক ড. মোঃ কামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে তিনি আরও লিখেন, "ইতিপূর্বে তিনি ৪র্থ বর্ষ বিএস সম্মান পরীক্ষা-২০২১' সংক্রান্ত কর্তৃপক্ষের একাধিক আদেশ উপেক্ষা করে উক্ত পরীক্ষায় জটিলতা সৃষ্টি করেছিলেন। এছাড়াও তাকে উক্ত পরীক্ষার কাজে বারবার বাঁধা প্রদান করে পরীক্ষার কার্যাবলী সম্পন্ন ও ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব ঘটিয়েছিলেন যা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জানা আছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এছাড়াও উক্ত সভার সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরাবর নিয়োগ সম্পর্কিত কোন নোট/চিঠি প্রেরণের ক্ষেত্রে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে কিনা তা খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়ে লিখেন, ইতিপূর্বে তিনি জালিয়াতির মাধ্যমে স্টোর কিপার পদে নিয়োগ প্রদানের চেষ্টা করেছিলেন যা মহামান্য হাই কোর্ট ২৭/০৪/২০২২ তারিখে এক আদেশের মাধ্যমে স্থগিত করে দিয়েছেন। উক্ত অবৈধ 'সি অ্যান্ড ডি' সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুমোদনযোগ্য নয় বিধায় তা পরিত্যাজ্য বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম বলেন, আমাকে মিটিংয়ের কোনো চিঠি দেয়নি। মিটিংয়ের চিঠিতেও আমার নাম নেই, অথচ সিনিয়র সদস্য হিসেবে আমার নাম প্রথমে থাকার কথা। মিটিংয়ে নিয়োগের ব্যাপারে আলোচনা করেছিল। নিয়োগের শর্ত পূরণ করে না এমন প্রার্থীও ছিল। আমার সন্দেহ সে এখানে অনিয়ম করে কাউকে সুপারিশ করেছে, এজন্যই সে আমাকে মিটিংয়ে ডাকেনি।"
ক্লাস দেয়া হয়েছে কি না সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে অধ্যাপক রেজাউল করিম বলেন, "আমাকে এখনও কোন ক্লাশ দেওয়া হয়নি। কেন দেওয়া হচ্ছে না তা আমার বোধগম্য নয়। মহামান্য হাইকোর্ট আমার পক্ষে রায় দিয়েছেন। যেহেতু একাডেমিক কার্যাবলী থেকে আমাকে প্রদত্ত অব্যহতির সিদ্ধান্ত অবৈধ এবং বিশ্ববিদ্যালয় বিধি পরিপন্থী তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই রায় মানতে বাধ্য। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেরিতে হলেও রায় বাস্তবায়ন করেছে। একাডেমিক কমিটি বা চেয়ারম্যান যেমন কাউকে শাস্তি দেয়ার এখতিয়ার রাখে না তেমনি হাইকোর্টের রায় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আদেশ নিয়ে নতুন করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ারও কেউ না।"
তিনি আরও বলেন, "কয়েকদিন আগে আমাকে একাডেমিক কমিটির পক্ষ থেকে প্রতিনিধি পাঠিয়ে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল আমি যেন এত লেখালখি না করি। আমি বলেছি, এই বিভাগে যতদিন চাকুরি করবো আমার কলম কেউ থামাতে পারবে না। আমি এমনি এমনি লিখি না। বিচার না পাইলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমি লিখবোই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাত জন শিক্ষকের প্রথম অভিযোগটি আমলে নিয়ে তদন্ত করলে, বিচার করলে এত লেখালেখি করতে হতো না।"
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামাল উদ্দিন বলেন, সে কী অভিযোগ করেছে আমি জানি না। বিভাগে রেগুলার মিটিংয় হয়। বিষয়টি নতুন না, এর আগেও ওনাকে বাদ দেয়া হয়েছে। মিটিংটি নতুন কোনো মিটিংয়ে নয়, এর আগের মিটিংয়ে আমরা কিছু জিনিস সময়ের অভাবে করতে পারিনি। গত মিটিংয়ে সেই কাজগুলো করেছি। এটা তাকে জানানো না জানানোর বিষয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে বিভাগে অ্যাকাডেমিক কমিটি থেকে ওনাকে পুনর্বহাল করা হলে তার পরে বাদ পড়লে সে অভিযোগ করতে পারে।
শিক্ষক নিয়োগ ও ক্লাস দেয়া হচ্ছে না প্রশ্নে চেয়ারম্যান বলেন, আমরা মিটিংয়ে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি দেখেছি। শিক্ষক নিয়োগের কাজ সিলেকশন বোর্ড করবে, এটা আমাদের কাজ না। তার এসব বেফাঁস মন্তব্যের জন্য এর আগেও ওনাকে তিনবার ক্লাস থেকে বর্জন করা হয়েছে। কোর্স বন্টণ করা হয় সেশনের শুরুতে। মাঝখানে কোর্স দেয়া যায় না। পরবর্তী সেশনে ওনি কোর্স পাবেন। সে এর আগে ওনি এপ্রিল, মে, জুন, মাসে ৪র্থ বর্ষ ও মাস্টার্সের ক্লাস নিয়েছেন। কাজ করতে পারতেছেন না বিষয়টি সত্য নয়।
অন্য দু'জন শিক্ষকের মিটিংয়ে না আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাদের ব্যর্থতার জন্য তারা মিটিয়ে উপস্থিত হতে পারেনি। তারা রেগুলার বৃহস্পতিবার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে যান। আরিফা রহমান আমাকে বলেছে নতুন হাউজ টিউটর হওয়ায় এই সংক্রান্ত কাজের ব্যস্ততার জন্য মিটিংয়ে আসতে পারেনি। আয়েশা সুলতানা গেস্ট টিচার হিসেবে ক্লাস নিতে গিয়েছেন তাহলে কীভাবে আসবেন। আর একটি মিটিংয়ে সবসময় সবাই উপস্থিত থাকে না।
এ বিষয়ে ড. আয়েশা সুলতানা বলেন, আমরাতো এটাকে (অধ্যাপক রেজাউল করিমের বিষয়টিকে) সাপোর্ট করে অনেক আগে থেকে বর্জন করে আসছি। মাঝখানে আমরা গেলাম, তবে ওনি যেভাবে কাজ করতেছেন বিষয়গুলোকে সম্বোধন করা উচিতও না। মিটিংটি অবৈধ ছিল এবং পাশাপাশি আমার ব্যস্ততা থাকার কারণে উপস্থিত হতে পারিনি।
সহযোগী অধ্যাপক আরিফা রহমান বলেন, বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের ঝামেলা যাচ্ছে। মিটিংটি অবৈধ ছিল, পাশাপাশি আমার ব্যস্ততাও ছিল। হাইকোর্ট থেকে রায় এসেছে ওনাকে ইনক্লুড করার জন্য। সেদিন মিটিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ অ্যাজেন্ডা ছিল। আমি মনে করেছি সিনিয়র দুজন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে নিয়ম অনুযায়ী হবে না। এ কারণে আমি মিটিংয়ে উপস্থিত হইনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রবীর কুমার সাহা বলেন, আমি অধ্যাপক রেজাউল করিমের চিঠি পেয়েছি। আমি চিঠিটি সেকশনে পাঠিয়ে দিয়েছি। উপাচার্য এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন। আমরা চেয়ারম্যানকে বলে দিয়েছি কোর্টের আদেশ মানার জন্য। আমাদের দিক থেকে আমাদের কাজ করে দিয়েছি।