এক বছর আগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পর বারবার আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে তালেবান শাসিত আফগানিস্তান। দেশ,জাতি ও মানুষের ইতিবাচক কাজের জন্য নয়, স্বাধীন চিন্তা ও নারী শিক্ষার বন্ধ করার কারণে। ক্ষমতা দখলের পর-পরই নারীদের স্বাভাবিক চলাফেরায় বাধাদান, চাকরিতে প্রবেশবন্ধ , মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষাবন্ধ, সর্বোপরি নারীদের উচ্চ শিক্ষায় বাধা দান। এ ঘটনার প্রতিবাদে আফগানিস্তানের বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছেলে শিক্ষার্থীরা তাদের বোনদের লেখাপড়ার সুযোগের দাবিতে পরীক্ষা বয়কটও করেছেন। তালেবান সদস্যরা প্রতিষ্ঠানের গেট থেকে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে দিয়েছে। ঘটনার প্রতিবাদে সেখানে মেয়েরা প্রতিবাদ মিছিল করেছে, তালেবানদের মধ্যযুগীয় এই ঘটনার প্রতিবাদ করেছে জাতিসংঘসহ কয়েকটি ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রও । সম্প্রতি ইরান সরকার হেজাবের বিষয়ে গ্রেফতারকৃত একজন মেয়েকে হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করায় দমন-নিপীড়ন ও আন্দোলন দমনে ৪ শতাধিক মানুষ হত্যার পর সেই নীতি,পুলিশের নিয়ম বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে । বিষয়টি তালেবানরা খেয়াল করেছে কী না জানিনা। স্বভাব যায়না মলে (মরলে) আর ইল্লত যায়না ধুলে-কথাটি যেন আফগান তালেবানদের জন্য শতভাগ সত্য। আফগানিস্তানের ২০ বছর আগের তালেবান শাসক যা করেছিলো, এ আমলের তালেবানরা তা হয়তো আর করবে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সকল ভাবনা এবং প্রত্যাশাকে ভুল প্রমানিত করে তার পুরানো অভ্যাসে ফিরে গেল। ফলে শারীরিক মৃত্যু ছাড়াও আফগান মানুষের মানসিক মৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন হওয়ার ৯ মাসের মাথায় অনেক সরকারি চাকরিতে মেয়েদের নিষিদ্ধ,মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা গ্রহনে বিধিনিষেধ আরোপ, নিজ শহর এবং বাইরে যেতে নিজ আত্মীয়দের সাথে নেওয়ার বিধান করা, বাইরে গেলে বাধ্যতামূলকভাবে বোরকা বা হিজাব পরার বিধান তারা জারি করেছে। বাংলাদেশের হেফাজতি মোল্লারা যেমন বলেছিলো, মেয়েদের প্রাথমিক স্কুলের পর পড়াশোনার দরকার নেই। পৃথিবীর কোন অগ্রগতিই তালেবানদের বর্বরতা থেকে মুক্ত করতে পারছে না। এ ব্যর্থতা তালেবানদের না বিশ্ব সম্প্রদায়ের-এ প্রশ্নটি আজ সামনে আসছে।
মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মে কিন্তু সে সর্বত্রই শৃঙ্খলিত। এটি পরিয়েছে ক্ষমতাধর ব্যক্তি,সমাজ অধিপতি এবং রাষ্ট্র নামক যন্ত্র। শৃঙ্খল যারা পরিয়েছে তারা সংখ্যায় কম, তবে ক্ষমতা তাদের বেশি। ব্যক্তি, গোষ্ঠির রাজনৈতিকও সামাজিক স্বার্থে নানাভাবে, নানা অজুহাতে এদেরকে সচেতন না করে অন্ধ করে রেখেছে ধর্মীয় মোড়ল, সামাজিক অধিপতি এবং রাজনীতিকরা। এই কাজটা জগতের শুরু থেকেই চলছে, আজও সেটার লাগাম ছাড়েনি-শুধু কর্তৃত্ব করার পদ্ধতিটি পাল্টেছে। তথাকথিত সেই বিধানগুলোর আইনি স্বীকৃতির জন্য রাষ্ট্রীয় অনুমোদনের ব্যবস্থা করেছে এবং তা কার্যকর করার জন্য রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীকে কাজে লাগিয়েছে। ফেসবুকে মন্তব্যের জন্য সাধারণ মানুষকে জেলের ভাত খেতে হলেও সুন্দরি নাবালিকাকে বিয়ে,তালাক এবং হত্যার দিকে ঠেলে দিলেও থানা তো দূরে থাক, কোর্টের বারান্দায়ও অনেককে যেতে হয় না, কেবলই অর্থ-বিত্ত আর রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রনকারীদের সাথে সখ্য থাকার জন্য। মনীষী বার্ট্রান্ড রাসেল সেই কারণেই হয়তো বলেছিলেন, রাষ্ট্রযন্ত্র জনগণের বিপক্ষে গেলে সেই রাষ্ট্রে মানুষ বাস করতে পারেনা। রাসেলের সেই উক্তি অনেক দেশেই দৃশ্যমান। এই বিষযটার বেশি মুখোমুখি আফগানিস্তান। একদিকে মৌলবাদি জঙ্গি তালেবান অন্য দিকে মুনাফালোভি আমেরিকাসহ তার স্বার্থরক্ষাকারী পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ। তাদের লাভ-লোকসানের অংক মেলাতে গিয়ে আফগান নাগরিকদের সুখ-শান্তি আর স্বাধীনতা কী জিনিস সেটার স্বাদ নিতে দেয়নি। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি মানবতা আর স্বাধীন চিন্তা কী তারা জানেন না।কিন্তু এটাতো হওয়ার কথা ছিলো না। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ইরান,পাকিস্তান আর চীনের সীমান্ত ঘেঁষে এশিয়ার একমাত্র দেশ আফগানিস্তান, ১৮ শতাব্দীতে আফগান রাষ্ট্রের পত্তন ঘটে। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আফগানিস্তানে রাজতন্ত্র বিদ্যমান ছিলো। রাজতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে বামপন্থিদের গড়ে তোলা রাজনৈতিক দল জনগণতান্ত্রিক পার্টি আফগানিস্তানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়েছিলো। আধুনিক রাষ্ট্র গড়তে প্রগতিশীলতার নারী স্বাধীনতা সবার জন্য লেখাপড়ার ব্যবস্থাসহ নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ার কার্যক্রম শুরু করেছিলো। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই রাশিয়া,চীন-মঙ্গোলীয়া ভিয়েতনামসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ায় সাম্রাজ্য হারানোর আতংকে ছিলো আমেরিকা ন্যাটো ও তার মিত্র দেশগুলো। এশিয়ার বৃহৎ দেশ চীন ,ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া মঙ্গোলীয়াতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়া, ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে বামপন্থীদের শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় আতংকিত ছিলো আমেরিকা। তাই নতুনভাবে এ অঞ্চলে আর কোন সমাজতান্ত্রিক দেশের জন্ম হোক-এমনটা যেমন চাচ্ছিলো না, তেমনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বাড়ুক-এটা তারা সহ্য করতে পারছিলো না। আমেরিকার এই না চাওয়া থেকে আফগানিস্তানের মানুষের যে শনির দশা শুরু হয়েছিলো, সেটা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবকে দুর্বল করতে এবং বামপন্থীদের সরকারকে উৎখাত করতে আমেরিকা, ইরান, সউদি আরব এবং পাকিস্তান মিলে আল-কায়দা মুসলিম জঙ্গি গোষ্ঠি গড়ে তোলে । এই কাজ করতে তারা অর্থ ও অস্ত্রের সরবরাহ করে। হামিদ কারজাইও তখন মোলবাদীদের একটা গ্রুপের প্রধান হিসেবে সিগবাতুল্লাহ মুজাহিদীনের অফিস পরিচালনা করতেন। ১৯৭৯ থেকে সৌদি আরব ও আমেরিকা মিলে প্রতি বছর আফগান মৌলবাদীদের ২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করতো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র ও অর্থ পেতো গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের গ্রুপ। সেই সময় গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার ৬০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থ ও অস্ত্র পেয়েছিল্। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দের পরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মৌলবাদী মানসিকতার মানুষ সংগ্রহ করে জেহাদের নামে জঙ্গি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো। প্রশিক্ষিত এই জঙ্গি গোষ্ঠির, তারা নাম দিয়েছিলো আফগান আরব। সৌদি ওসামা বিন লাদেন ঐ গ্রুপেরই একজন ছিলেন। সৌদি আরব, পাকিস্তান আর আমেরিকার তত্ত্বাবধানে সৃষ্ট আল কায়দার ঐক্যবদ্ধ ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা পেতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা নজিবুল্লাহর সরকার সোভিয়েত বাহিনীকে আফগানিস্তানে প্রবেশের অনুমতি দেয়। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে আফগানিস্তান থেকে রুশ সৈন্য সরিয়ে নেওয়া হয়।
এরপর নজিবুল্লাহর সরকারের পতন হলে তালেবানরা ক্ষমতা দখল করে এবং মধ্যযুগীয শাসন শুরু করে নারীদের বাইরে যাতায়াত ও স্কুল কলেজে যাওয়া নিষিদ্ধ করে। প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়,পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তালেবানরা। বিদ্রোহী হয়ে ওঠে আফগান জনতা, এক পর্যায়ে তালেবানরা ক্ষমতা হারায় । হামিদ কারজাই মার্কিন বাহিনীর সমর্থন নিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। ৮০ দশক থেকে সেখানে কওমি মাদরাসা গড়ে তোলা হয়,জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে চারটি নির্বাচনও হয়, তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা আর কট্টর মানসিকতার কারণে খুব বেশি মানুষকে কুসংস্কারমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ মার্কিন বা জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের বিশ্বাস করেনি, কারণ আফগান প্রশাসনও নানা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিলো। মার্কিন বাহিনীর অনেক সমরবিদ গোপনে তালেবানদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছে-এমন অভিযোগও ছিলো। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ওলামাদের সমাবেশ ও সম্মেলন করে তাদের নসিহত করে আফগান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি। কারণ, সাপ আর মৌলবাদী পোষ মানেনা। মার্কিনীরা ,আফগানদের তাদের জীবন-যাত্রার আঙ্গিকে গড়ে তোলার জন্য যত চেষ্টা করেছে-সেই তুলনায় সুশাসন আর ন্যায়ের সমাজ গড়ার কাজটি করতে পারেনি। অথবা করেনি। ফলে এক নাগাড়ে ২০ বছর আফগানিস্তানে অবস্থান করেও না পেরেছে তাদের মতে করে গড়ে তুলতে ,না পেরেছে শান্তির পক্ষে দাঁড় করাতে। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলার জন্য ওসামা বিন লাদেনকে দায়ি করে তাকে গ্রেফতারের জন্য আমেরিকা আফগানিস্তানে সৈন্য প্রেরণ করে । সেই থেকে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন পর্যন্ত আফগানিস্তানে অবস্থান শেষে ত্যাগের ঘোষণা দেয়। ২০ বছর ধরে আমেরিকার ৪ জন রাষ্ট্রপতির তত্ত্বাবধানে যুদ্ধ করে ২৩ হাজার কোটি ডলার ব্যয় করেছে। কিন্তু শেষে পরাজয়ের গ্লানি নিয়েই বিদায় নিতে হলো ।এর চেয়ে আরো করুণ পারজয় বরণ করতে হযেছিলো ১৯৭৩-তে আজকের সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনামের সাথে ১৮ বছর ৯ মাসে যুদ্ধের পর । তাদের ৫ জন রাষ্ট্রপতির তত্ত্বাবধানে যুদ্ধ করতে গিয়ে ৫৯ হাজার সৈন্য হারাতে হয়েছিলো। মার্কিন সৈন্যের বিদায়ের সাথে সাথে আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল তালেবানদের মধ্যযুগীয় শাসনকে প্রতিরোধ করতে স্থানীয় বিভিন্ন সশস্ত্র মিলিশিয়া গ্রুপ আফগান সরকারের প্রতি সংহতি জানিয়ে অস্ত্র ধরেছিলো, আফগান সরকারের বিমান বাহিনীর হামলাতেও তালেবানরা কোথাও কোথাও দুর্বল হলেও শেষ পর্যন্ত তালেবানরা ক্ষমতা দখলে সক্ষম হয়। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো তালেবানদের প্রতি সহনুভূতিশীল হয়েছিলো তাদের ব্যবসায়ী স্বার্থে এবং মার্কিন বিদ্বেষ থেকে। বিষয়টি ব্যবসায়ী মনোভাব দিয়ে বিবেচনা না করে আফগানিস্তানের সাধারণ নিরীহ নারী-পুরুষের মর্যাদার জায়গা থেকে বিবেচনা করলে এই মানুষগুলো অসভ্য একটি পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে পারে,পৃথিীবী কলংকমুক্ত হতে পারে তালেবানি মধ্যযুগীয় অবস্থা থেকে। পৃথিবীর শান্তিকামী প্রগতিশীল মানুষদের এটাই প্রত্যাশা হওয়া উচিত। পার্শ্ববর্তী দেশ রাশিয়া, সউদি আরব, পাকিস্তান এবং ইরানের সেই দয়িত্বটাই পালন করা দরকার। আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ যেন আর তালেবানি মৌলবাদিদের বলির পাঁঠায় পরিণত না হয়, সে বিষয়টা ভাবার সময় এসেছে।তালেবান জিতলে মানবতা হারবে, ঐ অঞ্চল থেকে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটবে না, বিষয়টি বিবেচনা করে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শান্তির মিশন নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে আফগান সাধারণ মানুষের অংশগ্রহনের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।
লেখক : আকমল হোসেন, কলেজ অধ্যক্ষ