পঞ্চাশের দশকের মৌলিক কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর আজ মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার বাহেরচর-ক্ষুদ্রকাঠি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান।
তিনি বিচারপতি স্পিকার আবদুল জববার খানের পুত্র। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় পিতার কর্মস্থল ময়মনসিংহে। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে অনার্সসহ এমএ পাস করেন। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে Later Poems of Yeats: The Influence of Upanishads বিষয়ে গবেষণা করেন যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকেই তিনি পরবর্তীকালে উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ে ডিপ্লোমা অর্জন করেন।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে লেকচারার হিসেবে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবনের শুরু হলেও পঞ্চাশ দশকের ক্যারিয়ারিস্ট জেনারেশনের চলতি রীতি ধরে তিনি ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সব পরীক্ষার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সচিব পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন পদে কাজ করেন।
১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বাংলাদেশ সরকারের কৃষি ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ব্যাংককস্থ FAO কার্যালয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে FAO থেকে অবসর গ্রহণের সময় তিনি এ প্রতিষ্ঠানের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের মহাপরিচালক ছিলেন। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের চেয়ারম্যান হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন উইনরক ফাউন্ডেশনের সাম্মানিক সদস্য; হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স ও জন এফ কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্ট-এর ফেলো।
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তার কাব্যরীতিতে মূলত দুটি প্রবণতাকে অনুসরণ করেছেন: একটি তার প্রথম জীবনের প্রিয় গীতিমুখ্য কাব্যরীতি আর অন্যটি মহাকাব্যিক। পঞ্চাশের দশকে রচিত তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ সাত নরী হার এবং পরবর্তীকালের কখনো রং কখনো সুর ও কমলের চোখ এ ধরনের গীতিমুখ্য সুললিত কবিতার সংকলন। আশির দশক থেকে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ মহাকাব্যিক কাব্যরীতিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। এ পর্যায়ে তার কবিতার বিষয় হিসেবে উঠে আসা মা-মাটি ও সংগ্রামী মানুষের চিত্র পরিচিত দেশ-কালের সীমানা অতিক্রম করে স্পর্শ করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডল। এ মহাকাব্যিক কাব্যভঙ্গিতেই তিনি রচনা করেন তার সর্বাধিক জননন্দিত কাব্যগ্রন্থ ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ ও ‘কোনো এক মাকে’। এ ছাড়া সহিষ্ণু প্রতীক্ষা, বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা কাব্যগ্রন্থ দুটিতেও মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা লক্ষ্য করা যায়।
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ রচিত অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আমার সময়, নির্বাচিত কবিতা, আমার সকল কথা, খাঁচার ভিতর অচিন পাখি এবং জীবিত অবস্থার সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ মসৃণ কৃষ্ণগোলাপ। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রচনা করেছেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে চীনের কমিউন সম্পর্কে Yellow Sands' Hills: China through Chinese Eyes; বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়ন সম্পর্কে Rural Development: Problems and Prospects; (Tom Hexner-এর সঙ্গে যৌথভাবে); Creative Development; Food and Faith।
কাব্য রচনার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ‘পদাবলি’ নামে কবিদের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠনটি আশির দশকে দর্শনীর বিনিময়ে কবিতা সন্ধ্যার আয়োজন করতো। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।