শিক্ষকই মানুষকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবশক্তিতে রূপান্তরিত করে দেশ ও জাতি গঠনে গুরু দায়িত্ব পালন করেন। সে কারণেই আমাদের সমাজে পিতা-মাতার পরেই শিক্ষকের স্থান। সন্তানের জীবন দান করেন পিতা-মাতা কিন্তু তাকে উন্নত জীবনের আলোয় আলোকিত করেন শিক্ষক। পিতামাতা সন্তানের দৈহিক ও ব্যবহারিক চাহিদা মেটান সত্য। তবে তাকে সুনীতিবান, সুরুচিসম্পন্ন, সুশীল আর জ্ঞানবান করার কাজটি করেন শিক্ষক। আদর্শ শিক্ষকের স্পর্শে যেমন শিক্ষার্থীর মানসিক দর্শনগুলি বিকশিত হয়, আবার তেমনই সে হয়ে ওঠে উত্তম হৃদয়ের অধিকারী সদাশয়, বিনয়ী, কল্যাণমুখী, সৃষ্টিশীল শ্রেষ্ঠ মানুষ।
সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে তাই মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় সমাজে শিক্ষক অপরিহার্য। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির প্রেক্ষাপটে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কোর সাধারণ অধিবেশনে শিক্ষকতা পেশা সম্পর্কিত একটি শিক্ষা সনদ প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। অতঃপর ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্মিলিত জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ২৬ অনুচ্ছেদে শিক্ষা মৌলিক অধিকার এবং ব্যক্তিত্ব বিকাশে এর গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত হয়। উক্ত ঘোষণার প্রেক্ষাপটে শিক্ষক সম্প্রদায়ের ন্যায় সংঙ্গত অধিকার সমুন্নতকরণের লক্ষ্যে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে গঠিত হয় বিশ্ব শিক্ষক সংঘ। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা কর্তৃকও শিক্ষকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাদি সমাধানের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের একটি সভায় গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব প্রণীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ৫ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশেষ আন্তঃরাষ্ট্রীয় সরকার সম্মেলনে প্রণীত হয় শিক্ষকের দায়িত্ব-কর্তব্য এবং অধিকার ও মর্যাদা বিষয়ক ঐতিহাসিক ইউনেস্কো-আইএলও সুপারিশ-১৯৬৬। ১৩টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এবং ১৪৬ ধারা-উপধারা সম্বলিত এ দলিলে শিক্ষককে দেশ, সমাজ ও জাতি গঠনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করে শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত ব্যাক্তিদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার, মর্যাদা ও দায়-দায়িত্বের বিষয় সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
মানবাধিকার বাস্তবায়নের লক্ষে ইউনেস্কো-আইএলও সুপারিশমালা জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত বাংলাদেশসহ প্রতিটি রাষ্ট্রে যথাযথভাবে কার্যকর করা একান্ত প্রয়োজন। ইউনেস্কো-আইএলও-এর সুপারিশমালা বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের সচেতন করে তুলতে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে সমন্বয়ক সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় বেলজিয়াম ভিত্তিক সমগ্র বিশ্বের শিক্ষক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ÔEducation International.Õ শিক্ষকতার মর্যাদা ও দায়-দায়িত্ব বিষয়ক সুপারিশমালা প্রণয়নের দিবস ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দানের জন্য ÔEducation InternationalÕ ইউনেস্কোকে অনুরোধ জানায়। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে তৎকালীন ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ড. ফ্রেডারিক এম মেয়র কর্তৃক ঘোষিত হয় ঐতিহাসিক ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এ দিবসের আবেদন অনেক গভীর। সারাবিশ্বে একদিকে যেমন আনন্দ উৎসব মুখর পরিবেশে সর্বস্তরের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য সৃষ্টির লক্ষে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী ম্যাচ, বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান, সঙ্গীতানুষ্ঠান ইত্যাদি আয়োজনের মাধ্যমে দিবসটি উদযাপিত হয়। আবার তেমনই এই দিনে অসুস্থ্ ও বিপদগ্রস্থ শিক্ষকের পাশে দাঁড়িয়ে সহানুভুতি, সহমর্মিতা ও সমবেদনা জ্ঞাপন করাও শিক্ষক সমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ ছাড়াও আলোচনা, সংলাপ ও সমালোচনামূলক সভার মাধ্যমে শিক্ষকের পেশাগত সাফল্য অর্জন ও ব্যর্থতার মূল্যায়ন করে শিক্ষার গুণগত মান বিকাশ ও নিজেদের মর্যাদা অর্জনের পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের উপায় নিরূপণ করতে পালিত হয় এদিন। শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের বিষয়ে আলোকপাত করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় শিক্ষকতা কেবল চাকুরী নয় বরং শিক্ষাকতা এক মহান পেশা ও ব্রত। যুগে যুগে কালে কালে তাই শিক্ষক জ্ঞানের দ্বীপশিক্ষা জ্বেলেছেন, উজাড় করে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের জ্ঞান ভাণ্ডারকে। অথচ কখনো প্রশ্ন করে দেখেননি প্রতিদানে কি পেয়েছেন? শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে দেওয়ার মহৎ চেতনা ও উপলব্ধি তাকে শিক্ষাদান করার পবিত্র দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করে। এর জন্য তাকে সারা জীবন ত্যাগ করতে হয়, সংগ্রাম করতে হয় তবু তিনি আদর্শচ্যুত হন না। শিক্ষার্থীকে শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে তাদের অধ্যাবসায়ী, পরিশ্রমী, অনুসন্ধানী ও জ্ঞানপিপাসুরূপে গড়ে তোলাই শিক্ষকের দায়িত্ব। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে এমন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠদান করবেন যাতে শিক্ষার্থীর আর গৃহশিক্ষকের বা আলাদা করে কোচিং এর প্রয়োজন না হয়। মনে রাখতে হবে শিক্ষকের নিজের আচরণ যেন তার বক্তব্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়।
এখন প্রশ্ন এই মহান পেশার প্রতি আমরা শিক্ষকেরা কতটুকু যত্নবান? কতটুকু নিষ্ঠাবান? কতটুকু আন্তরিক? এসব প্রশ্নের পাশাপাশি আবার প্রশ্ন আসে শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পরিবেশ কতটুকু সহায়ক? আবার দেখতে হবে দেশের এই শ্রেষ্ঠ মানুষ শিক্ষকগণ তাদের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা পেয়েছেন কি? পাচ্ছেন কি?
প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী অতিক্রান্ত হওয়ার পরও কিন্তু এখনও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের অসংগতিপূর্ণ সরকারি ও বেসসরকারি বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থাই গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার অন্তরায়। তাছাড়া এখনও একটি স্বাধীন দেশের উপযোগী শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত না হওয়ায় দিক নির্দেশনাহীন, সমন্বয়হীন এক অব্যবস্থাপূর্ণ শিক্ষা কার্যক্রমের ফলে, চলছে নিয়োগ বাণিজ্য ও ভর্তি বাণিজ্য ইত্যাদি যা অত্যন্ত দুঃখজনক। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ৯৫ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থীর প্রয়োজন মেটাচ্ছে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো, কিন্তু সে অনুপাতে শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় কোনো ক্ষেত্রেই তাদের প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়নি। আবার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকুরীরত শিক্ষক কর্মচারীদের সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর ন্যায় বেতন-ভাতা, চাকুরীবিধি, নিয়োগনীতি, অবসরকালীন জীবনের আর্থিক নিরাপত্তার সুযোগ এমনকি পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে প্রশিক্ষণ ও গবেষণার সুযোগও নেই। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি গঠনের ফলে শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি ও দলাদলির কারণে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হয় এবং শিক্ষকদের চাকরীর নিরাপত্তা থাকে না। এমনকি শিক্ষক লাঞ্ছিত হওয়ার মত দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। এই জন্যে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিচালনা কমিটি প্রথা বিলুপ্ত করে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অনুরূপ নিয়ম-নীতি প্রবর্তন করতে হবে। যদিও একটি স্বাধীন দেশের শিক্ষা সেবায় নিয়োজিত ব্যাক্তিদের পরিবার পরিজনদের নিয়ে সহজ ও সুন্দরভাবে জীবন যাপনের জন্যে তাদেরকে অভিন্ন বেতন-ভাতা, চাকুরীর নিশ্চয়তা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রদান সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। এবছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হল ‘শিক্ষার জন্যে আমাদের শিক্ষক প্রয়োজন ঃ বিশ্বব্যাপী শিক্ষকের অভাব মোকাবেলা করা।’ শিক্ষকতা পেশার ভবিষ্যতের দিনগুলোকে উজ্জ্বলতর করতে উদীয়মান মেধাবী ও প্রতিভাবানদের আকৃষ্ট করতে হবে। সেকারণে শিক্ষকতা পেশাকে কোন ধরণের অবহেলার অবকাশ নেই, বরং সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপের আহ্বান জানানো হয়েছে।
পরিশেষে বলতে চাই আমাদের শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে সরকারি বেসরকারি বৈষম্য দুর করতে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের কোন বিকল্প নেই। তাই সরকার, ইউনেস্কো আইএলও-এর সুপারিশমালার আলোকে সরকারি ও বেসরকারি বৈষম্য অবসানের লক্ষ্যে সুপরিকল্পিতভাবে পর্যায়ক্রমে শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করবেন, বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এই প্রত্যাশাই করি।
লেখক: প্রাক্তন ট্রেজারার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাপতি, বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদ এবং প্রধান উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক শিক্ষাডটকম।