মানুষের যেকোনো সচেতন প্রচেষ্টাই শিক্ষামূলক; পরিকল্পনা মোতাবেক নির্ধারিত লক্ষ্যের দিকে তা এগিয়ে চলে। যেকোনো উদ্দেশ্য মানুষের কর্মপ্রচেষ্টা নিয়ন্ত্রণ করে। লক্ষ্যই মানুষের কাজে কর্মে প্রেরণা যোগায় এবং সাফল্যের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে সচেতন করে। শিক্ষা একটি সচেতন প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন ও আচরণগত পরিবর্তন নির্দিষ্ট লক্ষ্য অভিমুখী ও নির্দিষ্ট মান অনুযায়ী হওয়া দরকার। ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিভিন্ন দেশে মানুষের চিন্তাধারায় পরিবর্তনের সঙ্গে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও ভিন্ন হয়ে গিয়েছে। যুগের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার লক্ষ্য নিরূপিত হয়ে থাকে। শিক্ষা একটি গতিশীল ধারণা। এর তাৎপর্য দেশ ও কালভেদে ভিন্নরূপ হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষার ক্রমবিবর্তনের ধারার সূচনালগ্ন হতে পর্যায়ক্রমিক বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য। কারণ বর্তমানের এই ভিন্নতর মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা একদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়নি অথবা হঠাৎ করে অলৌকিকভাবে গড়ে উঠেনি। যুগ পরিক্রমায় শত শত বছরব্যাপী প্রবাহমান এ শিক্ষা ধারার ক্রমবিবর্তন ইতিহাসের পরিসর সুবিস্তৃত। মাদরাসা শিক্ষা বাংলাদেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম শাসনামলে মাদরাসা শিক্ষাই ছিলো অন্যতম শিক্ষা ব্যবস্থা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মুসলিম শাসনের পতন ঘটলেও ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর অধীনে উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান শিক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে মাদরাসা শিক্ষার প্রসার ঘটে। ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত কলকাতার আলিয়া মাদরাসার অনুকরণে বাংলাদেশেও প্রতিষ্ঠিত হয় আলিয়া মাদরাসা। আলিয়া মাদরাসায় সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মাদরাসা শিক্ষা কার্যক্রমও পরিচালিত হয়ে আসছে। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় ইবতেদায়ি স্তর এবং ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে দাখিল ও আলিম স্তরের জন্য শ্রেণি ও বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়।
বিশ্বের প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে মাদরাসা শিক্ষা অন্যতম। এ ধারার প্রবর্তক মহানবী (স.) স্বয়ং। এ শিক্ষাব্যবস্থার মূলগ্রন্থ হলো ‘আল কোরআন’। মহান আল্লাহর প্রেরিত দূত জিবরাইল (আ.) পবিত্র কোরআনের আয়াত আল্লাহর তরফ হতে মহানবী (স.) এর কাছে নিয়ে আসতেন। নবীজী সেগুলো নিজে আয়ত্ত করতেন এবং সাহাবীদেরকে মুখস্থ করাতেন। অন্যদিকে মহানবী (স.) কর্তৃক প্রদত্ত কথা, বাণী ও নির্দেশনা হাদিসরূপে গৃহীত হয় এবং পরবর্তীতে মাদরাসা শিক্ষার মূল বিষয়বস্তু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং আল কোরআন এবং আল হাদিস হলো মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি। তখন মাদরাসা শিক্ষার প্রধান স্থান ছিলো মসজিদ। আব্বাসীয় বংশের শাসকরা মাদরাসা শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাদের অনেকেই মসজিদ কেন্দ্রিক মাদরাসা নির্মাণ করা ছাড়াও আলাদা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় মসজিদে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষাদান বাধ্যতামূলক ছিলো।
ভারতে মুসলিম শাসনের সূচনাকাল থেকেই মাদরাসা শিক্ষার উদ্ভব ঘটে। মুসলিম শাসনামলে ভারতে এই শিক্ষা ব্যবস্থা সগৌরবে বিদ্যমান ছিলো। বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হিসেবে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থাই প্রাচীনতম। পবিত্র কোরআন হাদিসের আলোকে উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করা হতো। ইসলামের মূল দর্শনের ওপর ভিত্তি করে তৎকালীন মুসলিম সাম্রাজ্যে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিলো যেখানে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা নিয়েও জ্ঞান চর্চার সুযোগ ছিলো। যেমন- রসায়নবিদ্যা, জোতির্বিদ্যা এবং গণিত শিক্ষা।
ভারত উপমহাদেশে অনার্যদের আগমনের পর থেকে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থাপনা চালু হয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য হতে আগত রাজা, বাদশা, সিপাহসালার এবং সুফি, পীর মুর্শিদগণের প্রচেষ্টায় ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয় এবং তার সঙ্গে সঙ্গে মসজিদ, মক্তব এবং খানকায় মাদরাসা কেন্দ্রিক শিক্ষার চালু হয়। তখন এই শিক্ষা ব্যবস্থার মূলভাষা ছিলো আরবি, ফার্সি এবং উর্দু। মূল বিষয় ছিলো আল কোরআন তাফসির, হাদিস ও ফিকাহ এবং জ্যোর্তিবিদ্যা ও বিজ্ঞান, গণিত শাস্ত্র। মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যয়ভার উইল, হেবা, ওয়াকফ সম্পত্তি এবং দান খয়রাতের অর্থ দ্বারা পরিচালিত হতো। তখনকার আমলের মাদরাসাগুলো কওমী ধাঁচের ছিলো যাতে সরাসরি রাষ্ট্রীয় অর্থের বরাদ্দ ছিলো না। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশী ট্রাজেডির পরবর্তীতে ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে মুসলমানদের ওপর চরম নির্যাতন নেমে আসে। মুসলিমদেরকে ইংরেজদের পরাজিত রাজশত্রু মনে করা হতো। তখন থেকে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর বিভিন্ন নিপীড়ন শুরু হয়।
ব্রিটিশ প্রশাসনের প্রধান ওয়ারেন হেস্টিংস চেয়েছিল মুসলমানরা যাতে ইংরেজদের শাসন, শোষণ ও রাষ্ট্রীয় কার্যপরিচালনা মেনে নেয় এবং এ উদ্দেশ্যেই মাদরাসায় ইংরেজি ধাঁচের শিক্ষা ধারা প্রবর্তন করে আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত করেন। ফলস্বরূপ কলকাতায় ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে ‘কলকাতা মাদরাসা’ এবং পরবর্তীতে ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে ‘হুগলী মাদরাসা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। যেখানে আরবির পাশাপাশি ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান বিষয়ও পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। উল্লেখ আছে- The Calcutta Madrasha was founded by warren hastings in 1780 for the training of Muhammedans as officers in the East India Company’s Service.
ব্রিটিশ ভারতে মাদরাসা শিক্ষা ব্রিটিশ ভারতের চব্বিশ পরগণা জেলার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট নওয়াব আবদুল লতিফ এবং অন্যান্য মুসলিম নেতৃবৃন্দের একান্ত প্রচেষ্টায় ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী জেলায় তিনটি মাদরাসা স্থাপিত হয়। দানবীর হাজী মুহাম্মদ মোহসিন এর ওয়াকফ করা সম্পত্তির আয় হতে মাদরাসা শিক্ষার আংশিক ব্যয় বহন করা হতো। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা তিনটিতে আরবি, ফার্সি ও ইংরেজি বিষয় শিক্ষা দেয়া হতো। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাক্রমে মুসলিমদের অধ্যয়নের জন্য ইসলাম ধর্মের মূল বিষয়গুলোও রাখা হয়। ঢাকা মাদরাসায় আবশ্যিক বিষয় হিসেবে ইংরেজি রাখা হয়। এ মাদরাসার প্রথম সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন মাওলানা উবায়দুল্লা সোহরাওয়ার্দী। স্বাধীনতার পরে ঢাকা মাদরাসার নাম পরিবর্তন করে ‘ঢাকা সরকারি মাদরাসা-ই আলিয়া’ রাখা হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণের ফলে শিক্ষার্থীরা কুরআন ও আরবি ভাষা চর্চার সুযোগ বেশি পাচ্ছে। ঢাকা, সিলেট এবং বগুড়ায় তিনটি সরকারি আলিয়া মাদরাসা রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাগুলো এবতেদায়ি, দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল এই পাঁচ স্তরে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করে। দেশের সকল মাদরাসায় কুরআন পাঠ অত্যাবশ্যকীয়। এছাড়াও কুরআন বুঝার জন্য হাদিস, ফিকাহ্, আকাঈদ, আরবি ভাষা ও সাহিত্যসহ ইসলামের মৌলিক বিষয়াদির পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি, পৌরনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, কৃষি, কম্পিউটার, কারিগরি প্রভৃতি বিষয় শেখানো হয়। মাদরাসাগুলোতে ইহলৌকিক ও পরলৌকিক উভয় জগতের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জিত হয়। বাংলাদেশে ভিন্ন ধারায় বেশ কিছু মাদরাসা রয়েছে যথা- (ক) কওমী মাদরাসা, (খ) মসজিদ ভিত্তিক স্বতন্ত্র মক্তব, (গ) ফোরকানিয়া মাদরাসা, (ঘ) হাফেজি মাদরাসা এবং (ঙ) কিন্ডার গার্টেন মাদরাসা। এগুলো সরকারি নিয়ন্ত্রণযুক্ত তবে কোনো সরকারি অনুদান গ্রহণ করে না।
বাংলাদেশে সম্পূর্ণ বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত কওমী মাদরাসাগুলো মূলত দেওবন্দ মাদরাসা (ভারত) এর সিলেবাস অনুসরণ করা হয়। দেশবরেণ্য কওমী মাদরাসাগুলো হলো হাটহাজারী মাদরাসা, লালবাগ মাদরাসা, মোমেনশাহী কওমী মাদরাসা ইত্যাদি। এ ধারায় শুরুতে কোরআন, হাদিস, ফিকাহ অধ্যয়নের ব্যবস্থা ছিলো। বর্তমানে বাংলা, ইংরেজি, গণিত এবং বিজ্ঞান শিক্ষার প্রাথমিকরূপ চালু রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন আলিম পর্যন্ত আলিয়া মাদরাসাগুলোতে ইসলামী বিষয়গুলোর জন্য মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের সিলেবাস এবং National Curriculum & Textbook Board (NTCB) এর প্রদত্ত সাধারণ বিষয়গুলোর সিলেবাস অনুসরণ করা হয়। ফাজিল এবং কামিল শিক্ষাস্তরে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-এর প্রদত্ত শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি অনুসরণ করা হয়। আলিম মাদরাসার শিক্ষা ব্যবস্থায় মূলত আল কুরআন, আত তাফসির, উসূলুল তাফসির, আল হাদিস, উসূলুল হাদিস, আল ফিকাহ, ইসূলুল ফিকাহ, বালাগাত, হিকমাত, মানতিক, আরবি সাহিত্য, নাহু, সরফ, বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি, পৌরনীতি, ইসলামের ইতিহাস, গণিত, পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান এবং কম্পিউটার ইত্যাদি অধ্যয়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে সেন্ট্রাল বোর্ড অব মাদরাসা এ্যাকজামিনেশন নামে ৮ সদস্য বিশিষ্ট মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দ হতে দাখিলকে এসএসসি এবং ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে আলিমকে এইচএসসি এর সমমান হিসেবে গণ্য করে মাদরাসা শিক্ষকদেরকে জাতীয় বেতন কাঠামোর আওতাভূক্ত করা হয়েছে। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দ হতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া এর অধীনে ফাজিলকে স্নাতক এবং কামিলকে স্নাতকোত্তর বা মাস্টার্স এর সমমান দেয়া হয়েছে। মাদরাসা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (BMTTI) ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে মাদরাসায় কর্মরত ইবতেদায়ি প্রধান, সুপার, অধ্যক্ষ, সহকারী শিক্ষক (বিষয়ভিত্তিক) এবং প্রভাষক (বিষয়ভিত্তিক) ইত্যাদি বিভিন্ন ক্যাটাগরির শিক্ষকদের কর্মকালীন স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করার কাজ অব্যাহতভাবে এগিয়ে চলছে।
জাতীয় আদর্শ ও লক্ষ্যকে সামনে রেখে, শিক্ষার্থীদের যোগ্য আলেম ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে এবং সাধারণ ও ইসলামী বিষয়ের সমন্বয়ে মাদরাসা শিক্ষার শিক্ষাক্রম ও কোর্স প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশে দাখিল স্তরে আল-কুরআন ও তাজভিদ শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়ে থাকে। ইহলৌকিক ও পরলৌকিক জীবনের স্বচ্ছতা, শুদ্ধ ও দ্বীনদার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষা প্রসার ঘটছে এবং মুসলমানদের কাছে মাদরাসা শিক্ষা খুবই জনপ্রিয় শিক্ষা ধারা। আমরা এর উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।
লেখক: এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়