পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদিন আজ। তিনি ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মা ছিলেন ভগবতী দেবী। খুব ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন বিদ্যাসাগর।
চার বছর নয় মাস বয়সে ঠাকুরদাস বালক ঈশ্বরচন্দ্রকে গ্রামের সনাতন বিশ্বাসের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন। কিন্তু সনাতন বিশ্বাস বিদ্যাদানের চেয়ে শাস্তিদানেই অধিক আনন্দ পেতেন। সেই কারণে রামজয় তর্কভূষণের উদ্যোগে পার্শ্ববর্তী গ্রামের কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় নামে এক উৎসাহী যুবক বীরসিংহ গ্রামে একটি নতুন পাঠশালা স্থাপন করেন। আট বছর বয়সে এই পাঠশালায় ভর্তি হন ঈশ্বরচন্দ্র। তার চোখে কালীকান্ত ছিলেন আদর্শ শিক্ষক। কালীকান্তের পাঠশালায় তিনি সেকালের প্রচলিত বাংলা শিক্ষা লাভ করেছিলেন।
১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে পাঠশালার শিক্ষা সমাপ্ত করে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পিতার সঙ্গে কলকাতায় আসেন। তাদের সঙ্গে কলকাতায় এসেছিলেন কালীকান্ত ও চাকর আনন্দরাম গুটিও। কথিত আছে, পদব্রজে মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় আসার সময় পথের ধারে মাইলফলকে ইংরেজি সংখ্যাগুলো দেখে তিনি সেগুলো আয়ত্ত করেছিলেন। কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলের বিখ্যাত সিংহ পরিবারে তারা আশ্রয় নেন। এই পরিবারের কর্তা তখন জগদ্দুর্লভ সিংহ। ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুন কলকাতা গভর্নমেন্ট সংস্কৃত কলেজে ( যা বর্তমানে সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল নামে পরিচিত) ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই সংস্কৃত কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে; অর্থাৎ, ঈশ্বরচন্দ্রের এই কলেজে ভর্তি হওয়ার মাত্র পাঁচ বছর আগে। তার বয়স তখন নয় বছর। এই কলেজে তার সহপাঠী ছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। বিদ্যাসাগরের আত্মকথা থেকে জানা যায়, মোট সাড়ে তিন বছর তিনি ওই শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন।
ব্যাকরণ পড়ার সময় ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের ইংরেজি শ্রেণিতেও ভর্তি হন ঈশ্বরচন্দ্র। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য মাসিক পাঁচ টাকা হারে বৃত্তি এবং ‘আউট স্টুডেন্ট’ হিসেবে একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ ও আট টাকা পারিতোষিক পান। সংস্কৃত কলেজে মাসিক বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের ‘পে স্টুডেন্ট’ ও অন্য ছাত্রদের ‘আউট স্টুডেন্ট’ বলা হত। অন্যদিকে তিন বছর ব্যাকরণ শ্রেণিতে পঠনপাঠনের পর বারো বছর বয়সে প্রবেশ করেন কাব্য শ্রেণিতে। সে যুগে এই শ্রেণির শিক্ষক ছিলেন বিশিষ্ট পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘পে স্টুডেন্ট’ হিসেবেও ঈশ্বরচন্দ্র ২ টাকা পেয়েছিলেন। ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজি ষষ্ঠশ্রেণির ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্র বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য ৫ টাকা মূল্যের পুস্তক পারিতোষিক হিসেবে পান।
তার এই অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য কলেজ জীবনেই বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেছিলেন তিনি। জনপ্রিয় শিশুপাঠ্য বর্ণপরিচয়, কথামালা, বোধোদয়, আখ্যানমঞ্জরী ব্যাকরণসহ জ্ঞানবিজ্ঞান সংক্রান্ত বহু বইয়ের জনক তিনি।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিজের লেখাপড়াতেই থেমে থাকেননি। শিক্ষার প্রসার লাভের জন্য তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। নারী শিক্ষা উন্নয়নে কলকাতায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেটি বর্তমানে বেথুন স্কুল নামে পরিচিত। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় উচ্চশিক্ষার জন্য মেট্রোপলিটন কলেজে প্রতিষ্ঠা করেন বিদ্যাসাগর। বিশেষ করে নারী শিক্ষার জন্য তিনি সেই সময় প্রায় চল্লিশটিরও বেশি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। বাঙালি সমাজে বিদ্যাসাগর আজও এক প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। পশিম মেদিনীপুরে তার স্মৃতিতে স্থাপিত হয়েছে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যাসাগর। কলকাতার বিদ্যাসাগর সেতু তার নামেই উৎসর্গিত।
লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুলাই তার কলকাতার বাদুড়বাগানস্থ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।