বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে কলঙ্কের ছাপ যেনো ঘোচানোই যাচ্ছে না। গত ২৭ সেপ্টেম্বর দেশের শিক্ষা বিষয়ক একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকমে একটি চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট দেখলাম। তাতে বলা হয়েছে, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে চাকরির আবেদনেরই যোগ্যতা নেই এমন একজনকে চাকরি দিয়ে সম্প্রতি সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। আলোচিত এই শিক্ষকের নাম মো. ইউসুফ। তার নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে উঠেছে প্রশ্ন। নিয়োগের ক্ষেত্রে তাকে অনৈতিক সুবিধা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে তৎকালীন বাছাই ও নিয়োগ বোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। তবে, অভিযুক্ত শিক্ষকের দাবি, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে দেয়া যোগ্যতা অনুযায়ী তিনি নিয়োগ পেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটে থাকলে সেজন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রস্তুতকারীরা দায়ী বলে উল্টো অভিযোগ তুলেছেন তিনি।
মো. ইউসুফের নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মো. গোলাম রব্বানী। গত ১৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্টারসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগও জমা দিয়েছেন তিনি।
২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপকের (স্থায়ী) একটি পদের জন্য যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়; তাতে শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়--এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার যে কোন একটি ন্যূনতম ‘এ’ ( ৫.০০ পয়েন্টভিত্তিক গ্রেড সিস্টেমে সিজিপিএ বা জিপিএ ন্যূনতম ৪.০) থাকতে হবে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, অভিযুক্ত ইউসুফ এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ‘বি’ গ্রেড পেয়েছেন। এর মধ্যে এসএসসির গণিতে ‘সি’ এবং এইচএসসির ইংরেজিতে ‘ডি’ গ্রেড পেয়ে পাস করেছেন টেনেটুনে। স্নাতেক উত্তীর্ণ হয়েছেন দ্বিতীয় শ্রেণিতে। এসএসসি ও এইচএসসির কোনোটিতেই জিপিএ ৪ পাননি ইউসুফ। এই দুই পরীক্ষায় তার জিপিএ যথাক্রমে ৩.৫০ এবং ৩.০১।
অর্থাৎ বিজ্ঞপ্তির শর্তানুযায়ী, ওই পদে আবেদনের যোগ্যতাই ছিলো না মো. ইউসুফের। দুটো বেসিক বিষয়ে তার যে গ্রেড তা পুরো জাতিকে স্তম্ভিত করে! কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া ‘ছেলের হাতের মোয়া নয়’। শিক্ষকতায় তো যাকে তাকে ঢোকানো আর জাতি ধ্বংস করা এক কথা। অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের কম্প্রোমাইজ করতে হয়। কারণ, কঠিন বিষয়ের শিক্ষক পাওয়া যায় না, মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসতে চান না, শিক্ষকতার প্যাকেজও আকর্ষণীয় নয় এসব কারণে। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেবারেই অনুপযুক্ত শিক্ষক কেনো নিয়োগ দেয়া হবে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, যোগ্যতা না থাকলেও সবাইকে ম্যানেজ করে পরীক্ষার জন্য আবেদন এবং ভাইভা পরীক্ষায় অংশ নেন ইউসুফ। নিয়োগও বাগিয়ে নেন। এক্ষেত্রে আদালতকেও ব্যবহার করেছেন তিনি। ইউসুফকে নিয়োগ দিতে কেবল শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রেই নয়, পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়ার পদে পদে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, আইন অনুযায়ী বিভাগের এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষকের সমন্বয়ে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্ল্যানিং কমিটির গঠনের কথা থাকলেও তা না করেই ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া বাছাই বোর্ডের সদস্যরাও যোগ্যতাবিহীন ইউসুফকেই নিয়োগের সুপারিশ করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, একটি পদের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও নিয়োগসংক্রান্ত বাছাই কমিটি ইউসুফ ছাড়া আরো দুজনকে নিয়োগের সুপারিশ করে।
কিন্তু ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ৪ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৬তম সিন্ডিকেট সভায় বাছাই বোর্ডের সুপারিশ পর্যালোচনা করা হয়। সিন্ডিকেট সদস্যরা বাছাই বোর্ডের সুপারিশে বেশ কিছু অসঙ্গতি খুঁজে পান।
প্রথমত, ইতিহাস ও প্রত্নতত্ব বিভাগে অধ্যাপক পদের কোনো অস্তিত্ব নেই। অথচ বাছাই বোর্ড তৃতীয় মনোনীত প্রার্থীকে অধ্যাপক পদের বিপরীতে নিয়োগ দেয়ার সুপারিশ করেছে।
দ্বিতীয়ত, একটি প্রভাষকের পদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশ করে দুজন প্রার্থীকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। তৃতীয়ত, ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বাছাই বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী তিনজন প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দ্বিতীয় প্রার্থী মো. ইউসুফের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ‘বি’ গ্রেড স্নাতক সম্মান পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণি থাকায় নিয়োগের জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হতে পারে না। সিন্ডিকেট সভায় উপস্থিত সব সদস্যের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তক্রমে পদ পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের জন্য সৃষ্ট দুটি প্রভাষকের স্থায়ী পদে বাছাই বোর্ডের সুপারিশকৃত প্রথম ও তৃতীয় প্রার্থী যথাক্রমে মো. মনিরুজ্জামান ও মো. আকতারুল ইসলামকে নিয়োগ দেয়অর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
প্রকাশিত খবরে আমরা জেনেছি, সিন্ডিকেট অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার পরও কৌশল খুঁজতে থাকেন ইউসুফ। সহযোগিতা নেন তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান ইকবাল শাহ রুমি ও তৎকালীন ভিসি প্রফেসর একেএম নুর উন নবী। তাদের সহযোগিতা নিয়ে ইউসুফ অবৈধ উপায়ে বাছাই বোর্ডের সুপারিশসহ তার নিয়োগ সংক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালযের সিদ্ধান্তের গোপন সব নথি সংগ্রহ করে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে হাইকোর্টে রিট করেন। তবে কী কারণে সিন্ডিকেট তাকে অযোগ্য ঘোষণা করেছে সে বিষয়টি চেপে যান। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে আদালত ইউসুফের পক্ষে রায় দেয়। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি ড. নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ ওই রায়ের বিপক্ষে আপিল না করায় ওই বছরই প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান ইউসুফ।
এ বিষয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. গোলাম রব্বানী বলেন, ইউসুফ রিট পিটিশন করলেও কেনো তাকে বাদ দেয়া হয়েছে, তা তিনি আদালতকে অবগত করেননি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এ বিষয়ে আদালতকে অবগত না করায় এক তরফা রায় পান ইউসুফ। যারা এই নিয়োগের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাই আইন অমান্য করেছেন। তাদের বিরুদ্ধেও আইন ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
এ প্রসঙ্গে রংপুর বারের আইনজীবী মুজাহিদুল ইসলাম বুলেট বলেন, ইউসুফের নিয়োগ সুপারিশ সিন্ডিকেট বাতিল করার বিষয়টি চ্যান্সেলরকে না জানিয়ে কৌশলে তৎকালীন ভিসি তাকে (ইউসুফকে) আইনি সুবিধা পেতে সহযোগিতা করেছেন। আবার রায়ের পর আপিল না করার বিষয়টিও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের পরিপন্থি। বিষয়টি পুকুরচুরি। শিক্ষাব্যবস্থাকে এভাবে মেধাহীন ও ধ্বংস করেছে বিগত সরকার।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত শিক্ষক ইউসুফ সাংবাদিকদের বলেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্তাবলীর ‘ঘ’ তে বলা হয়েছে কোনো পরীক্ষায় বি গ্রেড এর নিচে অথবা তৃতীয় বিভাগ/শ্রেণি গ্রহণযোগ্য হবে না। এই অনুযায়ী আমি আবেদনের যোগ্য। সেজন্যই আমাকে বাছাই বোর্ড সুপারিশ করেছে। বিজ্ঞপ্তিতে শর্তাবলী (গ) এর শর্তে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় যেকোন একটিতে ন্যূনতম ‘এ’ এবং জিপিএ ন্যূনতম ৪.০ থাকতে হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা সার্কুলারের দুর্বলতা। এর দায় আমার নয়। তিনি আরও বলেন, বাছাই বোর্ডের সুপারিশ বা সিদ্ধান্ত সিন্ডিকেট বাতিল করতে পারে না। সে কারণে আমি উচচ আদালতের শরনাপন্ন হই। আদালতের আদেশে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছি। আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছে।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত ভিসি ড. শওকত আলী সাংবাদিকদের বলেন, অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত কমিটি করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পুরো ঘটনা বিশ্লেষণ করে আমরা বলতে চাই, একজন পাওয়ারফুল শিক্ষকের পছন্দের একজন শিক্ষার্থীকে তার বিভাগের শিক্ষক বানানো, ভিসি যে প্যানেলের লোক সেই প্যানেলকে ভারী করার জন্য যেনতেন প্রকারের যোগ্যতার লোকদের শিক্ষক বানানো, কে কোন পার্টি করে সেটি দেখে শিক্ষক নিয়োগ বাদ দিতে হবে। আবার একাডেমিক রেজাল্ট খুব ভালো কিন্তু উপস্থাপন দক্ষতা, সামাজিকতা, বাইরের জ্ঞান সীমিত ইত্যাদি বিষয়ও বিবেচনায় নিতে হবে। শুধু ভিসির ইচ্ছায় যেনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ করা না হয়। বে। কারণ, ভিসিরা সেরকম সততার পরিচয় দিতে পারেননি। শিক্ষক নিয়োগ হতে হবে কেন্দ্রীয়ভাবে, যেখানে ফলসহ সবকিছুই নিরপেক্ষভাবে দেখে বিশেষজ্ঞ প্যানেল সুপারিশ করবে।
যে শিক্ষকের কথা আমরা এখানে জানলাম, তিনি কী পড়াবেন, কেনো পড়াবেন, কীভাবে পড়াবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের? জাতি ধ্বংসের এই প্রক্রিয়ায় যুক্তদের আইনের আওতায় আনতে হবে। নতুবা এই অনিয়ম থেকে উচ্চশিক্ষাকে বাঁচানো যাবে না।
লেখক : ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক