অনেকটাই প্রকাশ্যে জঙ্গিবাদ নির্মূলে মাঠে নেমেছে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই (ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স)। যদিও আগে থেকেই দেশের প্রধান এই গোয়েন্দা সংস্থাটি গোপনে অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নানা ইসু্যতে সহায়তা করে আসছে। এবার ডিজিএফআই ওর্ যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) যৌথ অভিযানে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের দাওয়াতি শাখার প্রধানসহ ৬ জন গ্রেফতার হয়েছে।
মঙ্গলবার ঢাকার কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এসব তথ্য জানান বাহিনীটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি আরও জানান, দেশের জঙ্গি সংগঠনগুলো সাংগঠনিকভাবে আগের মতো শক্তিশালী অবস্থায় নেই। বড় ধরনের নাশকতা চালানোর সক্ষমতা নেই। তবে সম্প্রতি জঙ্গিদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে নাশকতা চালানোর অংশ হিসেবে তারা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। যেটি সদ্য নিষিদ্ধ জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার গ্রেফতার হওয়া শতাধিক সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যে কিছুটা আভাস মিলেছে।
র্যাব কর্মকর্তা বলছেন, তারই ধারাবাহিকতায় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই ওর্ র্যাব-১ এর একটি যৌথ দল সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকার উত্তরা, বনানী, বনশ্রী ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় অভিযান চালায়। অভিযানে গ্রেফতার হয় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন 'আনসার আল ইসলাম' এর ঢাকা অঞ্চলের দাওয়াতি শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী ওরফে আবু মাসরুর (৫০), তার সহযোগী শেখ আশিকুর রহমান ওরফে আবু আফিফা (৪৯), সাদী মোহাম্মদ জুলকার নাইন (৩৫), মো. কামরুল হাসান সাব্বির (৪০), মো. মাসুম রানা ওরফে মাসুম বিলস্নাহ (২৬) ও সাঈদ মোহাম্মদ রিজভী (৩৫)। তাদের কাছে পাওয়া গেছে ২টি ল্যাপটপ, ৬টি মোবাইল ফোন, উগ্রবাদ সংক্রান্ত বই, সাংগঠনিক কার্যক্রম সংক্রান্ত ডায়েরি ও নোট বই।
গ্রেফতারদের বরাত দিয়ে র্যাব কর্মকর্তা বলছেন, গ্রেফতাররা আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদার অনুসারী। তারা আফগানিস্তানের তালেবানদের উত্থানে রীতিমতো উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। অনলাইনে বিভিন্ন উগ্রবাদী নেতাদের বক্তব্য দেখেন ও শুনেন। সেই ধারাবাহিকতায় তারা আনসার আল ইসলামের হয়ে দাওয়াতি কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন। পার্শ্ববর্তী দেশে মুসলিমদের উপর নির্যাতনের বিষয়টি সামনে রেখে তারা অনেককেই জঙ্গিবাদের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছিলেন। বাংলাদেশে তারা ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে চান। তারা আত্মীয়-স্বজন, বিভিন্ন মাদ্রাসা ও সদস্যদের কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ সংগ্রহ করতেন। বিভিন্ন মসজিদ, বাসা বাড়িতে তারা গোপন বৈঠক করতেন। তারা পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশের সমমনা ব্যক্তিদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতেন।
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, মেজবাহ একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে ইউরোপের একটি দেশে গিয়েছিলেন। ফিন্যান্স বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরেন। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে গ্রিনকার্ড স্কিমের মাধ্যমে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে সপরিবারে ইউরোপের একটি দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি আশিকের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে দাওয়াতি শাখার প্রধান হিসেবে কাজ করছিলেন। ইউরোপের একটি দেশে থাকার সময় বিভিন্ন দেশের মসুলমানদের উপর নির্যাতনের ভিডিও দেখিয়ে ও ধর্মীয় বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ওইসব দেশে থাকা বাংলাদেশিদের উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করতেন। নতুন সদস্যও সংগ্রহ করেছেন। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে বাংলাদেশে এসে সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম শুরু করেন। পরে তিনি ঢাকা অঞ্চলের দাওয়াতি শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি দেশে ও বিদেশ থেকে সংগঠনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতেন। ঢাকা, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, লক্ষ্ণীপুর, ভোলা ও খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংগঠনিক সফর, সভায় অংশগ্রহণ ও নতুন সদস্য সংগ্রহ এবং চাঁদা আদায়ের কাজটি করতেন।
গ্রেফতার আশিক একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএস সম্পন্ন করেন। তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। পাশাপাশি এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবসাও করতেন। আশিক স্বপরিবারে ইউরোপের একটি দেশে থাকার সময় ওই দেশে থাকা মেজবাহর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন। তিনি সংগঠনটির ঢাকা অঞ্চলের অন্যতম উপদেষ্টা ও অর্থের জোগানদাতা। তার প্রধান কাজই ছিল বিভিন্ন সময় উগ্রবাদী ভিডিও কনটেন্ট সংগঠনের সদস্যদের সরবরাহ করা।
গ্রেফতার জুলকার নাইন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেন। গার্মেন্টস সেক্টরে চাকরি করতেন। তিনি মেজবাহর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন। ঢাকা অঞ্চলের বিভিন্ন দাওয়াতি কার্যক্রমের পাশাপাশি সংগঠনের নতুন সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিতেন। কামরুল হাসান সাব্বির একটি পাবলিক ইউনিভার্সিটি থেকে আইটিতে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেন। একটি আইটি ফার্মে কর্মরত। তিনি গ্রেফতার আশিকের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন। তিনি উগ্রবাদী পুস্তুক ও কনটেন্ট সংগ্রহ করে এডিট করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতেন। গ্রেফতার সাঈদ একজন চিকিৎসক। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে থাকার সময় জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেজবাহর সঙ্গে পরিচয়। দুই মাস পর পর তারা গোপন বৈঠক করতেন। নতুন সদস্যদের শারীরিক কসরতের প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি। গ্রেফতার মাসুম রানা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে পড়ছেন। তিনি জুলকার নাইনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন। দাওয়াতি কার্যক্রম ও অর্থ সংগ্রহ করাই ছিল তার প্রধান কাজ।