জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আর যাই ঘটুক শিক্ষা খাতের সর্বোচ্চ পদ উপাচার্য নিয়োগে কোনো প্রকার আমলাতান্ত্রিক অসুস্থ চর্চা যেনো না হয়। দেশের একমাত্র বিশেষায়িত স্বায়ত্তশাসিত চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়তে (সিভাসু) উপাচার্য নিয়োগের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা প্রসঙ্গে কথাটি বলা। সিভাসু বাংলাদেশের একটি বিশেষায়িত পাবলিক ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের অধীনে দক্ষ ও যুগোপযোগী ভেটেরিনারিয়ান (প্রাণিচিকিৎসক) তৈরির লক্ষ্যে ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র পঞ্চাশ জন শিক্ষার্থী নিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রাম সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ। পরবর্তীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রণীত এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের ৭ আগস্ট ‘সিভাসুতে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শুধুমাত্র ‘ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদ’ ছিলো। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে নতুন অনুষদ হিসেবে ফুড সায়েন্স টেকনোলজি অনুষদ যুক্ত করা হয় এবং বর্তমান সিভাসুতে একাডেমিক অনুষদের সংখ্যা চার। অন্য দুটির নাম ‘মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ’ এবং ‘বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদ’। গত ২৮ বছরের অগ্রযাত্রায় একক শিক্ষারপ্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং শিক্ষা ও গবেষণা অঙ্গনে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম আমার জানা নেই।
২০১০ খ্রিষ্টাব্দে আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই এবং নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে ডিভিএম বিষয়ে স্নাতক এবং ভেটেরিনারি মেডিসিনে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করি। ২০১০-২০২৪ সময়কার রাজনীতি সচেতন নাগরিক এবং একজন পেশাজীবি হিসেবে বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম অপারেশনাল প্ল্যানে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছি। বলা বাহুল্য আমার বিশ্ববিদ্যালয়টি ‘সিভাসু আইন, ২০০৬’ অনুযায়ী পরিচালিত হয় এবং অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষ গবেষক, শিক্ষক, কর্মকর্তা, ভেটেরিনারি চিকিৎসক তৈরির নিদর্শন রেখে চলছে এবং এই আইনের ধারা ৭ অনুযায়ী ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন’ অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক কার্যক্রম এবং ব্যবস্থাপনা মনিটরিং করে থাকে। সর্বশেষ উপাচার্য প্রফেসর ড. লুৎফুল আহসান ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালমনাই। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি তিনি মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক চার বছরের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হন। কিন্তু উদ্ভূত রাজনৈতিক বৈপ্লবিক পটে মাত্র ১ বছর ৯ মাস পর তাকে দায়িত্বশীল উপাচার্য পদ থেকে গত ১৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। তদপ্রেক্ষিতে উপাচার্য পদটি শূন্য থাকায় ট্রেজারার কর্তৃক অত্র বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালিত হতে থাকে এবং শূন্যপদে জ্যেষ্ঠতম অধ্যাপককে উপাচার্য হিসেবে স্থাপন করা আইনত আবশ্যক হয়ে উঠে।
এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কে হচ্ছেন তা নিয়ে টানা দুই মাস বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেন। সামগ্রিক বাধাগ্রস্ত কার্যক্রমকে স্বাভাবিক করতে শূন্যপদে উপাচার্য নিয়োগের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে জ্যেষ্ঠতম অধ্যাপক হিসেবে মোট ২৪ জন শিক্ষককে তালিকাভুক্ত করা হয়। উল্লিখিত এই সময়ে সিভাসুর বয়োজ্যেষ্ঠ উপযুক্ত প্রফেসরদের নিয়ে গণমাধ্যমে এবং সমাজমাধ্যমে নানা মত-অভিমত আলোচনায় আসে। সকল কল্পনা জল্পনা উপেক্ষা করে গত ১৭ অক্টোবর মোহাম্মদ লুৎফুর রহমান কে প্রজ্ঞাপন করা হয়। তালিকাভুক্ত শিক্ষকদের ক্রমে তার অবস্থান ১৪তম। তার বেতন গ্রেড-২ এবং তার ওপরের ১৩ জন শিক্ষকের মধ্যে ১২ জন গ্রেড-১ ভুক্ত অধ্যাপক।
মোহাম্মদ লুৎফর রহমান আমার সরাসরি শিক্ষক। এই অভিজ্ঞতায় তার পাঠদান অভিজ্ঞতা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং শিক্ষার্থীবান্ধবতা সম্পর্কে আমি খুব ভালোভাবে অবগত আছি। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে চট্টগ্রাম সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ করার প্রাক্কালে সংযুক্তিতে এসে প্রভাষক হয়ে যাওয়া অ্যানাটমি বিভাগের এই শিক্ষক এই বিষয়ে মাত্র ৩২ নম্বর পেয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে ৮ নম্বর গ্রেস নিয়ে তাকে পাস করানো হয়। অর্থাৎ উনার শিক্ষাগত যোগ্যতা, শিক্ষকতার ইতিহাস ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বর, শিক্ষার্থীবান্দব গ্রহণযোগ্যতা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা তালিকাভুক্ত অন্য শিক্ষকদের তুলনায় অত্যন্ত গৌণ। এতদ সত্ত্বেও মোহাম্মদ লুৎফুর রহমানকে উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ‘চাঁদে সাঈদীকে দেখা যাওয়ার’ রাজনৈতিক প্রপাগাণ্ডা আমি আমার জীবনে পরিলক্ষিত করেছি। কিন্তু এতো সুদক্ষভাবে একজন ১৪তম ক্রমের শিক্ষককে কোন জাদুবলে প্রজ্ঞাপন দেয়া হলো আমার মতো সব অ্যালামনাই ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের কাছে এক বড় প্রশ্ন। এই অভূতপূর্ব প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগের কারণে সিভাসুর ভবিষ্যৎসহ অর্জিত সব সুনাম এবং গ্রহণযোগ্যতা আজ হুমকীর সম্মুখীন। ফলে সিভাসুর সব শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মচারী সর্বমহল এখন ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন।
পেশাগত অবস্থান, রাজনৈতিক সচেতনতা এবং জাগ্রত দেশপ্রেমের কাছে আমি নিজের প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছি। মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার রক্তে অর্জিত চব্বিশ গণ-বিপ্লব পরবর্তী দেশে কেনো শিক্ষা খাতের সর্বোচ্চ আসনে বেসিক পলিসি মানা হবে না? কেনো গ্রেড-১ অধ্যাপককে এই পদে নিয়োগ দেয়া হবে না? কেনো ‘উপাচার্য’ পদের মতো সংবেদনশীল এবং জনগুরুত্বপূর্ণ পদে এই রকম অস্পষ্ট নিয়োগদানের আইনগত ভিত্তিই বা কী? উদ্ভুত সময়ে দেশের সব আমলাতান্ত্রিক অসুস্থ রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে রাখা একমাত্র খাত হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছাড়া অন্য কিছু চোখে পড়ছে না। এই সমানে লিখে চলছি সুস্থ পলিসির কথা। উপাচার্য নিয়োগের সুস্থ পলিসি গ্রেড-১ অধ্যাপক নিয়োগ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প জানা নেই।
মোহাম্মদ লুৎফুর রহমান কিংবা অন্যান্য উপাচার্য নিয়োগ প্রজ্ঞাপনে যে উপ-সচিবের স্বাক্ষর থাকেন, তার গ্রেডও ওয়ান হওয়া চাই। আমি ব্যক্তিগত কৌতূহল এবং জানার ইচ্ছা থেকে বাংলাদেশ সচিবালয় (পড়ুন আমলাতন্ত্রের আয়নাঘর) এর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সচিবের কাছে নিজে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছি। উনি নির্বিকার ছিলেন। আমলাতন্ত্রের আয়নাঘরের এক একটা চেয়ারে আসীন ব্যক্তিরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চালিত গণতন্ত্রকে এখনো ঈশ্বর কিংবা ভগবান করে রেখেছেন। চব্বিশ গণ-আন্দোলন পরবর্তী দেশে বাংলাদেশের গণতন্ত্র কখনো ঈশ্বর কিংবা ভগবান হতে পারে না। গণতন্ত্র উপযুক্ত জবাবদিহিতা এবং আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠা। প্রতিমন্ত্রী সমান ‘উপাচার্য’ পদে অযোগ্যতায় প্রজ্ঞাপিত সিদ্ধান্তকে পুনর্বিবেচনা করে বেসিক পলিসি হিসেবে বেতন গ্রেড-১ ভুক্ত অধ্যাপকদের এই পদে অধিষ্ঠ করতেই হবে। অন্যথায় ‘সত্যে তথ্যে’ গ্রহণযোগ্যতার কোনো মানে হয় না।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, আন্তর্জাতিক ভেটেরিনারি স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ, সিভাসু