ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ, যুক্তরাজ্যের রিডিং ইউনিভার্সিটিতে উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক (ভিজিটিং)। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি অর্জন করেন। তিনি মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়া (২০১৪-২২) ও মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে (২০২২-২৪) অধ্যাপনা করেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস (বিইউএইচএস) এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারি প্রফেসরিয়াল ফেলো। এছাড়া অধ্যাপনার বাইরে তিনি গ্লোবাল লেবার অর্গানাইজেশনের (জিএলও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ক্লাস্টার পরিচালনা করছেন। ২০২৪ গণ-অভ্যুত্থান ও পূর্বাপর বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবিদিন ইব্রাহিম
বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ইভেন্টকে কেউ ‘গণ-অভ্যুত্থান’, ‘বিপ্লব’ আবার কেউবা ‘গণবিদ্রোহ’ বলছেন। আপনি কীভাবে এটাকে ডিফাইন করবেন?
আমি একে তৃণমূল পর্যায়ে তারুণ্যের বিপ্লব হিসেবে দেখি। গণ-অভ্যুত্থানের মতো এ আন্দোলনে কর্তৃত্ববাদ শাসনের বিরুদ্ধে জনসাধারণের বৃহত্তর অংশের স্বতঃস্ফূর্ততা থাকলেও এটি ঠিক হঠাৎ করে শুরু হয়নি। আবার একে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানের কাতারে ফেললেও ভুল হবে।| ২০২৪ গণ-অভ্যুত্থান কেবল তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের সীমিত উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, যদিও দুই ক্ষেত্রেই দুই স্বৈরশাসকের পতন ঘটে এবং আর্থসামাজিক পরিস্থিতির সাপেক্ষে ব্যাপক অসন্তোষ ছিল। লক্ষ্য গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণ হলেও এটি একই সঙ্গে ছিল সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির একটি সংগ্রাম। ১৯৯০-এর তুলনায় ২০২৪—সরকার পরিবর্তন প্রক্রিয়া অনেক সংগঠিত, যেখানে আদর্শগত এবং দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক পরিবর্তনের দুটি প্রত্যাশা একসঙ্গে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটেও এটা অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে মালয়েশিয়ার ৬২ বছরের একদলীয় শাসনের অবসান ঘটায়। সাধারণ নাগরিকগোষ্ঠী একটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ‘বারসিহ’ আন্দোলনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ চালিয়ে এবং কোনো প্রাণহানি ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী নাজিবের পতন ঘটায়। সেই তুলনায় আমাদের গণবিপ্লবটি অনেক ভিন্ন, কেননা এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অরাজনৈতিক শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ছিল মুখ্য। আরেকটা ব্যতিক্রম হলো ব্যাপক প্রাণহানি ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতা উপেক্ষা করে বিজয় অর্জন। রক্তাক্ত জুলাইয়ের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ না থাকা সত্ত্বেও রক্ত দিয়েছে ছাত্রসমাজ। টেকসই এবং গুণগত সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য তরুণদের আত্মোৎসর্গ—এটি নিঃসন্দেহে একটি বিপ্লব।
আপনি জুলাইয়ের মাঝামাঝিতেই ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনকে ‘আরব বসন্তের’ সঙ্গে তুলনা করেছিলেন এবং বেশ আশাবাদী কথা লিখেছিলেন। আরব বসন্তের ভুল থেকে কি শিক্ষা নেয়া যেতে পারে?
আরব বসন্তের ব্যর্থতার একটি অন্যতম কারণ ছিল তরুণ নেতৃত্বের শূন্যতা—স্বৈরশাসন অবসানের পর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তরুণদের কার্যকর রাজনৈতিক ভূমিকা পালনের কোনো সুযোগ ছিল না। গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণ প্রক্রিয়াটি টেকসই করতে যোগ্য এবং নিরপেক্ষ টেকনোক্র্যাট জনগোষ্ঠীর অভাব ছিল। এ রকম প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার ঘাটতির প্রেক্ষাপটে তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের ফলে মিসরে গণতন্ত্র টেকসই হয়নি। ভোটে নির্বাচিত মুরসিকে উৎখাত করে ক্ষমতা আবার চলে যায় সামরিক বাহিনীর হাতে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা আশাবাদী। আমাদের তরুণরা কেবল শাসককে উৎখাত করেই থেমে থাকেনি, বরং তারা তাদের পূর্ণ রাজনৈতিক ক্ষমতা (পলিটিক্যাল এজেন্সি) প্রয়োগ করেছে। সামরিক বাহিনীপ্রধানের পছন্দ উপেক্ষা করে প্রফেসর ইউনূসকে বেছে নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হিসেবে।
ছাত্রদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া এ আন্দোলনে বিভিন্ন স্তরের মানুষ একে একে যুক্ত হয়। আন্দোলনের এ সর্বজনীন রূপ নেয়ার কারণ কী?
দীর্ঘদিনের কর্তৃত্ববাদী শাসন এবং রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থার রাজনীতিকরণের ফলে আমাদের সমাজে ব্যাপক মেরুকরণ এবং বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল। জনসাধারণের মধ্যে স্বতঃপ্রণোদিত ও সংঘবদ্ধ হয়ে এবং ঐক্যের ভিত্তি নাগরিক অধিকার লড়াইয়ের আত্মবিশ্বাস অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছিল। ছাত্রদের অরাজনৈতিক নেতৃত্বে এবং আত্মত্যাগের আন্দোলনটি সর্বস্তরে মানুষের মধ্যে অসাম্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনে। ভিন্ন ভিন্ন বলয়ের, মত-পথের তরুণ-তরুণীরা যখন সামাজিক অধিকার ও বাকস্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে অগ্রসর হচ্ছিল তখন তাতে ধীরে ধীরে যুক্ত হতে থাকে অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত ও সামাজিকভাবে অবহেলিত সর্বস্তরের জনতা।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে অনেকেই প্রতিবিপ্লব ও বড় আকারের বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করেছিলেন। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে বলা যায়। সড়কে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ছাত্রছাত্রীরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে, সড়ক দুর্ঘটনা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ছিল কম। তারুণ্যের এ সক্ষমতাকে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
সরকারবিহীন দিনগুলোয় স্থিতিশীলতা এবং নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে আমাদের তরুণরা শৃঙ্খলা ও দায়িত্বশীলতার একটি অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। তারা শুধু প্রতিবাদীই নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে এবং সামাজিক পুনর্গঠনে নেতৃত্ব দিতেও বদ্ধপরিকর। তাদের এ সামর্থ্য, আত্মবিশ্বাস এবং সক্রিয়তা আমাদের আশ্বস্ত করছে যে ভবিষ্যতে তারা আমাদের দেশকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারবে।
নতুন প্রজন্মের হাত ধরে তৃতীয় ধারার রাজনীতির বিকাশের কোনো সুযোগ দেখছেন কি? বাইনারি রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসতে পারে কি?
হ্যাঁ, আমি মনে করি তৃতীয় ধারার রাজনীতির বিকাশের সুযোগ রয়েছে। নতুন প্রজন্মের চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন এবং তারা পুরনো বাইনারি রাজনীতি থেকে সরে আসতে প্রস্তুত। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া টেকসই করতে প্রয়োজন বাড়তি ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’"প্রক্রিয়া এবং প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি। তরুণরা যদি সমন্বিত ও সাংগঠনিকভাবে এগিয়ে যায়, তবে একটি নতুন ধারা সৃষ্টি হতে পারে যা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে পারে।
উপদেষ্টাদের মধ্যে দুজন তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
এটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তারুণ্যের ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ। উপদেষ্টা হিসেবে তাদের যুক্ততা এটাই প্রমাণ করে যে আমাদের সমাজের অভিজাত শ্রেণী তরুণ নেতৃত্বকে যোগ্য মনে করছে। আগামী দিনগুলোয় রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে এবং তাতে তরুণদের আরো প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকবে। কিন্তু সামনের দিনগুলোয় ‘যেকোনো মূল্যে ক্ষমতার মসনদে বসা’ এমন মনোভাব পরিহার করতে হবে তরুণদের। ভুললে চলবে না যে তারুণ্যের ক্ষমতায়ন বল প্রয়োগের অপসংস্কৃতি চর্চার কোনো লাইসেন্স নয়। সাম্প্রতিক সময়ে এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে সচিবালয়ে বিশৃঙ্খলার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। সামাজিক বিপ্লব যদিও একটা চলমান প্রক্রিয়া, শিক্ষা এবং প্রশাসন ব্যবস্থাকে অবজ্ঞা করা হলে ছাত্রছাত্রীর নেতৃত্ব প্রশ্নের মুখে পড়বে। বরং ক্ষমতা কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে এবং বিভিন্ন ভূমিকায় (যেমন ওয়াচডগ) কীভাবে তরুণদের দীর্ঘমেয়াদি উপস্থিতি নিশ্চিত হতে পারে, সে বিষয়ে মনোনিবেশ করা উচিত।
পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার ছেলের তৎপরতা কীভাবে দেখছেন? শেখ পরিবারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন দিকে?
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার ছেলে এখনো একরকম বিভ্রান্তির মধ্যে আছেন। ক্ষমতা হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। নিজেদের ভুল স্বীকার না করে তরুণদের অর্জিত দ্বিতীয় স্বাধীনতা বিনষ্ট করার প্রচষ্টায় ব্যস্ত। ৫ আগস্ট-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের বিষয়ে ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাদের বানোয়াট, বিভ্ৰান্তকর, দেশবিরোধী ও উসকানিমূলক বক্তব্যের উদ্দেশ্য একটাই—বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করা। কিন্তু ভারতের মাটিতে বসে এ রকম বক্তব্যের মাধ্যমে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার ছেলে আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে শেখ পরিবারের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতাকে আরো প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড আত্মঘাতী ও স্ববিরোধী, কেননা এতে জনগণের মধ্যে তরুণ নেতৃত্বে বিকল্প ধারার রাজনীতির গ্রহণযোগ্যতা আরো বাড়বে। পাশাপাশি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে দ্বিমুখী সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপ, ভারতীয় গণমাধ্যমে মিথ্যাচার কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
ভারতের হাসিনাপন্থী অপপ্রচার এবং তথ্যবিভ্রাট একটি গুরুতর সমস্যা, যদিও এটা নতুন নয়। প্রতিবেশী দেশ এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা, দায়িত্বশীল এবং বন্ধুসুলভ ব্যবহার ও নীতি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও এ প্রত্যাশা কেবল অপূর্ণই থাকেনি, আমাদের জনগণের মধ্যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ওপর আস্থার ব্যাপক অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত সরকারের হস্তক্ষেপ এবং গণমাধ্যমের মিথ্যাচার দুই দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্কের সংকটকে আরো প্রকট করবে। আমাদের একটি সফল বিপ্লব ভারতের অস্বীকার করা এবং আন্তর্জাতিকভাবে এটাকে বৈদেশিক চক্রান্ত"এবং উগ্রপন্থীদের উত্থান আখ্যা দেয়া অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত। নাক গলানো পররাষ্ট্রনীতি ও সংস্কৃতির ফলে আজ দক্ষিণ এশিয়ায় মোদি সরকার জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। সময় এসেছে ভারতীয় বিশ্লেষক ও গণমাধ্যম কর্মীদের এ বাস্তবতা স্বীকার করে তাদের বাংলাদেশমুখী নীতি এবং মানসিকতার দ্রুত পরিবর্তনের। এর প্রথম পদক্ষেপ হবে শেখ হাসিনার পতনকে মেনে নেয়া এবং আমাদের তরুণ সমাজের আন্দোলন ও রক্তাক্ত অর্জনকে স্বীকৃতি দেয়া।
সূত্র: বণিক বার্তা