দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক: একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে অনৈতিক প্রস্তাবের অভিযোগ উঠেছে ল্যাব সহকারী রবিউল ইসলামের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া পরীক্ষার ফলাফলের ভয়ভীতি দেখিয়ে একাধিক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি, শিক্ষক না হয়েও নিয়মিত পাঠদান, স্কুলের বই কোচিংয়ে সংরক্ষণ, ভালো ফলাফলের লোভ দেখিয়ে নিজ কোচিংয়ে ভর্তি, ছাত্রীদের দিয়ে গৃহস্থালির কাজ করানোসহ একাধিক অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রবিউল ইসলাম।
রবিউল ইসলাম জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার মোলামগাড়ীহাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ল্যাব সহকারী। তিনি উপজেলার জিন্দারপুর ইউনিয়নের কাদিরপুর গ্রামের বাসিন্দা।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন চাকরির সুবাদে ওই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীকে বাল্যবিয়ে করেন। কিছুদিন পরে নবম শ্রেণির আরেক ছাত্রীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক করে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সম্প্রতি আবারও দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
ওই ছাত্রীর মা বলেন, বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিয়েছি যাতে আমার মেয়ে নিরাপদে থাকে। কিন্তু সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষকই আমার মেয়েকে অনৈতিক প্রস্তাব দেয়। এ রকম অনেক মেয়েকেই তিনি অনৈতিক প্রস্তাব দিয়েছেন। আমার মেয়ের ঘটনার কথা প্রথমে অন্য মেয়েরা বললেও সামনে পরীক্ষা হওয়ায় ভয়ে এখন আর কেউ স্বীকার করতে চাচ্ছে না। রবিউল তাদের ফোন দিয়ে ভয় দেখিয়েছে। সাক্ষীর অভাবে তো আমরা আর বিচার পাব না। এ জন্য আর কাউকে কোনো অভিযোগ দিব না।
তিনি বলেন, মেয়েকে ওই স্কুলে পাঠাব না। পরীক্ষাও দিতে দিব না। স্কুল থেকে সব মেয়েদের বলেছে কেউ যেন আমার মেয়ের সঙ্গে কথা না বলে। বললে তাদের পরীক্ষায় খবর আছে। এসব কারণে আমার মেয়ে মন খারাপ করে আছে। ওই স্কুলের শিক্ষকরাও তার পক্ষ নেয়। প্রধান শিক্ষকের কাছে অভিযোগ করলে তিনি আমাদের বলে তোমরা টিসি নিয়ে যাও।
ছাত্রীর বাবা বলেন, গ্রামের পাশেই স্কুল হওয়ায় মেয়েকে ওই স্কুলে পড়াশোনা করাচ্ছি। আজকে আমার মেয়েকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছে। কালকে অন্যের মেয়েকেও করবে। ওই স্কুলে আমার মেয়েকে আর পড়াব না। আমার মেয়েকে অন্য স্কুলে ভর্তি করাব। বিচার চাইতে গেলে তো সাক্ষীর প্রয়োজন হয়। প্রথমে অন্যান্যরা সাক্ষী দিতে চাইলেও পরে আর কেউ সাক্ষী দিতে চায় না। আমরা গরিব মানুষ যা হওয়ার হয়ে গেছে, মেয়েকে তো বিয়ে দিতে হবে।
স্কুলের আরেক ছাত্রীর মা বলেন, আমার মেয়ে ওই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। রবিউল মাস্টার যেহেতু এক এক করে দুজন ছাত্রীকে বিয়ে করেছে। আবার তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ছাত্রীকে কুপ্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আমার মেয়ে এসব জেনে ভয়ে আর স্কুলে যাচ্ছে না। আমি চিন্তাভাবনা করেছি মেয়েকে আর ওই স্কুলে পড়াশোনা করাব না। আমি হেডমাস্টারকে বলেছি, আমার মেয়েকে যেন তাড়াতাড়ি টিসি দেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শিক্ষক বলেন, রবিউল স্কুলের ল্যাব সহকারী। দীর্ঘদিন থেকে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। হেডমাস্টার তাকে দিয়ে নবম ও দশম শ্রেণির ক্লাস নেন, যা মোটেও ঠিক নয়।মাঝেমধ্যেই তার বিরুদ্ধে ছাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক করার অভিযোগ ওঠে। এ স্কুলের দুজন ছাত্রীকে তিনি বিয়েও করেছেন, যা অত্যন্ত লজ্জাজনক। এবার নাকি এক ছাত্রীকে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়েছে। প্রধান শিক্ষকের নিকটাত্মীয় হওয়ায় রবিউল এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তদন্ত করে এর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। নাহলে প্রতিষ্ঠানটি নষ্ট হয়ে যাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নবম-দশম শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী বলেন, তিনি আমাদের শিক্ষক না হয়েও নিয়মিত আমাদের ক্লাস নেন। আমাদের ক্লাসের কমবেশি সব মেয়েরাই স্যারের হেনস্তার শিকার। পরীক্ষার ফলাফলের ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারে না। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই। তিনি সবসময় আমাদের বলেন, তার বোর্ডে হাত আছে। তিনি চাইলেই যে কাউকে পাস বা ফেল করে দিতে পারেন। পরীক্ষার হলেও তিনি অনৈতিক সহযোগিতা করতে পারেন।
স্থানীয়দের দাবি, প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এসব ঘটনা ঘটছে। নবম ও দশম শ্রেণিরর বোর্ড বইগুলো কীভাবে রবিউলের হতে গেল। এসব প্রধান শিক্ষকের যোগসাজশে করা হয়েছে। ছাত্রীদের হয়রানিরসহ সকল বিষয় সঠিক তদন্ত করলে অনিয়ম বেরিয়ে আসবে।
রবিউল ইসলাম অভিযোগ বলেন, আমি ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট চাকরির পাশাপাশি বাজারে একটি কোচিং চালাই। সেখানে প্রায় ১২০ জন ছাত্রছাত্রী পড়ে। আমি যদি খারাপ হতাম তাহলে আমার কাছে এত শিক্ষার্থী পড়তে আসত না। প্রথমে আমি বাল্যবিয়ে করেছিলাম। সেটা আমার ভুল হয়েছিল। তবে আমার প্রথম স্ত্রীকে বিয়ের পরে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। আর দ্বিতীয় স্ত্রীকে যখন বিয়ে করি তখন সে ইন্টারে পড়ত।
তিনি বলেন, আমি ল্যাব সহকারী পদে চাকরি করি। আমার ক্লাস নেওয়ার নিয়ম নাই। প্রধান শিক্ষকের অনুরোধে আমি ক্লাস নিয়েছি। কিন্তু ওই ছাত্রীর পরিবার মিথ্যা অভিযোগ করে আমাকে হেনস্তা করেছে। আমি দুঃখে আত্মহত্যা করতে গেছিলাম। আমার ১৫ বছরের ক্যারিয়ারে এমন কখনো হয়নি। আপনারা তদন্ত করে দেখতে পারেন।
প্রধান শিক্ষক মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, ওই শিক্ষার্থীসহ তার বাবা-মা আমার কাছে মৌখিক অভিযোগ করেছিল। আমি ওনাদেরকে লিখিত অভিযোগ করতে বলেছিলাম। তারা লিখিত অভিযোগ করেনি। এমন কোনো নিয়ম নেই যে ল্যাব সহকারী ক্লাস নিতে পারবে না। কারিগরি শিক্ষক না থাকায় তাকে দিয়ে ক্লাস করানো হয়েছে। আর তার প্রথম বউ বিয়ের পরে এখানে ভর্তি হয়েছিল এবং দ্বিতীয় বউ স্কুল থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর বিয়ে করেছে।
তিনি বলেন, এ ছাড়া প্রতিষ্ঠান খুললে আমরা একটি তদন্ত কমিটি করব। তদন্ত করে দোষী প্রমাণিত হলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হবে। কোচিং সেন্টারে বই রাখার ব্যাপারে তিনি বলেন, বই তো সে সেখানে রাখতে পারে না।
কালাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল হায়াত বলেন, এ অভিযোগটি কোনো এক মাধ্যমে আমাদের কাছে এসেছে। আমরা তদন্ত শুরু করেছি৷ তদন্ত শেষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।