এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় কমিটি এখন শিক্ষক-কর্মচারীদের গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে। এক সময় এলাকার শিক্ষানুরাগীরা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন এলাকার শিশুদের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়ানোর জন্য। পরবর্তীতে সেইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নিশ্চিত করার জন্য পরিচালনা কমিটি গঠন করা হতো।
বর্তমানে জেলায় আট শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিগত সময়ে এর মধ্যে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের হেনস্তা করার তথ্য জানা যায়। পরিচালনা কমিটির নামে এটি এখন কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্তদের আয়ের অন্যতম উৎস হয়ে উঠেছে।
জানা গেছে, গত বছর জেলার রাণীনগর উপজেলার আল আমিন দাখিল মাদরাসার সহকারী শিক্ষক (শরীর চর্চা) হারুনুর রশীদকে বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির মিথ্যে অভিযোগে সাময়িক বহিষ্কারসহ বেতন-ভাতা বন্ধ করে দেয়া হয়। আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে তিনি মাদরাসায় যোগদান করেন। এরপর আবারও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে সাময়িক বরখাস্ত করেন পরিচালনা কমিটি। এ কারণে গত ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জুন তিনি আত্মহত্যা করেন।
প্রবিধানমালা অনুযায়ী ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডির ১৬টি দায়িত্ব পালনে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এসব দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে, প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি, ভবন, খেলার মাঠ, বই, ল্যাবরেটরি, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের ব্যবস্থা করা। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ পরিচালনা পর্ষদই এসব কাজের একটিও করে না বরং প্রতিষ্ঠান থেকে ভুয়া বিল ভাউচার দিয়ে বিভিন্ন নামে টাকা লুটপাট করে তহবিল শূন্য করার বহু উদাহরণ রয়েছে।
বর্তমানে সহকারী শিক্ষক ও প্রভাষক নিয়োগের ক্ষমতা বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষকে (এনটিআরসিএ) দেয়া হলেও প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ ও কর্মচারী পদে আগের মতোই বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে এসএমসি ও জিবির বিরুদ্ধে। তারা কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা পর্যন্ত নিতে পারেন না কেউ।
ম্যানেজিং কমিটির রোষানলের স্বীকার ধামইরহাট উপজেলার লক্ষণপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমার বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর গত ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১২ নভেম্বর আমার বিদ্যালয়ের তৎকালীন সভাপতি আমিনুল হক আমাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে প্রধান শিক্ষক পদে আবেদন করতে বলেন। তখন আমি একজন সিনিয়র শিক্ষককে দায়িত্ব বুঝে দিই। এরপর ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাস থেকে আমার ওপর নির্যাতন চালাতে থাকে।
সাপাহারের খঞ্জনপুর তালকুড়া আলিম মাদরাসার সহকারী অধ্যাপক মো. আব্দুল হালিম দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সুষ্ঠভাবে পরিচালনার জন্য ম্যানেজিং কমিটি/গভর্নিংবডি প্রথা চালু হলেও বর্তমানে এ প্রথা গলার কাঁটা ও অত্যারের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি/গভর্নিং বডি নামক যন্ত্রের অত্যাচার ও হয়রানির শিকার লাখো শিক্ষক। এই প্রথা বিলুপ্ত করা এখন সময়ের দাবি।
এ বিষয়ে জেলা শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল গফুর বলেন, এক সময় স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিগণের আর্থিক ও কায়িক পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে গড়ে তোলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি ছিলো প্রকৃত অর্থে উদার ও শিক্ষা বিস্তারের চালিকা শক্তি। কালের বিবর্তনে সেই ম্যানেজিং কমিটি বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক দলের আশির্বাদ পুষ্ট দলীয় অনুগত ব্যক্তিবর্গের উচ্চাভিলাস চরিতার্থের ক্ষেত্র ভূমিতে পরিণত হয়েছে।
বিদ্যালয় সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে দক্ষ ও মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আর্কষণীয়ভাবে অনুপ্রবেশে ম্যানেজিং কমিটি প্রথা বিলুপ্ত করে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আদলে পরিচালনা কমিটি সময়ের দাবি বলেও মনে করেন অনেকে।