দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক: ছেলের লাশ নিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের সামনে বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে অপেক্ষা করছিলেন খতনা করাতে গিয়ে মারা যাওয়া তাহমিদের বাবা ফখরুল আলম। সন্তানহারা বাবার চোখের কোণ গলিয়ে কখনও নীরবে অশ্রু ঝরছিল তো কখনও করছিলেন বুকফাটা আর্তনাদ।
সে সময় তিনি বলছিলেন, ‘হাসপাতালে নেওয়ার আগে আমার বাচ্চাটা প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিল। বলছিল– বাবা, তুমি তো আমার পাশেই থাকবে। এর পর যখন অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয় তখন বলছিল– বাবা, আমার সাহস আছে, তুমি টেনশন করো না।’
ছেলের সঙ্গে কথোপকথনের স্মৃতিচারণ করে ফখরুল বলছিলেন, বাবাকে নির্ভয় দেওয়া ছেলেটাকে এভাবে মেরে ফেলা হলো! অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগেই হাত নেড়ে বিদায় নিয়েছিল তাহমিদ। কে জানত– এটাই সন্তানের শেষ বিদায়! ১০ বছর ওর সবকিছু আমি করতাম। স্কুলে আনা-নেওয়া করতাম।
খতনা করাতে গিয়ে মঙ্গলবার মালিবাগের জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে মারা যায় ১০ বছরের শিশু আহনাফ তাহমিদ আয়হাম।
ওই ঘটনায় শিশুটির বাবা বাদী হয়ে হাতিরঝিল থানায় মামলা করেছেন। এজাহারে তিনজনের নাম উল্লেখ করে আরও চারজন ডাক্তার ও নার্সকে অজ্ঞাত আসামি করেছেন। আসামিরা হলেন– জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারের (এটি জে এস হাসপাতাল নামে পরিচিত) পরিচালক এসএম মোক্তাদির হোসেন, মাহবুব মোরশেদ ও ইশতিয়াক আজাদ। তাদের মধ্যে মোক্তাদির ও মাহবুবকে গ্রেপ্তার করেছে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। আত্মগোপনে রয়েছেন ইশতিয়াক।
জানা যায়, তাহমিদকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার পর তার মা-বাবাকে জানানো হয়, ২০-২৫ মিনিট সময় লাগবে। আধা ঘণ্টার বেশি পার হলে অপারেশন থিয়েটারের দরজা নক করলে বলা হয়, আর অল্প কিছু সময় লাগবে। এভাবে এক ঘণ্টা পার হয়ে যায়। তখন ফখরুল ভেতরে ঢুকতে চাইলে বলা হয়, আর একটু সময় অপেক্ষা করুন। এর পর সন্দেহ হলে জোর করেই অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে যান ফখরুল। দেখেন, ছেলে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। নাক ও মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। চিকিৎসকরা বুকে হাত দিয়ে চাপাচাপি করছেন। এ সময় চিকিৎসক মোক্তাদিরের কাছে জানতে চাইলে তিনি সঠিক উত্তর দেননি। অন্য হাসপাতালে পরিবারের সদস্যরা নিতে চাইলেও কর্ণপাত করেননি চিকিৎসক। এক পর্যায়ে তাহমিদের বাবাকে জোর করে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে দেওয়া হয়।
এর আগে, মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাত ৮টার দিকে মালিবাগ চৌধুরীপাড়া এলাকার জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে খতনা করাতে নেওয়া হয় তাহমিদকে। অভিযোগ উঠেছে– সেখানে অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করে খতনা করাতে গেলে মারা যায় শিশুটি।
তাহমিদের মৃত্যুর ঘটনায় তার বাবার করা মামলায় দুই চিকিৎসক মোক্তাদির হোসেন ও মাহবুব মোর্শেদকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। এতে উঠে আসে– দুই বছর ধরে ওই প্রতিষ্ঠানে মাহবুব অ্যানেসথেশিয়া দিয়ে অস্ত্রোপচার করে এলেও তার কোনো নিবন্ধন নেই। অ্যানেসথেশিয়া করতে হলে বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথোলজিস্টের সদস্য হতে হবে। তবে মাহবুব ওই সংগঠনের সদস্য নন। এ ছাড়া বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সদস্য না হয়েও তিনি চিকিৎসা করে যাচ্ছিলেন। রাজশাহীর একটি অখ্যাত প্রতিষ্ঠান থেকে মাহবুব ডিপ্লোমা করেছেন। গ্রেপ্তার আরেক চিকিৎসক মোক্তাদির গাজীপুরের ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেছেন। জেএসএস নামে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মোক্তাদিরকে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অ্যানেসথেশিয়া, অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, ঘটনার পর থানায় বিএসএমএমইউর একটি প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়। মাহবুব নামে কোনো নিবন্ধনকৃত অ্যানেসথেশিওলজিস্ট নেই– এটা নিশ্চিত হয়েছি।
হাতিরঝিল থানার ওসি শাহ মোহাম্মদ আওলাদ হোসেন জানান, ঘটনার পরেই দুই চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের আদালতে তোলা হলে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আরেক চিকিৎসক আজাদকে খোঁজ করা হচ্ছে। এ ঘটনায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
পুলিশের একজন পদস্থ কর্মকর্তা জানান, হাসপাতালের পরিচালক মোক্তাদির হলেন তাহমিদের এক বন্ধুর বাবা। মোক্তাদিরের ছেলে তাহমিদের সঙ্গে পড়ে। পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরেই সেখানে সন্তানের খতনা করাতে নিয়ে যান তাহমিদের বাবা। তবে শুরুতে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানে সন্তানকে নিয়ে যেতে চাননি। স্ত্রী সায় দিলে তাহমিদকে জে এসে নিয়ে তাকে হারাতে হলো।