আজ ‘জাতীয় কন্যা শিশু দিবস’। শিশুদের প্রতি সব ধরনের ভেদাভেদ ও বৈষম্য দূর করে সচেতনতা তৈরিতে প্রতিবছর বাংলাদেশে দিবসটি পালন করা হয়। একটা সময় ছিলো যখন কন্যা শিশু জন্মগ্রহণ করলে পিতামাতার মন খারাপ হতো। এটার পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি হলো, কন্যা শিশুকে লালন-পালন করে লেখাপড়া শিখিয়ে পরের ঘরে বিয়ে দেয়ার মতো সামাজিক বিষয়। অপর একটি কারণ হলো, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কন্যা শিশুর সুরক্ষার অভাব। মনে করা হতো, পুত্র সন্তানই বৃদ্ধকালে বাবা-মার সুখের ঠিকানা। তাই কন্যা শিশুর চেয়ে পুত্র সন্তানকে পরিবারে গুরুত্ব দেয়া হতো বেশি। তবে সময় বদলেছে। পিতামাতার ধারণারও বদল ঘটেছে। বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে কন্যা শিশুরা এখন পুত্র সন্তানের মতো সমানতালে পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে অবদান রেখে চলেছে। কন্যা সন্তানও বৃদ্ধ পিতা-মাতার অসহায় জীবনে সহায় হয়ে দেখা দিচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে পুত্র সন্তানের চেয়ে বাবা-মার প্রতি বেশি গুরুদায়িত্ব পালন করছে কন্যারা। কন্যা শিশুরা যদি বাধাহীনভাবে আরো এগিয়ে যেতে পারতো তাহলে সমাজে তারা আরো জোরালোভাবে অবদান রাখতে পারতো। শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বজুড়ে নারী ও কন্যা শিশুদের প্রতি অবহেলা ও নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪২ শতাংশ শিশু। যাদের বয়স আঠারো বছরের কম। আর শিশুদের মধ্যে ৪৯ শতাংশ কন্যা শিশু। যাদের পেছনে রেখে দেশের উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়। বিশ্বে মোট জনসংখ্যার ১৫ ভাগ কন্যা শিশু। বাংলাদেশেও মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশের কাছাকাছি কন্যা শিশু রয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দেখা যায়, কন্যা শিশু জন্মগ্রহণ করলে এখন পিতামাতার মন খারাপ হয় না। বরং পরিবারের প্রথম সন্তান কন্যা হলে তাকে সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করা হয়। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। কন্যা শিশু যতো বড় হতে থাকে নিরাপত্তা নিয়ে পিতামাতার দুঃশ্চিন্তার পারদ ততো বাড়তে থাকে। কেনোনা বর্তমান সমাজে মেয়েদের নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। রাস্তাঘাটে ইভটিজিংয়ের ভয়, সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে চলাফেরার ভয়, একা একা দূরে কোথাও যাওয়ার ভয় ও রাস্তাঘাটে খারাপ লোকের কুদৃষ্টির ভয় এড়িয়ে সত্যিই চলাচল করা কঠিন। অনেক পরিবার আছে, যারা নিজের পরিবারের কন্যা শিশুকে আগলে রাখে অথচ অন্যের পরিবারের কন্যা শিশুকে নিয়ে কুৎসা রটায়। অনেক ভাই আছে যারা নিজের বোনকে যেভাবে সুরক্ষিত রাখতে চায় আশপাশের অন্য মেয়ের প্রতি দৃষ্টিটা সেভাবে দেয় না। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও মেয়ের অনুকূলে নয়। পরিবারে কন্যা শিশুদের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা সীমিত ও ক্ষেত্রবিশেষে নেই বললেই চলে। বাল্যবিয়ে, শিক্ষার অভাব, দারিদ্র্য, স্বাস্থ্যগত সমস্যা, পুষ্টির অভাব, ন্যায়বিচারের অভাব, সমাজের নেতিবাচক মনোভাব সার্বিকভাবে কন্যা শিশুদের পিছিয়ে দিচ্ছে। অনেক পরিবারের কন্যা শিশুরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে দিনের পর দিন। কন্যা শিশুদের জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়া হচ্ছে। কন্যাদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে বাবা-মা তাদের দায়মুক্তির উপায় খুঁজছেন। শুধু বিয়ে দিয়ে দিলেই কী পিতামাতার মুক্তি মেলে? কন্যা সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ না করলে, উপযুক্ত বয়সে উপযুক্ত পাত্রের হাতে তুলে দিতে না পারলে সেই কন্যা সন্তানের জীবন সুখের চেয়ে দুঃখের হওয়ার সম্ভাবনায় বেশি থাকে। অনেক সময় কন্যার গায়ের রঙ নিয়ে কটূক্তি করা হয়, অন্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়। যা শিশুদের মনোজগতে খারাপ প্রভাব ফেলে।
বিশ্বজুড়ে শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’-এর তথ্য অনুযায়ী, কম বয়সী কন্যা শিশুদের অনেক বেশি বয়সের পুরুষদের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়। সংস্থার মতে, হারিয়ে যাওয়া শৈশবকালীন অবস্থা বিবেচনা করলে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক নিচের দিকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিশুরা তাদের শৈশবের অধিকার পাচ্ছে না। শিশুরা সহিংসতা, নির্যাতন, অবহেলা ও বিচারহীনতার শিকার হচ্ছে। কন্যা শিশুরা বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে। পরবর্তীতে ঝরে পড়া শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। এমনকি ঝরে পড়া শিশুর ভবিষ্যৎ কী তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে না। দারিদ্র্যের কারণে শিশুশ্রমে যুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে অনেক কন্যা শিশু। তাদের মনের কথা শোনা হচ্ছে না। তাদের মতামতের গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেয়েদের হয়রানি করা হচ্ছে। একজন কন্যা শিশু না বুঝে অপরাধ করলে সমাজও তাকে দোষারোপ করছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হওয়া উপকূলের কন্যা শিশুদের অবস্থা তো আরো খারাপ। উপকূলে বাল্যবিয়ে বেশি হচ্ছে।
কন্যা শিশুদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির দায় সমাজের সব স্তরের মানুষের। সবার আগে বাধাহীনভাবে কন্যা শিশুদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। কন্যা শিশুরা যেনো বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপদ পরিবেশ পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বাল্যবিয়েকে ‘না’ বলতে হবে। আজকের কন্যা শিশুই আগামী দিনের আদর্শ মা। তাই কন্যা শিশুদের সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে হবে। শিশুদের অধিকার নিশ্চিতকল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাই, সুইডেনের গ্রেটা থুনবার্গের মতো কন্যা শিশুরা পৃথিবী বদলে দেয়ার মতো কাজ করে যাচ্ছেন। তাই দরকার শুধু সুযোগ ও সমতা। কন্যা শিশুদের অধিকার, নিরাপত্তা ও সুযোগ পুরোপুরি নিশ্চিত করতে পারলে তাদের হাত ধরেই আসবে পরিবর্তনের সূচনা।
লেখক: শিক্ষক