দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক কার্ল হাইনরিশ মার্কস এর আজ জন্মদিন। তিনি কার্ল মার্কস নামেই বেশি পরিচিত। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের একজন তিনি। মার্ক্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলোর মাঝে রয়েছে তিন খণ্ডে রচিত পুঁজি এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের সঙ্গে যৌথভাবে রচিত কমিউনিস্ট ইশতেহার।
কার্ল মার্কস ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে প্রুশিয়া সাম্রাজ্যের নিম্ন রাইন প্রদেশের এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের নয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বাবা হাইনরিশ মার্কস এমন এক বংশের লোক যে বংশের পূর্বপুরুষরা রাব্বি ছিলেন। অবশ্য তাদের মধ্যে অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ এবং আলোকময়তার যুগের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তাদের অনেকেই ভলতেয়ার ও রুশোর মত দার্শনিকদের প্রশংসা করতেন।
মার্কস ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতেই পড়াশোনা করেন। বাল্যপাঠ শেষে Trier Gymnasium এ ভর্তি হন, ১৭ বছর বয়সে সেখান থেকে স্নাতক হন। এরপর ইউনিভার্সিটি অব বন-এ আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তার ইচ্ছা ছিলো সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে পড়া, কিন্তু তার বাবা মনে করতেন কার্ল স্কলার হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারবে না।
কিছুদিনের মধ্যেই তার বাবা তাকে বার্লিনের Humboldt-Universität এ বদলি করিয়ে দেন। সে সময় মার্কস জীবন নিয়ে কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতেন, তার লেখার ভাষা ছিলো বাবার কাছ থেকে পাওয়া ধর্মতাত্ত্বিক তথা অতিবর্তী ঈশ্বরবাদের ভাষা। এ সময়ই তরুণ হেগেলিয়ানদের নাস্তিকতাবাদ গ্রহণ করেন। ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিলো ‘The Difference Between the Democritean and Epicurean Philosophy of Nature’। উল্লেখ্য, পিএইচডি অভিসন্দর্ভ তিনি বার্লিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা না দিয়ে ইউনিভার্সিটি অব জেনা-তে জমা দেন। কারণ তরুণ হেগেলিয়ান রেডিক্যাল হওয়ার কারণে বার্লিনে তার ভাবমূর্তি ভাল ছিলো না।
সমাজ, অর্থনীতি, ও রাজনীতি সংক্রান্ত মার্কসের তত্ত্বসমূহ মার্কসবাদ নামে পরিচিত। মার্কসের মতে, অদ্যাবধি পৃথিবীর ইতিহাস শ্রেণি সংগ্ৰামের ইতিহাস। শ্রেণি সংগ্রামের ভিতর দিয়ে মানব সমাজগুলো বিকশিত হচ্ছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এই সংগ্রামের প্রকাশ ঘটে শাসক শ্রেণি (যারা একইসঙ্গে রাষ্ট্র, ও কলকারখানা নিয়ন্ত্রণ করে) এবং শ্রমজীবী শ্রেণি (যাদের জীবিকার একমাত্র উপায় পুঁজিপতির কারখানায় ন্যূনতম মজুরির বিনিময়ে শ্রম বেঁচা), তাদের মাঝে। মার্কস বলেন যে, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে শ্রমিক শ্রেণি যে পরিমাণ নতুন মূল্যের সৃষ্টি করে তার ভগ্নাংশই মাত্র তারা মজুরি বাবদ পান, উদ্বৃত্ত সিংহভাগ অংশ পুঁজির মালিকরা আত্মসাৎ করেন।
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ অনুসরণ করে মার্কস দাবি করেন যে পূর্বতন সমাজব্যবস্থা গুলোর মতো পুঁজিবাদও তার অন্তঃস্থ বিভেদ ও শ্রেণি সংগ্রামের দরুন ভেঙে পড়বে এবং সমাজতন্ত্রের জন্ম হবে। মার্কস মনে করেন, অস্থিতিশীল ও সংকট প্রবণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ক্রমাগত শ্রেণি সংগ্রামের ভিতর দিয়ে মজলুম শ্রমজীবী শ্রেণির মাঝে শ্রেণিচেতনার জন্ম হবে; যার ফলে তাদের মাঝে ঐক্য গড়ে উঠবে এবং এই ঐক্যবদ্ধ শ্রমজীবী শ্রেণি জালেম শাসক শ্রেণিকে ক্ষমতাচ্যুত করে শ্রেণিহীন কওমী সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলবে। মার্কস মনে করেন, বিদ্যমান পুঁজিবাদী জালেমি ব্যবস্থার অবসান করতে এবং নিজেদের মুক্তির খাতিরে মজলুম শ্রমজীবী শ্রেণি গুলোর ঐক্যবদ্ধ হয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের বিকল্প নেই।
১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে মার্কস এক ধরনের বিরল রোগে আক্রান্ত হন। এই রোগ তাকে জীবনের শেষ ১৫ মাস অসুস্থ করে রাখে। ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ মার্চ তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় মার্কসের কোনো জাতীয়তা তথা দেশ ছিলো না। তাকে লণ্ডনের হাইগেট সেমিটারিতে সমাহিত করা হয়। তার সমাধি ফলকে লেখা আছে কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর শেষ লাইন ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’।