দৈনিক শিক্ষাডটকম, কুবি: উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতির দ্বন্দ্বের জেরে প্রায় একমাস ধরে বন্ধ রয়েছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। এই দীর্ঘ সময় পার হলেও এখনও বিশ্ববিদ্যালয় চালুর বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা।
৩০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৩তম জরুরি সিন্ডিকেট সভায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলো বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া কিছু শিক্ষকও এ ঘটনায় বিব্রত। তারাও চান দ্রুত সমস্যার সমাধান।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনীতি ও উপাচার্য (ভিসির) সঙ্গে দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত বলির পাঁঠা হয়েছে শিক্ষার্থীরাই। বর্তমান অবস্থায় ঈদের আগে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সম্ভাবনা দেখছেন না শিক্ষক-শিক্ষার্থী।
তবে শিক্ষার্থীদের দাবি, দ্রুত সংকট নিরসন করে তাদের ক্লাস-পরীক্ষা চালু করা হোক। কারণ শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব ও রাজনীতির কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার ঘটনা কুমিল্লা ছাড়া দেশের আর কোথাও নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন শেষে ওইদিন বিকালে উপাচার্যকে ঘেরাও করে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন শিক্ষক সমিতির নেতারা। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সাত দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন।
দাবি মানতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়ার পর ২৫ এপ্রিল উপাচার্য, ট্রেজারার ও প্রক্টরকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তাদের কার্যালয়ে তালা দেয়া হয়।
পরবর্তীতে ২৮ এপ্রিল দুপুরে উপাচার্য প্রশাসনিক ভবনে প্রবেশের সময় উপাচার্য, শিক্ষক সমিতি ও শাখা ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী নেতাকর্মীদের মধ্যে ত্রিমুখী ধাক্কাধাক্কি-হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এরপর শিক্ষক সমিতি তাদের সাত দফা দাবি থেকে সরে এসে উপাচার্য ও ট্রেজারারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করে।
এ ছাড়া ওই দিনই কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানায় পাল্টাপাল্টি লিখিত অভিযোগ করে শিক্ষক সমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
২৯ এপ্রিল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষক সমিতি। পরের দিনই সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক, প্রশাসনিক কার্যক্রম ও হলগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণার পর থেকে স্থবির হয়ে আছে স্বাভাবিক সব কার্যক্রম। কবে নাগাদ এই অচলাবস্থা কাটবে তারও নেই কোনো নিশ্চয়তা। যার কারণে শিক্ষাজীবন নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে শিক্ষার্থীদের।
৩০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো বন্ধের ঘোষণা প্রত্যাখান করে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী হলে অবস্থান করলেও বর্তমানে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র।
হলগুলো বেশিরভাগই ফাঁকা। বাধ্য হয়ে যারা হলে আছেন, তাদের সবাই টিউশনের তাগিদে রয়েছেন বলে জানা গেছে। প্রথম কয়েকদিন অবস্থান করে অনিশ্চয়তা নিয়ে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন অনেক শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, উপাচার্য আর শিক্ষক সমিতির রাজনীতির জয় হয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তাদের ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক সিদ্ধান্তের কারণে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রনি আহমেদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে প্রথমত আমরা সেশন জটে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আছি। ক্লাস, পরীক্ষা না হওয়ার কারণে পড়াশোনা থেকে দূরে চলে যাচ্ছি। আমরা চাই দ্রুত এই সমস্যা নিরসন হোক, আমরা ক্লাসে ফিরতে চাই।’
‘শিক্ষকরা সবাই যদি নিজেদের বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে শিক্ষার্থীদের কথা ভাববে কে? নিজেদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জায়গায় দাঁড় করিয়ে বিষয়গুলো ভাবার জন্য অনুরোধ করছি।’
জান্নাতুল ফেরদৌস নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এভাবে আর কতদিন? উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতির সবাই শিক্ষক। তারা তো শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে একে অপরকে ছাড় দিতে পারেন। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তারা নিজেদের স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত। নাহলে বন্ধের এতো দিনেও কেন বিশ্ববিদ্যালয় চালু হল না?’
এদিকে উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতির দ্বন্দ্বের কারণে অনেকের পরীক্ষা আটকে গেছে। ২৯ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ হওয়ার পর থেকে অর্থনীতি বিভাগ, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ এবং মার্কেটিং বিভাগের অন্তত ১০টি পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘শিক্ষকদের রাজনীতির কারণে আমরা কেন বলির পাঁঠা হবো? তাদের রাজনীতি তারা করুক। কিন্তু আমাদের জীবন নষ্ট করার অধিকার তাদের নেই। তাই দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দাবি জানাচ্ছি।’
বর্তমান অবস্থায় কোরবানির ঈদের বন্ধের আগে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আসলে বন্ধের পরেই পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় চালু হতে পারে বলে মনে করছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারাও।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যতটুকু জানতে পেরেছি, ঈদের বন্ধের আগে ভার্সিটি খুলছে না। এমন অচলাবস্থায় শিক্ষার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরাও তো অবসর সময় পার করছি।’
চলমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. আবু তাহের বলেন, ‘আমরা ১৯ ফেব্রুয়ারি উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে গেলে হামলার শিকার হই। সেটির কোনো বিচার এখনও পাইনি। তারপর আমরা নানাভাবে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চালিয়েছি, ক্লাস বর্জন, অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছি।’
‘কিন্তু এরই মধ্যে ২৮ এপ্রিল বহিরাগতদের নিয়ে উপাচার্য নিজেসহ শিক্ষকদের ওপরে যে হামলা করেছে, সেটির পরে আমরা তার সঙ্গে আর কাজ করতে পারব না। তাই আমরা উপাচার্য-কোষাধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘তাদের পদত্যাগ না হওয়া অবধি আমরা ক্লাসে ফিরব না। আমরাও শিক্ষার্থীদের বিষয় নিয়ে চিন্তিত। এজন্য আমরা চাই দ্রুত আমাদের দাবি মানা হোক।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘দেশের মান উন্নয়নে সহায়ক এমন প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশৃঙ্খলা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমনি প্রতিষ্ঠান; এসব প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে শিক্ষার্থীদের জীবন হুমকির মুখে পড়ে। এর মধ্যে সমস্যা সমাধানে দুটি উচ্চতর কমিটি গঠন করা হয়েছে।
‘সেখানে শিক্ষক সমিতির দাবি-দাওয়া, উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা চলবে। আশা করি, সমাধান আসবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কখনো প্রশাসনের প্রতিপক্ষ হতে পারে না। তারাও প্রশাসনের অংশ। আমাদের সকলকে মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ করতে হবে।’
উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট থেকে দুটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে। কমিটির সুপারিশ মোতাবেক সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এই বন্ধের কারণে শিক্ষার্থীরা যে ক্ষতির মুখে পড়েছে, সেটা পুষিয়ে দেয়ার জন্য রিকভারি প্ল্যান তৈরি করা হবে।’
এসব বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক এ এফ এম আবদুল মঈন বলেন, ‘আমি এক মুহূর্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখতে চাই না। শিক্ষক সমিতিই প্রথমে ক্লাস বর্জন করেছে। পরবর্তীতে সিন্ডিকেট সভায় পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে।’
‘শিক্ষক সমিতির দাবি-দাওয়া, উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য উচ্চ পর্যায়ের কমিটি করে দেয়া হয়েছে। তারা বসুক, আলোচনা করুক। কমিটি আমাদের যা সুপারিশ করবে, আমরা তা মেনে নেব। আমিও চাই দ্রুত সবকিছু স্বাভাবিক হোক।’