কোটাবিরোধী আন্দোলন ও কিছু প্রশ্ন

কোটাবিরোধী আন্দোলন ও কিছু প্রশ্ন

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ তারিখ বৃহস্পতিবার জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত ‘Civil Bureaucracy : Quotas Pushing it Downhill’ শিনোনামে একটি প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ‘তুলনামূলক কম মেধাবী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই কোটা ব্যবস্থার কারণে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বেসামরিক প্রশাসন না-কি মানহীন হয়ে যাবে! সাবেক..

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ তারিখ বৃহস্পতিবার জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত ‘Civil Bureaucracy : Quotas Pushing it Downhill’ শিনোনামে একটি প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ‘তুলনামূলক কম মেধাবী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই কোটা ব্যবস্থার কারণে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বেসামরিক প্রশাসন না-কি মানহীন হয়ে যাবে! সাবেক দুই মূখ্যসচিব ড. আকরব আলী খান ও আলী ইমাম মজুমদারের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি চলমান কোটা বিরোধী আন্দোলনরত যুবকদের পক্ষালম্বন করেছে। অন্যান্য গণমাধ্যমও কোটা সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এমনকি কোটা বাতিলের দাবিতে গত জানুয়ারি মাসে উচ্চ আদালতে একটা রিট মামলাও দায়ের করা হয়েছে এবং মহামান্য আদালত রিটকারীদের পক্ষে রুলও দিয়েছেন। বিপরীত ভাষ্য গণমাধ্যমে নেই।

কোটা বিরোধী আন্দোলনের বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্নের সুরাহা হওয়া দরকার। প্রথমত, কোটা বিরোধীরা আসলে কি চায়, তাদের দাবিগুলো কতটা ন্যায়নিষ্ঠ ও সঠিক? দ্বিতীয়ত,কোটার কারণে প্রকৃতপক্ষে কথিত মেধাবীরা কি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, না-কি কোটার প্রচলন হয়েছে বৈষম্য নিরসনের জন্যই? তৃতীয়ত, কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তরা কি অযোগ্য কিংবা তারা কি মেধাবী নয়? চতুর্থত, কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তদের বা কোটায় নিয়োগ প্রত্যাশীদের এইভাবে ‘মেধাহীন বা কম মেধাবী’ আখ্যায়িত করলে কর্মস্থলে তারা যদি অশোভন আচরণের শিকার হয় তাহলে তার দায় কে নেবে? পঞ্চমত ও শেষ, কোটার সংস্কার কি হওয়া উচিত হলে, সেটা কিভাবে ও কেন?

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত ‘শাহবাগে বিক্ষোভ, কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লিখিত কোটা বিরোধীদের সেগানগুলো হলো ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় কোটা বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘নাতি-পুতি কোটা বাতিল কর’, ‘বেকাররা কোটা বৈষম্য থেকে মুক্তি চায়’, ‘কোটা সংস্কার চাই’ ইত্যাদি। তাদের পাঁচটি সুনির্দিষ্ট দাবিও ছিল, এগুলো হলঃ (১) ৫৬% কোটা থেকে নামিয়ে ১০% কোটা নির্ধারণ করা, (২) কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা থেকে শূন্যপদে নিয়োগ দেয়া, (৩) কোটায় কোন ধরনের বিশেষ পরীক্ষা না নেয়া, (৪) সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা এবং (৫) চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার না করা। এই সেøাগান ও দাবিগুলো বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার হবে। প্রথমত, কোটাবিরোধীরা মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের জন্য সংরক্ষিত ৩০% কোটা বাতিল চায়। দ্বিতীয়ত: তারা নারী, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সুবিধা বঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে পেছনেই রাখতে চায়, সামনে এগিয়ে আনতে নারাজ। কারণ, ১০% কোটা বজায় রাখা হলে পশ্চাৎপদ গোষ্ঠীর প্রার্থীরা সবলদের সঙ্গে কামড়া-কামড়ির প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে পারবে না, এরা পেছনেই পড়ে থাকবে। কোটায় সংরক্ষিত পদ কেন খালি থাকে এবং সেগুলো কোটার অধিকারীদের দ্বারাই কিভাবে পূরণ করা যায় সে বিষয়ে তাদের আগ্রহ নেই। তারা চায় ওই খালি পদগুলো তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়ে তাদের বেকারত্ব ঘুচানো হোক, আর কোটায় যারা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি পাচ্ছে না তারা বেকারণ থাক! এক কথায় এই মেধাবী(!) তরুণরা অবিশাস্য রকমের স্বার্থপর। আন্দোলনকারীদের প্রচার-প্রচারণায় শঠতাও আছে। তারা বলছে ৫৬% (মুক্তিযোদ্ধা ৩০%, নারী ১০%, জেলা ১০%, আদিবাসী ৫% এবং প্রতিবন্ধী কোটা ১%) পদ কোটাওয়ালাদের জন্য সংরক্ষিত এবং অবশিষ্ট ৪৪% পদ কথিত মেধাবীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে। অথচ, ৩৪তম বিসিএস এর ফলাফলকে কেন্দ্র করে দায়ের করা একটি রিট মামলায় মহামান্য হাইকোর্টের একটি রায়ের পূর্ব পর্যন্ত স্বয়ং পিএসসি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য পৃথক ১% কোটা হিসেব না করে অন্যান্য কোটায় খালি থাকলে সেই খালি পদ থেকে প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের নিয়োগ প্রদান করত। তারা আরো প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে যে, কোটার জন্য সংরক্ষিত পদে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সেই পদ খালি রেখে দেওয়া হয়। অথচ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাদে অন্যদের ক্ষেত্রে কিন্তু এভাবে পদ খালি রেখে দেয়া হয় না!

কোটার কারণে মেধাবীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে এটা অর্ধ-সত্য। মেধাবীদের দাবিকৃত এই বৈষম্য ইতিবাচক। সাংবিধানিক ম্যান্ডেট নিয়েই এই কোটা-প্রথা জারি আছে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী।’ বৈষম্য প্রসঙ্গে ২৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না।’ সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা প্রসঙ্গে ২৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে।’ চাকরির সমতা প্রসঙ্গে ২৯(২) অনুচ্ছেদে আরো সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হবেন না কিংবা সেক্ষেত্রে তার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না।’ অর্থাৎ, সংবিধান কেবল নাগরিকের সমতা থাকার বিষয় নিশ্চিত করেই ক্ষান্ত থাকেনি, বরং কিছু সুনির্দিষ্ট গ্রাউন্ডে বৈষম্য সুষ্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করেছে। সংবিধানের এই অংশগুলো পাঠ করলে মোটাদাগে কোটাব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ও বৈষম্যমূলক মনে হতেই পারে। কোটা বিরোধীরা সংবিধানের এই অংশকেই সামনে রেখে বলছে কোটা একটা বৈষম্য, একারণেই তারা এটির অবসান চায়। কিন্তু সুকৌশলে তারা সংবিধানের এই অনুচ্ছেদগুলোরই অপর অংশ আড়ালে রাখছে এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।

আমাদের সমাজ থেকে সামন্ততন্ত্র, জমিদারি প্রথা ও ঔপনিবেশিক চরিত্র বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। এই সমাজে এখনও খাবার দোকানে হরিজন ছোটো লোকদের চেয়ারে বসে ভদ্রজনদের সঙ্গে এক টেবিলে খেতে দেয়া হয় না। বিভিন্ন কারণে এখানে রাষ্ট্র ও সমাজ বিভিন্ন শ্রেণী-গোত্রের মানুষদের এক চোখে দেখতে শেখেনি। সংবিধান প্রণয়নকালেও এ অবস্থা ছিল। তাই সংবিধান প্রনেতাগণ প্রচলিত বৈষম্যের কারণে যারা পিছিয়ে পড়েছে তাদের এগিয়ে আনার জন্যবিশেষ ব্যবস্থা বা কোটা প্রদানের ব্যবস্থা রেখেছিলেন। এজন্যই সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকের যেকোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করবে না।’ একইভাবে ২৯(৩)(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই নাগরিকের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে তাদের অনুকূলে বিশেষ-বিধান প্রণয়ন করা হতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করবে না।’ অর্থাৎ, মহান মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহৃত পরেই এবং শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে মহান সংগ্রামের চেতনা জ্যান্ত থাকতে থাকতেই মহান সংবিধানের প্রণেতাগণ বৈষম্য দূর করার অভিপ্রায়ে বিশেষ-বিধান তথা কোটা প্রদানের পথ উন্মুক্ত রেখে ছিলেন। সমতা নিশ্চিত করার জন্যই বাংলাদেশে কোটাপ্রথা চালু হয়েছে, বৈষম্য সৃষ্টি করার জন্য নয়। বিশ্বের সকল দেশেই পশ্চাতপদ জাতিগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদানের বিধান রাখা হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় আজ মেধাবী নামধারী একদল যুবক রাষ্ট্রের এই মহান অভিপ্রায় ভুলে গিয়ে কোটা বাতিলের নামে শোষণ ও বৈষম্যের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তরা কি অযোগ্য? প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা পর্যন্ত কোটায় আবেদনকারীকে একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়। মৌখিকের পূর্ব পর্যন্ত মূল্যায়নকারী জানতেও পারে না কে কোটায় আবেদন করেছে ও কে কোটায় করেনি। মেধা না থাকলে কেউ এই দুটো স্তর অতিক্রম করতে পারবে? বরং মৌখিকে হাজির হয়ে চরম বৈষম্যের শিকার ও নিগৃহিত হন প্রতিবন্ধী, আদিবাসী ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠাণ থেকে আসা প্রার্থীরা। কারণ এই স্তরেই মূল্যায়নকারী ও প্রার্থী প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হয়। এই স্তরেই ঘটে স্বজনপ্রীতি, প্রতিষ্ঠান প্রীতিসহ নানান প্রীতি আর অপ্রীতির খেলা। আজ অবধি কোন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় বসার অনুমোদনই পায়নি! ২০১০ সালের পূর্ব পর্যন্ত বিসিএস পরীক্ষায়ও বসতে পারেনি তারা। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের সহায়তায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আইনজীবী স্বপন চৌকিদারের রিট আবেদন করার পূর্ব পর্যন্ত যখনই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী প্রার্থীরা শ্রুতিলেখকের আবেদন করত তখনই তাদের পরীক্ষায় বসার অধিকার কেড়ে নেয়া হত। যেখানে মেধা যাচাইয়ের আগেই প্রতিবন্ধিতার কারণে ‘অযোগ্য’ ঘোষণা করা হয় প্রার্থীকে সেখানে সম-অধিকারের নামে মেধাবীদের চিৎকার কতটা অর্থপূর্ণ? কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তরা কতটা দেখাচ্ছে তার কি কোন জরিপ আছে? তাদের স্কিল ডেভেলপমেন্টের জন্য কি মেধাবীদের সমান গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ‘না’। আমাদের জানামতে কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তরা যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গেই দায়িত্বপালন করছেন এবং কাজের ভিত্তিতে কথিত মেধাকোটা ও অন্যান্য কোটধারীদের মধ্যে খুব কমই পার্থক্য করা যায়।

কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাদের স্ব স্ব কর্মস্থলে রীতিমতো মানসিক যন্ত্রণা ও হয়রানির শিকার হয় কোটায় নিয়োগ পেয়েছে বলে। এই পরিস্থিতিতে কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তদের ঢালাওভাবে ‘কম মেধাবী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হলে, তারা কি সহকর্মীদের অসৌজন্যমূলক, বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে চাকরিতে টিকতে পারবেন? মানসিক যন্ত্রণায় যদি কেউ অঘটন ঘটিয়ে ফেলে তার দায় কে নেবে? মেধার ঘাটতি বিষয়ক এই ‘হেইট স্পিচ’ যারা ছড়াচ্ছেন তাদের নিন্দা জানানোর ভাষাও আমাদের নেই।

কোটা কি সংস্কার হওয়া প্রয়োজন? যেহেতু সকল নাগরিকগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্র সমান নজর দিতে পারেনা, রাষ্ট্রের ব্যয়, বিনিয়োগ ও মনোযোগ সকল নাগরিকগোষ্ঠীর প্রতি সমান হয় না, সেহেতু রাষ্ট্রের এই ব্যর্থতার কারণে যারা অনগ্রসর গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে তাদের জন্য একটা কাফফারা রাষ্ট্রকে দিতেই হবে। তবে এটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয় বিধায় এই ব্যবস্থার সংস্কার এমনভাবে করতে হবে যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে দ্রুত সকল নাগরিকগোষ্ঠীর আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়। কোটায় নিয়োগের ক্ষেত্রে যত প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলোর অবসান করতে হবে। কোটা বাস্তবায়নের কোন নীতিমালা না থাকা এবং কোটার সুনির্দিষ্ট ও বৈজ্ঞানিক হিসেবে পদ্ধতি না থাকায় প্রতিবছরই অসংখ্য প্রার্থী যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কোটায় নিয়োগ পায় না। পিএসসি একটা শে^তহস্তিতে পরিণত হয়েছে। এই ব্যয়বহুল হস্তিকে কোটা বাস্তবায়নের কাজে লাগাতে হবে।

গড়ে প্রতি দেড় কিলোমিটারের মধ্যে সরকার ১টি করে স্কুল নির্মাণ করেছে। এই স্কুলগুলোতে প্রতিবন্ধী শিশুরা পড়তে পারে না কারণ এগুলো প্রতিবন্ধী-বান্ধব নয়। পার্বত্য এলাকার এমন অনেক দুর্গম এলাকা আছে যেখানে কোন স্কুলই নেই, ৭/৮ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ হেঁটে এই সব স্কুলে যায় শিশুরা। বাংলাবান্ধার স্কুল আর ঢাকার স্কুল একই মাপের নয়। রাষ্ট্রের দায়িত্বতো ছিল এই মাপটাও ঠিক রাখবার! কোটা যদি বাতিল করতেই হয় তাহলে সুযোগ-সুবিধার এই মাপ-জোখগুলো আগে ঠিক করতে হবে। শাহবাগে যে উদ্যমীরা খুব সহজেই বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে এসে গলাবাজি করছে তাদের প্রতিষ্ঠানকে এখন যেখানে আছে সেখানে রাখা যাবে না। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে যখন পড়েছি তখন একটা সাধারণ বই সংগ্রহ করতেও পাইরেসি ও জালিয়াতের আখড়া নীলক্ষেতে আসতে হত। এই সব সুবিধা হাতের কাছে পেয়েও যদি ৪৫% এর মধ্যে স্থান পেতে না পারে তাহলে তার দায় এই কথিত মেধাবীদেরই, এর জন্য সুবিধাবঞ্চিতরা কোটাবঞ্চিত হবে কেন? গাছেরটাও খাবেন, তলারটাও কুড়াবেন সেটা হবেনা। শিক্ষা জীবনের আগাগোড়া সুবিধা নিয়ে মেধাবী সাজবেন আবার প্রান্তিকদের জন্য সামান্য সংরক্ষিত খাবারটুকুও খেতে চাইবেন সেটা হবে না।

পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) ও জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন (জেএসসি) এর নিকট তথ্য অধিকার আইনে বিগত কয়েক বছরের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার নম্বর চেয়ে আবেদন করা হয়েছিল। তারা তথ্য না দেয়ায় তথ্য কমিশনে অভিযোগ করার পর কমিশন জেএসসিকে উক্ত পরীক্ষা সমূহের নম্বর প্রদানের আদেশ প্রদান করলেও অদ্যাবধি সংস্থাটি তথ্য প্রদান করেনি। পিএসসি তথ্য না দিয়ে উল্টো তথ্য কমিশনের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করেছে। আমরা ধারণা করছি, থলের বিড়াল যাতে বেরিয়ে না পড়ে সেজন্যই সংস্থা দুটো নম্বর গোপন রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আন্দোলন হতে পারে নিয়োগ প্রক্রিয়ার দুর্নীতির বিরুদ্ধেও। আদালতে ও মাঠে লড়াই চলতে পারে মুক্তিযোদ্ধা কোটার আইনি ভিত্তির বিষয়ে কারণ সংবিধানের ২৮(৪) ও ২৯(৩)(ক) অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে কোটা সুবিধা লাভের অপরিহার্য শর্ত হল সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীকে অনগ্রসর হতে হবে। সকল মুক্তিযোদ্ধা অনগ্রসর নন।

[লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিমকোর্ট অব বাংলাদেশ এবং রিসার্স স্পেশালিস্ট, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)]

[email protected]