সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কোটা–সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়কে স্থগিত করেছেন এক মাসের জন্য। এটা একটা ভালো দিক, আশা করি এটি কোটা আন্দোলনের অসন্তোষ ও মানুষের ভোগান্তি কমাতে ভূমিকা রাখবে। তবে এটি চূড়ান্ত সমাধান নয়।
আমি মনে করি, চূড়ান্ত সমাধান প্রধানত সরকারের হাতে। অতীতে সরকার কোটা আন্দোলনকারীদের আন্দোলনের মুখে কোটাব্যবস্থাই তুলে দিয়েছিল। এটি ভালো সমাধান ছিল না, কোটা আন্দোলনকারীরাও এ রকম কিছু চায়নি, চেয়েছিল কোটাব্যবস্থার সংস্কার। বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরো জানা যায়, এই সংস্কার সংবিধানের আলোকে করতে হলে আমাদের নির্মোহভাবে সংবিধানের ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদ বুঝতে হবে। ২৮ অনুচ্ছেদে সার্বিকভাবে সাম্য ও বৈষম্যহীনতার কথা বলা আছে। ২৯ অনুচ্ছেদে নির্দিষ্টভাবে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য করা যাবে না বলা আছে।
দুটো অনুচ্ছেদেই বৈষম্যহীনতা মূল নীতি, তবে পৃথিবীর অন্য বহু সংবিধানের মতো এখানেও কিছু ব্যতিক্রমকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সরকার মনে করলে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা (যেমন কোটা) করতে পারবে বলা আছে। ২৯ এবং ২৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে কোটার ব্যবস্থা করা তাই বাঞ্ছনীয়, কিন্তু বাধ্যতামূলক নয়।
সরকার চাকরিতে কোটার ব্যবস্থা রাখতে চাইলে তা সাংবিধানিকভাবে করতে হবে। কোটার সুবিধা দিতে হবে কেবল ‘অনগ্রসর’ শ্রেণিকে এবং তা কেবল সরকারি চাকরিতে তাদের ‘উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব’ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। এর মানে হচ্ছে কোটা স্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না এবং উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হলে এরপর তা আর রাখা সাংবিধানিকভাবে সংগতিপূর্ণ হবে না।
আমরা মানব যে এ দেশের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলো যুগে যুগে শোষণ–বঞ্চনার শিকার হয়েছে এবং শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী যাঁরা আছেন, তাঁদের জন্য অবশ্যই বিশেষ অনুকূল ব্যবস্থার প্রয়োজন রয়েছে।
২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে আগে বিদ্যমান ব্যবস্থায় এদের সঙ্গে নারী ও জেলাভিত্তিক কোটার ব্যবস্থাও রয়েছে। এর মধ্যে জেলাভিত্তিক কোটা সংবিধানবিরোধী বিবেচিত হওয়ার মতো, কারণ ২৮ এবং ২৯ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে জন্মস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্য (কোটার কোনো জেলাকে সুবিধা দিলে তা অন্য জেলার জন্য বৈষম্যমূলক হয়) নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নারী কোটা সংবিধানসম্মত, তবে তা উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত।
কোটার ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সবচেয়ে আলোচিত এবং এ নিয়ে বিতর্ক সবচেয়ে বেশি। মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্ম পর্যন্ত এই কোটার বিস্তৃতি।
গণপরিষদ বিতর্ককালে বা সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরিতে কোটা দেওয়ার কথা বলা হয়নি। তবে ১৫ অনুচ্ছেদের আলোচনাকালে পঙ্গু ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের কথা আলোচিত হয়েছে।
সে আলোকে তাঁদের জন্য বিদ্যমান মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও অন্যান্য ভাতা সংবিধানসম্মত। কিন্তু ঢালাওভাবে সব মুক্তিযোদ্ধাকে ‘অনগ্রসর’ ধরে নিয়ে সরকারি চাকরিতে অনাদিকাল ধরে কোটা প্রদান সংবিধানসম্মত নয়।
সংবিধান প্রণয়নকালে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে সেপ্টেম্বরের ইন্টেরিম রিক্রুটমেন্ট রুলসে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটা দেওয়া হয় এবং ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে এ আলোকে কয়েক শ বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এটি যে অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে করা হয়, তার প্রমাণ হচ্ছে রুলসটিকে ইন্টেরিম বা অস্থায়ী বা অন্তর্বর্তীকালীন হিসেবে আখ্যায়িত করা। এটি যে সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, তার প্রমাণ হচ্ছে ১৫০ অনুচ্ছেদে এ ধরনের অস্থায়ী ব্যবস্থাকে আলাদাভাবে প্রটেকশন দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করা।
আদালত এতে হস্তক্ষেপ করতে পারেন শুধু কোটাব্যবস্থার মাধ্যমে সংবিধান লঙ্ঘিত হলে (যেমন কোন জেলা, ধর্ম বা দলের লোকদের সরকারি চাকরিতে কোটা দেওয়ার আইন হলে), কারও জন্য কোটা নেই কেন বা থাকলে এত শতাংশ না কেন, এসব প্রশ্নে নয়। অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস আন্তরিকভাবে এসব যুক্তি তুলে ধরলে তা আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
মনে রাখতে হবে, ইন্টেরিম বা অস্থায়ী রুলসে শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের কোটার কথা বলা হয়েছিল, তাঁদের সন্তান বা নাতি–নাতনির জন্য নয়। কাজেই ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ও ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে যথাক্রমে সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য বর্ধিত করা ইন্টেরিম রুলস এবং একই সঙ্গে সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। তা ছাড়া দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ০.১ শতাংশ তালিকাভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্য ৩০ শতাংশ কোটা রাখা ‘উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব’ নিশ্চিত করার সাংবিধানিক নীতির সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ নয়।
আমরা সবাই জানি, এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। তালিকাভুক্ত পৌনে দুই লাখ (প্রথম তালিকায় এটি ছিল ৭০ হাজারের মতো) ছাড়াও কোটি কোটি মানুষ মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সহায়তা ও সাহায্য করেছেন, এ জন্য লাখ লাখ মানুষকে এ জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে, কোটি কোটি মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। তালিকাভুক্ত দেড়-দুই লাখ বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্য ৩০ শতাংশ কোটা রাখা এই কোটি কোটি মানুষ ও তাঁদের পরিবারের জন্য চরম বৈষম্যমূলক ও অবমাননাকর।
আমি মনে করি, ‘অনগ্রসর’ জনগোষ্ঠী হিসেবে সরকারি চাকরিতে কোটা রাখা যেতে পারে কেবল মুক্তিযুদ্ধে পঙ্গু ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোর জন্য। তবে তাঁদের পরিবারের কোনো একজন কোটায় নিয়োগ পেলে আর কাউকে এটি দেওয়ার যুক্তি নেই, কোটার পদ শূন্য থাকলে এটি মেধাবীদের দিয়ে পূরণ না করারও কোনো যুক্তি নেই।
সার্বিক বিবেচনায়, পঙ্গু ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য (অনগ্রসর হিসেবে) সর্বোচ্চ ৫ শতাংশের মতো কোটা (উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার শর্তে) রাখলে তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমি মনে করি। সব মিলিয়ে (যেমন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধীদেরসহ) কোটায় নিয়োগ ১০ থেকে ১৫ শতাংশের মতো হলে তা যৌক্তিক বলে বিবেচিত হতে পারে।
৩.
আমি মনে করি, এমন একটি যুক্তিসংগত কোটাব্যবস্থা প্রণয়নের দায়িত্ব সাংবিধানিকভাবে সরকারের। গতকাল জাহেদ উর রহমান তাঁর একটি নিবন্ধে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন কোটা থাকবে কি না বা থাকলে কত শতাংশ ও কত বছরের জন্য থাকবে, তা নির্ধারণ করার এখতিয়ার সরকারের নির্বাহী বিভাগের।
আমি এর সঙ্গে যুক্ত করে বলতে চাই, এ ধরনের নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলো ‘ডকট্রিন অব পলিটিক্যাল কোয়েশ্চেন’ অনুসারে আদালতের এখতিয়ারাধীন বিষয় নয়। বাংলাদেশে উচ্চ আদালতের কিছু রায়ে (যেমন এরশাদ আমলে হরতাল–সম্পর্কিত একটি মামলায়) এই ডকট্রিনের স্বীকৃতি আছে। ভারতে উচ্চ আদালত এর লঙ্ঘন করলে সংসদ আইন প্রণয়ন করে তা অকার্যকর করে দিয়েছে, এমন নজির আছে।
সরকারের এখন প্রধান কর্তব্য হচ্ছে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের মাধ্যমে উচ্চ আদালতে এই যুক্তি তুলে ধরা যে কোটা–সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সরকারের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়।
আদালত এতে হস্তক্ষেপ করতে পারেন শুধু কোটাব্যবস্থার মাধ্যমে সংবিধান লঙ্ঘিত হলে (যেমন কোন জেলা, ধর্ম বা দলের লোকদের সরকারি চাকরিতে কোটা দেওয়ার আইন হলে), কারও জন্য কোটা নেই কেন বা থাকলে এত শতাংশ না কেন, এসব প্রশ্নে নয়। অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস আন্তরিকভাবে এসব যুক্তি তুলে ধরলে তা আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
সরকারের দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে কোটা বাতিল করে দেওয়া পরিপত্রটির সংশোধন করা। মনে রাখতে হবে, উচ্চ আদালত এটি ঢালাওভাবে ‘বাতিল’ করাকে অবৈধ বলেছেন, কিন্তু কোনো আদালত সরকারের জারি করা পরিপত্র ‘সংশোধন’ করার ক্ষমতা সরকারের নেই এটি বলেননি, বলার কথাও নয়। ১৯৯৭ ও ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি চাকরিতে কোটার বিধানে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। তখন সরকার এগুলো করতে পারলে এখন পারবে না কেন? ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি ও আমাদের সংবিধান অনুসারে এটি অবশ্যই সরকারের বৈধ কর্তৃত্ব।
সরকারের তৃতীয় কাজ হচ্ছে সংশোধিত কোটাব্যবস্থাকে যৌক্তিক রূপ দেওয়া। অতীতে আকবর আলি খানসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও কমিশনের রিপোর্ট সরকার এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিতে পারে। আমি ওপরে এ বিষয়ে যেসব প্রস্তাব দিয়েছি, তা এসব রিপোর্টের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
লেখক: আসিফ নজরুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক