শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদান করেন আর শিক্ষার্থীরা তা গ্রহণ করেন। এটি আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রক্রিয়ার গতানুগতিক ধারা। শিক্ষকরা সাধারণত ব্যক্তব্য নির্ভর শেখানো পদ্ধতিতে অভ্যস্ত, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদেরকে ক্রিয়াকলাপে যুক্ত করে তাদের ভিতরকার সৃজনশীল শক্তিকে তীক্ষ্ণ করার প্রয়াস খুব কম শিক্ষকই করে থাকেন। এটি শিক্ষকদের দোষ নয়; এটি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও পাঠ্যক্রম সমস্যা। তবে একটি আশার কথা হলো, আমাদের দেশের নতুন প্রণীত শিক্ষাক্রমে যে বিষয়টির প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, সেটি অনেকটা ক্রিয়াকলাপ ভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতির আওতায় পড়ে। তবে এটি প্রয়োজন ছিলো আরো আগেই আমাদের দেশে সব শ্রেণিতে চালু করা।
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা তাদের ইন্দ্রিয়ের উদ্দীপনার মাধ্যমে কার্যকলাপে নিযুক্ত থাকেন। তারা পঞ্চেন্দ্রিয়ের প্রধান চারটি ইন্দ্রিয় শক্তি যেমন; শ্রবণ, ঘ্রাণ, দৃষ্টি এবং অনুভূতি কাজে লাগিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকেন। আর এটিই মূলত: ক্রিয়াকলাপ ভিত্তিক শিক্ষার আবেদন। কিন্তু শিক্ষকরা যদি শুধুমাত্র ব্যক্তব্য নির্ভর শিক্ষাদানে অভ্যস্ত হন, তাহলে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র শ্রবনেন্দ্রিয় শক্তি বেশি ব্যবহার করতে পারে। তবে শিক্ষার্থী মনোযোগী হলে দৃষ্টিশক্তিও সেখানে কিছুটা ব্যবহৃত হতে পারে। অথচ, ফলপ্রসূ প্রকৃত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে প্রধান চারটি ইন্দ্রিয় শক্তির সমান ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর সেটি নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন ক্রিয়াকলাপ-ভিত্তিক শিক্ষা। এ শিক্ষা কৌশল স্কুলকে শিক্ষার্থীদের জন্য আরো উত্তেজনাপূর্ণ ও আনন্দপূর্ণ করে তোলে এবং এ প্রক্রিয়ায় তারা যা শেখে, তা দীর্ঘদিন ধরে মনেও রাখতে পারে।
শিখনফল নিশ্চিত করতে বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন-এর উক্তিটি খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, ‘আমাকে বলুন এবং আমি ভুলে যাই। আমাকে দেখান এবং আমি হয়ত মনে করতে পারি, আমাকে সম্পৃক্ত করুন (কাজে যুক্ত করুন) এবং আমি শিখি।” ("tell me and I forget, teach me and I may remember, involve me and I learn".) তার এ উক্তিটি ক্রিয়াকলাপ-ভিত্তিক শিক্ষার নিখুঁত যোগফল।
সুতরাং, ক্রিয়াকলাপ ভিত্তিক শিক্ষা হলো শিক্ষার্থীদের কার্য বা ক্রিয়াকলাপ সম্পাদনের মাধ্যমে শেখার প্রক্রিয়া। ইংরেজিতে এটি এক্টিভিটি বেজড লার্নিং (Activity Based Learning-ABL) হিসেবে ব্যাপক প্রসিদ্ধ। শিক্ষার্থীদের সহজভাবে শুনতে এবং নোট নিতে বলার বিপরীতে, ক্রিয়াকলাপ-ভিত্তিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদেরকে তাদের নিজস্ব শেখার অভিজ্ঞতায় অংশগ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করে। ব্যবহারিক ক্রিয়াকলাপ, প্রজেক্ট প্রস্তুতকরণ, সমস্যা সমাধান করা, শ্রেণিকক্ষের বাইরে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে শেখা ইত্যাদি ক্রিয়াকলাপভিত্তিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। এ শিক্ষা কৌশলগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে স্বাধীনভাবে জ্ঞানচর্চা, নিজের মেধা যাচাই, নিজস্ব যোগ্যতা পরীক্ষা করতে এবং আপন প্রক্রিয়ায় শিখতে উৎসাহিত করে। এ কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ, সমস্যা সমাধান এবং সৃজনশীলতার দক্ষতা দিয়ে সজ্জিত করার চেষ্টা করতে পারেন।
সহজ ভাষায়, ক্রিয়াকলাপ-ভিত্তিক শিক্ষা এমন একটি শিক্ষণ পদ্ধতিকে বোঝায় যেখানে বিষয়বস্তু বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়, যা শিক্ষার্থীদের জন্য শেখাকে আরো আকর্ষণীয় এবং আনন্দময় করে তোলে। এ ধরনের শেখার ক্ষেত্রে, শিক্ষার্থীরা হচ্ছেন শিক্ষা প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু এবং শিক্ষক শুধুমাত্র একজন সুবিধাদাতা হিসাবে কাজ করেন। এ শিক্ষণ কৌশলে শিক্ষকরা তাদের ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে শেখার পরিবেশ তৈরি করে দেন এবং তাদেরকে গাইড করেন। শিক্ষার্থীরা সেখানে স্বাধীনভাবে এবং তাদের নিজস্ব গতিতে শিখতে পারেন।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে প্রত্যেক ব্যক্তির শৈশবে শেখার সর্বোচ্চ সম্ভাবনা থাকে। কারণ মানুষের ৯০ শতাংশ মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটে পাঁচ বছর বয়সে। শৈশব একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়, কারণ জীবনের প্রথম ৮ বছর স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং ভবিষ্যতের সামগ্রিক জীবনের সাফল্যের ভিত্তি তৈরি করে। এটি শিশুদের শেখানোর জন্য সঠিক কৌশল বেছে নেয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়, যাতে তাদের সম্ভাবনা সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করা যায়। এটি একটি সুপরিচিত সত্য যে, শিশুরা স্বভাবগতভাবে খেলাধুলা করে এবং তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিখতে পছন্দ করে। এভাবে ক্রিয়াকলাপ-ভিত্তিক শিক্ষা অনিবার্যভাবে একটি শিশুর জ্ঞান অর্জন এবং ধরে রাখার সর্বোত্তম উপায়গুলোর মধ্যে একটি।
ক্রিয়াকলাপ ভিত্তিক শিক্ষা সৃজনশীল চিন্তার দক্ষতা বিকাশ করে। সমস্যা-সমাধান গেম, ওয়ার্ডগেম, কুইজ গেম এবং এবং অন্যান্য শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ক্রিয়াকলাপগুলো ব্যবহার করা শিশুদের নির্দিষ্ট বলয়ের বাইরে চিন্তা করার একটি দুর্দান্ত উপায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদেরকে সৃজনশীল এবং যুক্তির দক্ষতা তৈরি করতে ক্রিয়াকলাপ ভিত্তিক শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে এ শিক্ষা কৌশলের কয়েকটি উল্লেখ্যোগ্য উপকারিতার কথা বলা যেতে পারে:
১। ক্রিয়াকলাপ ভিত্তিক শিক্ষা একটি সক্রিয় আত্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে শিক্ষা। এখানে শিক্ষকের পরিবর্তে শিক্ষার্থীর শেখার প্রতি ফোকাস মনোনিবেশ করা হয়। এটি শিক্ষার্থীদের শিখন কর্মে জড়িত করে এবং তাদের নিজেদের জন্য কাজ করার সুযোগ করে দেয়।
২। এ শিক্ষা শিক্ষার্থীদেরকে তাদের জ্ঞান এবং চিন্তাভাবনা প্রকাশ করার উপায়ে সৃজনশীল হতে উৎসাহিত করে। ক্রিয়াকলাপ-ভিত্তিক শেখার পদ্ধতি শিক্ষার্থীদেরকে তারা যা শিখেছে তা প্রকাশ করার সুযোগ করে দেয় এবং মৌখিক উপস্থাপনা শক্তি বৃদ্ধি করে।
৩৷ ক্রিয়াকলাপ ভিত্তিক শেখা টিমওয়ার্ক দক্ষতা উন্নত করে এবং শিক্ষার্থীদেরকে ব্যবহারিক কাজে অন্তর্ভুক্ত হতে সাহায্য করে। বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে তাদেরকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করার মাধ্যমে আত্মবিশ্বাসী হতে উৎসাহিত করে এবং ক্লাসের প্রত্যেককে তাদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতে শেখায়।
৪। ক্রিয়াকলাপ ভিত্তিক শিক্ষা শিশুদেরকে বিভিন্ন শিক্ষাশৈলীর সঙ্গে সম্পৃক্ত করে, যা ভিজ্যুয়াল, শ্রুতি এবং গতিবিদ্যার শিক্ষার্থীদের উপকৃত করে। শিক্ষার্থীদেরকে যখন একটি কাজ বা প্রকল্প দেয়া হয়, তখন এটিকে সম্পন্ন করতে তারা শারীরিক এবং মানসিক উভয় ভাবেই এতে জড়িত থাকে। ফলে তারা আরো ভাল শেখার সুযোগ পায়।
৫। ক্রিয়াকলাপ-ভিত্তিক শিক্ষার একটি মূল বৈশিষ্ট্য হলো এটি ছেলেমেয়েদেরকে বাস্তব জীবনের পরিস্থিতিতে তাদের জ্ঞানের প্রয়োগ করতে সাহায্য করে এবং এইভাবে তারা শেখার সংস্থান এবং উপকরণগুলোর প্রাসঙ্গিকতা এবং উপযোগিতা প্রতিষ্ঠা করে।
৬। এ শিক্ষা কৌশল শিক্ষার্থীদেরকে আরো ভালো জ্ঞান ধারণ করার দিকে পরিচালিত করে। যেহেতু শিক্ষার্থীরা নিজেদের অন্বেষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শেখে, তাই শিক্ষাটি অভিজ্ঞতার একটি আউটপুট হয়ে ওঠে এবং এতে একটি স্বচ্ছতা থাকে।
প্রচলিত শিক্ষার শিক্ষকরা হলেন বক্তা এবং শিক্ষার্থীরা যেন নিষ্ক্রিয় শ্রোতা বা গ্রাহক। শিক্ষার প্রকৃত মান ধরে রাখতে এবং শিখনফল নিশ্চিত করতে ক্রিয়াকলাপ-ভিত্তিক শিক্ষার বিকল্প নেই। এ শিক্ষা কৌশল বিভিন্ন উপায়েই অবলম্বন করা যেতে পারে। ক্রিয়াকলাপগুলো ক্লাসের গঠন এবং যে বিষয় পড়ানো হবে তার ওপর ভিত্তি করে ডিজাইন করা যেতে পারে। ক্রিয়াকলাপ-ভিত্তিক শিক্ষাদানের সবচেয়ে সাধারণ উপায় হলো গ্রুপ ওয়ার্ক বা গ্রুপ আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া, যেখানে শিক্ষার্থীদের কয়েকটি দলে বিভক্ত করা হয় এবং তাদের জন্য কাজগুলো বরাদ্দ করে দেয়া হয়। প্রতিটি গ্রুপ নিজেদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া করে সমস্যা সমাধান বা কার্যকলাপ শেষ করার চেষ্টা করে। এছাড়াও, ধাঁধা, গেমস, রোল প্লে, স্কিট, গল্প বলা, বাস্তব বস্তু ব্যবহার করে প্রদর্শনী, শিক্ষার্থীদের একটি শিক্ষামূলক সফরে নিয়ে যাওয়া, একটি বিষয়-সম্পর্কিত ভিডিও চালানো, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কোন প্রজেক্ট দিয়ে ফিল্ড ওয়ার্ক করতে পাঠানো, শ্রেণিকক্ষে একটি ডকুমেন্টারি দেখানো, দলনেতা তৈরি করে নেতৃত্ব দক্ষতা শেখানো এবং ক্যারিয়ার দক্ষতা বৃদ্ধি করতে গ্রুপ স্টাডি করানো ইত্যাদি হলো ক্রিয়াকলাপ-ভিত্তিক শিক্ষার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
মোটকথা, শিক্ষার্থীদেরকে যত বেশি কার্যকলাপে সংযুক্ত করানো যায়, শিক্ষার্থীদের মধ্যে জানার আগ্রহ ততবেশি জাগ্রত হয়। শিক্ষকের তাত্ত্বিক কথা শিক্ষার্থীরা ভুলে যায়। তাদেরকে বাস্তবতা নির্ভর শিক্ষা দিলে তাদের মধ্যে যে সৃজনশীল চেতনা ও ক্রিটিকাল থিংকিং দক্ষতা অর্জিত হয়, শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যারিয়ার জগতে গিয়ে তার ফলাবর্তন আবিষ্কার করতে পারে। ক্রিয়াকলাপ ভিত্তিক শিক্ষা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে শিক্ষার অধিকার আইন দ্বারা ক্রিয়াকলাপ এ শিক্ষা কৌশলকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আমি মনে করি, আমাদের দেশেও শিক্ষা অধিকার আইনের আওতায় রেখে ক্রিয়াকলাপ ভিত্তিক শিক্ষা কৌশলকে বাধ্যতামূলক করা উচিত।
লেখক: প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ স্মার্ট এডুকেশন নেটওয়ার্ক (বিডিসেন)