বর্তমান সময়ে আমাদের অঞ্চলে সবচেয়ে যে বিষয় নিয়ে মানুষের ভেতর ক্ষোভ, হতাশা এবং উদ্বিগ্নতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। আমাদের অঞ্চলে কিছু অসাধু মানে যে ব্যক্তি তার ভেতরকার সাধুতাকে পরিত্যগ করেছে এমন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দ্রব্যমূল্যের বাজারকে তাদের হাতের পাশার ঘুঁটিতে পরিণত করেছে। যার ফলস্বরূপ দেখা যাচ্ছে বাজারে জিনিসপত্রের দাম অনিয়ন্ত্রিত গতিতে বেড়ে যাচ্ছে। মানুষ চাইলেই আর তার পছন্দের খাদ্যদ্রব্য যথাসম্ভব ক্রয় করতে পারনছে না। কারণ, দ্রব্যের ক্রয়ের সঙ্গে ব্যক্তির উপার্জনও জড়িত। আমাদের খাবার গ্রহণ ও খাবার নির্বাচনের ক্ষেত্রে সচেতনতাই আমাদেরকে এই চাপ থেকে মুক্ত করতে পারে। যা সুস্বাস্থ্যের জন্যও হতে পারে এক বিস্ময়কর উপায়।
একটি দেশের মানুষের খাদ্যাভাস সেই দেশের অর্থনীতি ও সুস্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষের খাদ্যাভাস অস্বাস্থ্যকর ও অনিয়ন্ত্রিত। খাবারের বিষয়ে বেশির ভাগ মানুষ উদাসীন। ফলে একটা সময় চিকিৎসক তাদের পছন্দের ওই সব খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দিলে তারা মোটামুটি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। কিন্তু যদি তারা আগে থেকেই সচেতন হতেন তাহলে শারীরিকভাবে আরো বেশি সুস্থ থাকতেন এবং মানসিকভাবেও থাকতেন উৎফুল্ল। খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে আমাদের শরীর ও মন দুটোই এক অদৃশ্য সার্কেলে আবদ্ধ যার ফলে খাদ্য যদি সুষম ও স্বাস্থ্যকর না হয় তাহলে শরীর ও মনও সেক্ষেত্রে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয় না।
খাবার অপচয়ের দিকেও আমরা বিশ্বে যথেষ্ট এগিয়ে আছি। বাংলাদেশে বাসাবাড়িতে একজন ব্যক্তি গড়ে বছরে ৮২ কেজি খাবার অপচয় করেন, যা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও ভারতের চেয়ে বেশি। বিশ্বে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে মোট অপচয় হওয়া খাবারের পরিমাণ ১০০ কোটি টনের বেশি, যা বিশ্ববাজারে আসা মোট খাবারের পাঁচ ভাগের এক ভাগ।
সমপ্রতি জাতিসংঘের ‘খাবার অপচয় সূচক প্রতিবেদন ২০২৪’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচির (ইউএনইপি) ওয়েবসাইটে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। খাবারের এ অপচয়কে ‘বৈশ্বিক ট্র্যাজেডি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
আমরা এখন যে পরিস্থিতিতে এসে পৌঁছেছি এই অবস্থায় আমাদের অবশ্যই ‘মাইন্ডফুল ইটিং’ নামক যে খাদ্য পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী সচেতন দেশসূমহ এবং দেশের মানুষ গ্রহণ করেছে এই গুরত্বপূর্ণ খাদ্যাভাস পদ্ধতিকে গ্রহণ করা উচিত, যা একদিকে আমাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করবে, খাদ্য অপচয় রোধ করবে, অপরদিকে শারীরিকভাবে যার গুরুত্ব অবর্ণনীয়।
মাইন্ডফুল ইটিং এর আগে আমাদের জানতে হবে আমরা আসলে কোন খাদ্য পদ্ধতিতে আছি। আমরা মূলত ‘ইমোশনাল ইটিং’ নামক পদ্ধতিতে খাদ্য গ্রহণ করে থাকি। তাহলে ইমোশনাল ইটিংটা আসলে কী? ইমোশনাল ইটিং-এর কিছু বিশেষ চরিত্র রয়েছে। যা দেখে সমস্যাটিকে শনাক্ত করা যায়।
খিদে না পেলেও খাবার খাওয়ার প্রবণতা, অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার ইচ্ছে, ঘন ঘন খাবার খাওয়ার ইচ্ছে, দ্রুত খাবার খাওয়া, খাবার খাওয়ার সময় অন্য কাজ বা চিন্তা করতে থাকা, শরীর খারাপ হতে পারে জেনেও খাওয়া, খাবারটা খেয়ে মন ভালো লাগছে এমনটা মনে হওয়া, আদৌ মনের সেই ভালো লাগা স্থায়ী না হওয়া!
ইমোশনাল ইটিং এর ফলে শরীরের ওজন বাড়তে থাকে, বিভিন্ন রোগ দেখা দিতে থাকে, এমনকি মানসিক সমস্যাও হতে পারে, দেখা দিতে পারে দুশ্চিন্তা ও অবসাদের মতো সমস্যা। তাহলে দেখা যাচ্ছে আমাদের অঞ্চলের বেশিভাগ মানুষ এই ইমোশনাল ইটিংকে নিজের অজান্তে ফলো করছে।
এই ইমোশনাল ইটিং এর বিপরীতে বিশ্বের সচেতন দেশ ও মানুষ গ্রহণ করেছে ‘মাইন্ডফুল ইটিং’ এই মাইন্ডফুল ইটিং হচ্ছে ইমোশনাল ইটিং এর বিপরীত খাদ্য ধারণা, যা মানুষ দেহ এবং মনের প্রয়োজনীয়তা অনুসারে উপযুক্ত ব্যবস্থা।
মাইন্ডফুল ইটিং আসলে কী? ইমোশনাল ইটিং-এর ঠিক উল্টোটা হলো মন দিয়ে খাওয়া বা মাইন্ডফুল ইটিং। ইমোশনাল ইটিং-এ অনেকেই মনে করেন, পেট ঠিকমতো ভরেনি বলে আবার খাচ্ছেন। কিন্তু আসল বিষয়টি হল মন দিয়ে খাওয়া হয়নি। খাবার খাওয়ার সময় মন রাখতে হবে খাবারেই। পাতে থাকা খাবারের স্বাদ অনুভব করতে হবে প্রতি গ্রাসে। অন্য কাজ করা যাবে না। ভাবা যাবে না অন্য কিছু। ইটিং মাইন্ডফুল হলে ইমোশনাল ইটিং-এর সমস্যা অনেকটাই কমে। তাই চিকিৎসকেরা এই পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
খাদ্য শুধু দেহের তৃপ্তির জন্য নয় খাদ্য মনেরও তৃপ্তির বড় কারণ। সেক্ষেত্রে মাইন্ডফুল ইটিং একটি উচ্চ ধারণা। আমরা নিজের অজান্তেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গল্পে গল্পে বা পেট ভরানোর জন্য বেশি পরিমাণ খাবার খেয়ে ফেলি যা স্বাস্থ্যের জন্য মোটেও ভালো নয়। কিন্তু পুষ্টিবিদরা বলছেন, পরিমাণে কম খাবার খেয়েও কিন্তু মনের দিক থেকে ভালো থাকা যায়। যদি খাবারের সঙ্গে সেই সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব হয়।
পুষ্টিবিদদের মতে, এই অভ্যাস শুরু করতে হবে বাজারের তালিকা করার সময় থেকেই। কোন খাবারের কেমন পুষ্টিগুণ তা জেনে, তবেই কিনবেন। এ ছাড়া সারাদিন নির্দিষ্ট সময় অন্তর অল্প পরিমাণে খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। পাশাপাশি যখন যে খাবারই খান তার স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ-সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে গ্রহণ করতে হবে। সব খাবার সময় নিয়ে চিবিয়ে, মনোনিবেশ করে খাওয়া অভ্যাস করতে হবে।
অনেক বেশি পরিমাণ খাওয়ার চেয়ে অল্প পরিমাণ মন দিয়ে ও পুষ্টিমান যাচাই করে খেলে শরীর ও মন যেমন বেশি পুষ্টি পায় তেমনি কাজ করার জন্য যথেষ্ট শক্তির যোগানও পাওয়া যায়। জাপানি এক খাদ্য বিশেষজ্ঞ একবার বলেছিলেন, ‘খাদ্য এমন এক জিনিস, যা মানুষ বুঝতেই পারে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খাবারই মানুষকে খেয়ে ফেলে এবং খাবার নিজে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর সেই খাবার নামক দৈত্য থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে মানসিক নিয়ন্ত্রণ।’
যুক্তরাষ্ট্রের আরেক দল গবেষক বলেছেন, ‘শরীরে প্রাণ ধারণের জন্য খাবার অপরিহার্য কিন্তু সেই খাবার যদি শরীরের প্রয়োজনের মাত্রাকে অতিক্রম করে এবং শরীরের প্রয়োজনের বাইরে অযাচিতভাবে গ্রহণ করা হয় তাহলে সেই খাবারই শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। মানুষ যখন বুঝতে পারে তখন আর তার খাবারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো সময় অবশিষ্ট থাকে না।’
তাহলে দেখা যাচ্ছে আমরা যদি এখনই খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে মাইন্ডফুল ইটিংকে ফলো করি তাহলে এক দিকে যেমন স্বাস্থ্যের উপকার নিশ্চিত হবে এবং সেই সঙ্গে আমরা অর্থনৈতিকভাবেও হবো লাভবান। সেই সঙ্গে যে সকল অসাধু ব্যবসায়ী খাদ্য নিয়ে বানিজ্য করছে তারাও তাদের এই অপকর্ম চালিয়ে যেতে পারবে না। তাই আমাদের এখনই সময় খাদ্য গ্রহণের বিষয়ে যথার্থ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার তাহলেই আমরা হতে পারবো একটি সুস্থ দেহ ও সুন্দর মনের অধিকারী।
লেখক: কলামিস্ট ও গবেষক