গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর তিন দিন কার্যত দেশে কোনো সরকার ছিলো না। চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি উতরিয়ে যখন স্বাভাবিক হতে শুরু হলো তখন থেকেই প্রতিপক্ষ দমনে সেই পুরনো ধারার আশ্রয়। ‘ভুয়া মামলা’, গায়েবি মামলার আদলে ঢালাও মামলা। যেসব মামলায় ঢালাও আসামি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ সেসব মামলায় ঘটনার সঙ্গে বিন্দুমাত্র সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও চলতে থাকে এসব মামলায় ‘বাণিজ্য’।
বিগত সরকারের আমলে যে অভিযোগ করেছে তৎকালীন বিরোধী দলগুলো। এখন সেই একই কাজ করে প্রতিপক্ষ দমনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আদতে এখন প্রতিপক্ষ কারা? যারা রাজনীতিতে কখনোই বেনিফিশিয়ারি না তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে কি ফায়দা আদায় করা যাবে? মূলত অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতেই তেমনটি করা হচ্ছে বলেও পত্রিকায় খবরও আসছে। যদিও পুলিশের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে বলা হয়েছিলো ঢালাও মামলা হলেও যেনতেন গ্রেফতার নয়। যদিও সে কথা খুব একটা মানা হচ্ছে বলেও মনে হয় না। আরো বলা হয়েছিলো সম্পৃক্ততা না থাকলে গ্রেফতার নয়। সেটাও রক্ষা করা হচ্ছে না। যেহেতু পতিত সরকারের কর্মী, সমর্থক, নেতা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় রয়েছে। তারা সবাই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন, ধরে নেয়ার যুক্তিযুক্ত কোনো কারণও নেই। তাহলে কেনো এতো এতো ঢালাও মামলা? শুধুই কি পদ-পদবির কারণে মামলায় জড়ানো হচ্ছে?
যেসব ঘটনায় থানায় অভিযোগ কিংবা এজাহার দেয়া হয় সেসব মামলায় অভিযোগ যদি সুনির্দিষ্ট না হয় তবে এইসব মামলার ভবিষ্যৎই বা কী? যদিও মামলার তদারকি কিংবা মামলা করতে অভিযোগ লেখা সবই মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা বিএনপি-জামায়াতই করেছে বলেও নানা মহল থেকে অভিযোগ আছে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় বাদী বা এজাহারকারী কি এতো এতো লোকের নাম-ধাম সংগ্রহ কিংবা প্রত্যক্ষদর্শী কিংবা আসামিদের সবাইকে চেনেন। যেহেতু আন্দোলনে হাজার হাজার লোক জড়ো হয়েছিলো সেক্ষেত্রে কয়জনকে চিনতে পারবেন? আর কয়জনেরই বা নাম জানেন? যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে, বিভিন্ন ভিডিয়ো ফুটেজ দেখে তিনি বা তারা চিনবেন বা চিনেছেন তাহলে কী দাঁড়ায়?
যারা আন্দোলনের সময় মিটিং, প্রতিবাদ সভা কিংবা অস্ত্রবাজি করেনি তাদের নাম কে বা কারা সরবরাহ করলো? আন্দোলনে কারা অস্ত্র হাতে মহড়া দিয়েছে সেটা নিশ্চয়ই এতোদিনে পরিষ্কার কিংবা খোলাসা হয়েছে। যদি না-ও হয় তবে সেটাও তদন্তে প্রকাশ পাবে বলেও যারা বিশ্বাস রাখছেন তাদের কি আদতে সঠিক তদন্তে ‘নট-সেন্ট-আপ’ করা হবে?
একটা মামলা দেখা যায় অনেককে আসামি শ্রেণিভুক্ত করা হয়। সেইসব মামলায় যদি রাজনৈতিক প্রভাব না থাকে আর পুলিশ নির্মোহ তদন্ত করে রিপোর্ট দিয়ে আসামি হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ১০-২০ জন। আর এসব মামলায় ঘটনাস্থল অনেকটা কাছাকাছি তাই বলে সব এজাহারের বক্তব্য অনেকটা একই হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র এজাহারকারীর নামই পরিবর্তিত হয়েছে। আর প্রায় সব মামলায় আসামিও ঘুরেফিরে একই, যা নিছকই হঠকারী। কারণ, ক্রিমিনাল মামলায় কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে মামলার অভিযোগ লিখতে হয়। তার ব্যত্যয় ঘটলে মামলা প্রমাণ করাও দুষ্কর।
এ পর্যন্ত সারাদেশে ৫ শতাধিক মামলা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ১০-২০ হাজার। অজ্ঞাতনামা রয়েছে তারও বেশি। এই সব মামলায় বেশির ভাগ আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ অন্যান্যরা। সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতারা। পাশাপাশি নিরীহ কিছু লোককেও আসামি করার খবর পাওয়া গেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়াও হত্যা মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি। এ মামলাটি করা হয়েছে ঢাকার সিএমএম আদালতের রামপুরা থানার আমলি আদালতে। এই হত্যা মামলার বাদী মোছা. সুফিয়া বেগম। তিনি বলছেন ৪৯ নং ক্রমিকের আসামিকে তিনি চেনেন না। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন তারপরও তিনি অভিযুক্ত। আর ফৌজদারি মামলার আসামি সরকারের উপদেষ্টা নিয়োগ পাওয়ায় সাধারণের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করার অবকাশ রয়েছে। তিনি যদি পদে থাকা অবস্থায় আসামি হতেন তা হতো ভিন্ন। কিন্তু ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি শপথ নিলেন পুলিশের নাকের ডগায়! তাহলে কি আইন মানুষ ভেদে ভিন্ন? সবার জন্য সমান সুযোগের যে দাবি তা কি ভূলুণ্ঠিত হয় না?
সরকার থেকে যদিও স্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, সরকার কোনো মামলা করছে না। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি মামলা করছেন। আর সেক্ষেত্রে বিগত সরকারের ন্যায় গায়েবি মামলা হচ্ছে, যা ঢালাও মামলা হিসেবে অভিহিত করে বলা হচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে সরকার বিব্রত! এ ক্ষেত্রে আইন উপদেষ্টা হিসেবে আসিফ নজরুলের কথাই ধরে নেয়া যায় সরকারের বক্তব্য। সেক্ষেত্রে সরকারের কি কিছুই করণীয় নেই? আমার তো মনে হয় সরকার এক্ষেত্রে একটা সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে পারে। আনীত মামলায় তদন্ত সাপেক্ষে এফআইআর হিসেবে গ্রহণের। নচেৎ দেখা যাবে একই ঘটনায় একাধিক মামলা হয়েছে। আর এজাহারকারী কিংবা বাদী যা-ই বলি না কেনো কেউ কাউকে না চিনেও মামলায় বাদী হয়ে বসে আছেন। যদিও আইনে একই ঘটনার একাধিক মামলার ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধিতে নির্দেশনা দেয়া আছে। কিন্তু যদি আসামি ভিন্ন ভিন্ন হয়? সেক্ষেত্রে কী উপায় অবলম্বন করবে? যদি থানায় এফআইআর হয় সেক্ষেত্রে দুটি মামলা বা একাধিক মামলা হলে এক সঙ্গে কিংবা একই তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত করার বিধান আছে। সিআর মামলা থানায় আসার আগেই তো আসামির তালিকায় নাম দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতে পারে চক্র। থানার মামলার ক্ষেত্রেও তেমন হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আবার মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে কেউ যদি সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে কোনো রিট করে বসেন সেক্ষেত্রে কি হতে পারে বলে ধারণা করা যেতে পারে। যদিও ভুক্তভোগী উচ্চ আদালতের বারান্দায় ঘুরে ঘুরে হয়রান হয়ে ক্ষান্ত দিয়েছেন। অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। যারা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে আসামি হয়েছেন অথবা অন্য কোনো ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের জন্যই আসামি করা হয়েছে। সংগত কারণেই তারা নিম্ন আদালতে হাজির হয়ে জামিন প্রার্থী হতে পারছেন না। আইনগত চর্চার কারণে নিম্ন আদালত জামিন না দেয়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকায় উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন।
উচ্চ আদালত অধিকাংশ মামলায় শুনতে অপারগতা প্রকাশ করছেন। শুধুমাত্র একটা বেঞ্চ শুনানির জন্য ফাইল গ্রহণ করলেও এতো বেশি ফাইলের স্তুপ যে, যারা জমা দিচ্ছেন তারা হয়তো আগামী ছয় মাসের মধ্যেও তারিখ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। এর মধ্যে যদি কেউ গ্রেফতার হয়ে যান তবে আইনি মারপ্যাঁচে পড়ে অন্যূন তিন মাস হয়তো জেল খেটে ফেলবেন। আর এই অবস্থা যদি নিরপরাধ কোনো ব্যক্তির সঙ্গে ঘটে থাকে, তবে এর দায় কে নেবে? ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির শুধু শারীরিক, মানসিক কিংবা আর্থিক নয় সামাজিক ও পারিবারিক মর্যাদাহানি ঘটলে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
রেশ বয়ে বেড়াতে হবে যুগযুগ। আবার পুলিশ যে যথাযথ তদন্ত করে সেই ব্যক্তি বিশেষকে ‘নট-সেন্ট-আপ’ করবে সে আশাও ক্ষীণ। কারণ, ঠিক পরবর্তী সরকার যদি বিএনপি গঠন করবে ধরে নিই। তাহলে এসব মামলার চালিকাশক্তিও বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃত্ব। তাহলে সেই অবস্থায় সরকারি দলের নেতাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পুলিশ সত্য প্রকাশ করবে এমনটা ধারণা করাও যে বোকামি। আদতে সরকার পরিবর্তন হলেও পুলিশ সেই একই আছে। নৈতিক কোনো পরিবর্তন দেখা যাবে বলে মনে হয় না।
এই আলোচনার অর্থ এই নয়, যেসব হত্যা সংঘটিত হয়েছে সেগুলো হয়নি। মূলত হত্যা হয়েছে যেমন সত্য তেমন এজাহারকারীও এতো এতো অভিযুক্ত আসামি চেনাও দুঃসাধ্য। তাই বলে এতোসব নাম-ধাম সংগ্রহ করে থানায় কিংবা আদালতে নালিশ আনয়ন মোটেই সহজসাধ্য নয়। আর কিছু দুষ্কৃতকারী সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটতে ব্যস্ত। আবার কেউ কেউ তদন্তকালীন সময়ে নাম বাদ দিতে লেনদেন করতে ছক কষছেন। তাহলে কী দাঁড়ায়? সোজাসাপ্টা কথা হচ্ছে ‘মেলার কারবার, ধুলায় অন্ধকার’। কেউ ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে আর কেউ রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত।
এরই মধ্যে দিয়ে ভুক্তভোগীর যা হওয়ার হয়ে যায়। কখনো পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি জেলে থাকলে কি নিদারুণ কষ্ট পোহাতে হয় তা কেবলই ভুক্তভোগী ও তার পরিবার জানে। আইন পেশায় না এলে তেমনটা খুব জানা না হলেও একেবারে যে অভিজ্ঞতা নেই তা নয়। কোনো অপরাধ ছাড়াই আমার পরিবারের এক সদস্য যখন সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার, তখন ঢের টের পেয়েছিলাম। যদিও সেই মামলায় দায়রা আদালত থেকে খালাস পেয়েছিলেন।
কিন্তু শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত হয়েছিলো। তা কি কেউ ফিরিয়ে দিতে পেরেছিলো? সামাজিক মর্যাদা কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে? যে গ্লানি বয়ে বেড়াতে হয়েছে, তা? নিজের মনের কষ্ট বুকে চেপে এলাম আইন পেশায়। এসে দেখি আরো দুরবস্থার চিত্র।
একদিকে সরকারের কাছে নিত্যনতুন দাবি। যে দাবি আদায়ে উপর্যুপরি চাপ। অন্যদিকে সরকারের কাজেও মানুষ সন্তুষ্ট বলে মনে হচ্ছে না। শুরু থেকেই বিতর্ক যেনো পিছু ছাড়ছে না এই সরকারের। যতোটুকু আশা নিয়ে মানুষ সরকার পরিবর্তন চেয়েছে ঠিক ততোটুকুই হতাশ করেছে। যেটা উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের কথায়ও স্পষ্ট হয়।
যিনি অকপটে বলে ফেললেন, আগে সরকারের সমালোচনা করতাম আর মানুষ মাথায় তুলে নাচতো। এখন এতো কাজ করি শুধু সমালোচনা পাই। তিনি অনেকটা অনুযোগ নিয়েই মিডিয়ায় কথাগুলো বললেন। তাতে কি বোঝা যায়? যতো যা-ই কাজ করুক সমালোচনা থাকবে। সমালোচনা কেউ বন্ধ করতে পারবেও না। আর এতে করেই সরকার সঠিক পথে পরিচালিত হবে।
নতুন তিন উপদেষ্টার মধ্যে দুই উপদেষ্টাকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। তাদের অপসারণ চেয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সরকারের অন্য কেউ এতে মুখ খুলছেন না। কেবল মিডিয়ার চাপাচাপিতে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নিজের অবস্থান স্পষ্ট করলেন। তাতে কি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সন্তুষ্ট? তাদের কর্মকাণ্ড এবং বক্তব্যে পরিষ্কার তারা সরকারের এই উপদেষ্টাকে ফ্যাসিবাদের দোসর মনে করে। আর তাকে অপসারণের প্রতিবাদে আয়োজিত সভা থেকে চট্টগ্রামে পাঁচজন আটক করায় ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ক্ষেপেছেন। দেখা যাক এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান কি হয়?
যদিও এতোদিন যা দাবি করেছে তা-ই বাস্তবায়িত হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে ছাত্র-জনতার ব্যানারকে অনেকেই ভেবে নিয়েছিলেন মাঠে প্রেসার গ্রুপ হিসেবে থেকে সরকারের কাজকে বেগবান করতে সহায়তা করবেন তারা। কার্যত হলো উল্টো! প্রথম হোঁচট খেলো রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে অপসারণ ইস্যুতে। এতে সরকার দাবি কানেই তোলেনি। মাঠের আরেক সক্রিয় গ্রুপ রাজনৈতিক দল হিসেবে শক্তপোক্ত অবস্থানে থাকায় সাংবিধানিক সংকটের আশঙ্কা করে রাষ্ট্রপতি অপসারণের পক্ষে সায় দেয়নি।
আমরা দেখতে চাই সুস্থির বাংলাদেশ। রাজনীতির পট পরিবর্তন যেনো মানুষের কল্যাণে হয়। মানুষকে যেনো আর দুশ্চিন্তায় দিনাতিপাত করতে না হয়। সরকার আসবে যাবে জনগণ থাকবে। কেউ যেনো জনগণকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে। শাসক নয় প্রকৃত সেবকের হাতেই উঠুক দেশ পরিচালনার ভার। এর মধ্যে যাতে কেউ অনাচার কিংবা অবিচারের শিকার না হন। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
লেখক: অ্যাডভোকেট