বিখ্যাত শিক্ষাবিদ, কবি ও গীতিকার, গবেষক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এর মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট যশোর শহরের খড়কী পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মোহাম্মদ শাহাদাত আলী, মাতা রাহেলা খাতুন।
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স ও এমএ পাস করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রথমে শিক্ষক-ফেলো, পরে লেকচারার পদে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রফেসর পদে উন্নীত হন। ১৯৭৮-৮১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান দৈনিক মিল্লাত পত্রিকার সাহিত্য-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সাহিত্য-গবেষণা এবং কবিতা লেখা ছিলো তার নেশা। কিছুকাল তিনি বাংলাদেশের লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও সম্পাদনায় আগ্রহ দেখালেও পরে তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। আধুনিক কাহিনীকাব্যে মুসলিম জীবন ও চিত্র তার প্রথম গবেষণাগ্রন্থ। তিনি ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘আধুনিক বাংলাকাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভ লিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৬৯-৭০ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডন বিশ্বাবদ্যালয়ের School of Oriental and African Studies-এ Post-Doctoral গবেষণা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা কালে তিনি বাংলা বিভাগ থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণায় এটি ছিলো একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা।
সৃজনশীলতায় মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন পঞ্চাশের দশকের কাব্যসাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান কবি। ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় সমকাল পত্রিকার মধ্য দিয়ে নতুন একটি কবিগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে। এ কবিগোষ্ঠীর অন্যতম ছিলেন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। তার কাব্য: দুর্লভ দিন, শঙ্কিত আলোকে, বিপন্ন বিষাদ, ভালবাসার হাতে, ভূমিহীন কৃষিজীবী ইচ্ছে তার, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান কাব্য সংগ্রহ প্রভৃতি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে কাজী নজরুল ইসলাম পর্যন্ত বাংলা আধুনিক গানের উত্তরাধিকার যারা বহন করছেন, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান তাদের মধ্যে অন্যতম। কবি হিসেবে তার বিশিষ্টতা স্বীকার করেও বলা যায় আধুনিক গান রচনায় তার ভূমিকা অনন্য। তিনি চলচ্চিত্রের প্লে-ব্যাক এবং দেশাত্মবোধক গান রচনা করে বাঙালি শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় ও সম্মানিত হয়েছেন। বলা যেতে পারে গান রচনার জন্যেই তিনি বাঙালি সংস্কৃতিতে স্মরণীয় হবেন দীর্ঘদিন। তার জননন্দিত একটি গানের কয়েক পঙ্ক্তি: ‘আমার দেশের মাটির গন্ধে/ ভরে আছে সারা মন/ শ্যামল কোমল পরশ ছাড়ায়ে/ নেই কিছু প্রয়োজন।’ স্বদেশের সরস মাটির গন্ধ যেনো তার ভাষায় বাণীমূর্তি লাভ করেছে।
অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে আত্মগোপনে থাকার কারণে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং ‘বি’ জোনের সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খান এক ফরমান জারি করে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন এবং ছয় মাস কারাদণ্ড ঘোষণা করেন। এসব সত্ত্বেও তিনি গভীরভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনড় থাকেন।
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক পদক ও পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে লাভ করেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।