প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের জন্মবার্ষিকী আজ। এই মহান দার্শনিকের সম্পর্কে তথ্য লিখিতভাবে পাওয়া যায় কেবলমাত্র তার শিষ্য প্লেটোর ডায়ালগ এবং সৈনিক জেনোফনের রচনা থেকে। তৎকালীন শাসকদের কোপানলে পড়ে তাকে হেমলক বিষ পানে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
তাকে পশ্চিমি দর্শনের ভিত্তি স্থাপনকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তিনি এমন এক দার্শনিক চিন্তাধারার জন্ম দিয়েছেন যা দীর্ঘ ২ হাজার বছর ধরে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, দর্শন ও সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছে। সক্রেটিস ছিলেন এক মহান সাধারণ শিক্ষক, যিনি কেবল শিষ্য গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানে বিশ্বাসী ছিলেন না।
তার কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষায়তন ছিলোনা। যেখানেই যাকে পেতেন তাকেই মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর বোঝানোর চেষ্টা করতেন। তিনি মানব চেতনায় আমাদের ইচ্ছাকে নিন্দা করেছেন, কিন্তু সৌন্দর্য দ্বারা নিজেও আনন্দিত হয়েছেন।
প্লেটোর বর্ণনামতে সক্রেটিসের বাবার নাম সফ্রোনিস্কাস এবং মায়ের নাম ফিনারিটি যিনি একজন ধাত্রী ছিলেন। সক্রেটিস ৪৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসের এথেন্স নগরীতে এলোপাকি গোত্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ঠিক কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করতেন তা পরিষ্কার নয়। ফিলাসের টিমোন এবং পরবর্তী আরো কিছু উৎস অনুসারে প্রথম জীবনে তিনি তার বাবার পেশা অবলম্বন করেছিলেন।
তার বাবা ছিলেন একজন ভাস্কর। সে হিসেবে তার প্রথম জীবন কেটেছে ভাস্করের কাজ করে। প্রাচীনকালে অনেকেই মনে করতো গ্রিসের অ্যাক্রোপলিসে দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত বিরাজমান ঈশ্বরের করুণা চিহ্নিতকারী মূর্তিগুলো সক্রেটিসের হাতে তৈরি।
অবশ্য বর্তমানকালের বুদ্ধিজীবীরা এর সুনির্দিষ্ট প্রমাণ খুঁজে পাননি। অপরদিকে সক্রেটিস কোনো পেশা অবলম্বন করেননি এমন প্রমাণও রয়েছে। জেনোফোন রচিত সিম্পোজিয়ামে সক্রেটিসকে বলতে শোনা যায়, তিনি কখনো কোনো পেশা অবলম্বন করবেন না, কারণ তিনি ঠিক তা-ই করবেন যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন আর তা হচ্ছে দর্শন সম্বন্ধে আলোচনা।
এরিস্টোফেনিসের বর্ণনায় দেখা যায় সক্রেটিস শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ নিতেন এবং গ্রিসের চেরিফোনে একটি সোফিস্ট বিদ্যালয়ও পরিচালনা করতেন। তার দ্য ক্লাউডস্ রচনায় এই ভাষ্য পাওয়া গিয়েছে। আবার প্লেটোর অ্যাপোলজি এবং জেনোফোনের সিম্পোজিয়ামে দেখা যায় সক্রেটিস কখনোই শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ নেননি।
বরঞ্চ তিনি তার দারিদ্র্যের দিকে নির্দেশ করেই প্রমাণ দিতেন যে, তিনি কোনো পেশাদার শিক্ষক নন।
প্লেটোর ডায়ালগগুলোর বিভিন্ন স্থানে লেখা হয়েছে যে, সক্রেটিস কোনো এক সময় সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। প্লেটোর বর্ণনায় সক্রেটিস বলেন, তিনি তিন তিনটি অভিযানে এথেনীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।
এই অভিযানগুলো সংঘটিত হয়েছিলো যথাক্রমে পটিডিয়া, অ্যাম্ফিপোলিস এবং ডেলিয়ামে। সিম্পোজিয়ামে আলসিবিয়াডিস নামক চরিত্র বর্ণনা করে পটিডিয়া এবং ডেলিয়ামের যুদ্ধে সক্রেটিসের বীরত্বের কথা এবং এর আগের যুদ্ধে তিনি কীভাবে নিজের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন সেকথা।
ডেলিয়ামের যুদ্ধে তার অসাধারণ অবদানের কথা লাকিস নামক রচনাতেও বর্ণিত হয়েছে। মাঝেমধ্যেই সক্রেটিস বিচারালয়ের সমস্যাকে যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন একজন বিচারক দর্শন থেকে সরে আসবেন কি-না তা ভেবে দেখা তেমনই প্রয়োজন যেমন উপযুক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করবে কি-না তা একজন সৈন্যের ভেবে দেখা প্রয়োজন।
সক্রেটিস দেখতে মোটেও সুদর্শন ছিলেন না। টাকবিশিষ্ট মাথা, চ্যাপ্টা অবনত নাক, ছোটো ছোটো চোখ, স্ফীত উদর এবং অস্বাভাবিক গতিভঙ্গির সমন্বয়ে গঠিত ছিলো তার সামগ্রিক চেহারা। দেহের শ্রী তেমন না-থাকলেও তার রসবোধ ছিলো প্রখর। অধিকাংশের বর্ণনামতেই তিনি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা প্রদান করতেন না। রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজারই ছিলো তার শিক্ষায়তন। দর্শন অনুশীলন করতে গিয়ে সংসার ও জীবিকা সম্পর্কে খুবই উদাসীন হয়ে পড়েছিলেন তিনি। এ কারণে শেষ জীবনে তার পুরো পরিবারকেই দারিদ্র্য ও অনাহারের মধ্যে জীবন-যাপন করতে হয়। বেশিরভাগ সময়েই তিনি তার শিষ্যদের বাড়িতে পানাহার করতেন।
সক্রেটিস ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্সে অশুভতা এবং তরুণদের দুর্নীতির বিচারের পর মারা যান যা মাত্র এক দিনের জন্য স্থায়ী হয়েছিলো। তিনি তার শেষ দিনটি কারাগারে বন্ধু এবং অনুসারীদের মধ্যে কাটিয়েছেন যারা তাকে পালানোর পথ প্রস্তাব করেছিলেন, যা তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
পরের দিন সকালে তার সাজা অনুসারে হেমলক বিষ পান করে তিনি মারা যান। শুধুমাত্র সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণ ছাড়া তিনি কখনোই এথেন্স ছেড়ে যাননি।