ঘুষ-দুর্নীতির সিন্ডিকেটে শিক্ষা - দৈনিকশিক্ষা

ঘুষ-দুর্নীতির সিন্ডিকেটে শিক্ষা

মাছুম বিল্লাহ |

আমার কাজ যেহেতু শিক্ষা নিয়ে, তাই শিক্ষকদের সঙ্গেই ওঠা-বসা। শিক্ষা নিয়েই মূল লেখালেখি তাই শিক্ষকেরা প্রায়ই প্রশ্ন করতেন এবং প্রস্তাব রাখতেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এটা জানানো যায় কি না, ওটা পরিবর্তন করার প্রস্তাবনা পাঠানো যায় কি না। শিক্ষার কারিকুলাম মডারেট করা, পরিবর্তন করা এবং শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকেরা কে কী চাচ্ছেন তা মন্ত্রী মহোদয়কে জানানো যায় কি না ইত্যাদি। আমি তাদেরকে প্রায়ই আকার ইঙ্গিতে এবং মাঝে মাঝে সরাসরিই বলতাম যে, আপনি আমি বা আমাদের মতো যারা শিক্ষা নিয়ে, শিক্ষার্থী নিয়ে, শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে, অভিভাবকদের শিক্ষা সম্পর্কে মতামত নিয়ে যতো চিন্তা করি, আলোচনা করি না কেনো তাতে শিক্ষা বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের এসব চিন্তা করা বা আলোচনা করার সময় নেই, তাগিদ নেই। কে কী পড়লো বা না পড়লো, কে কীভাবে শিখলো বা না শিখলো তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। প্রথমত তাদের চিন্তা আলাদা, তাদের উদ্দেশ্য আলাদা। দ্বিতীয়ত, তাদের সন্তানরা এদেশে কিংবা এদেশের কারিকুলামে লেখাপড়া করে না। অতএব দেশের পড়াশুনা নিয়ে তাদের চিন্তা করার কোন কারণ নেই, অবকাশ নেই। একটি জাতীয় দৈনিকে শিক্ষার দুর্নীতি বিশেষ করে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির দুর্নীতির চিত্র ও ব্যপ্তির কথা পড়ে পুরোটাই স্পষ্ট হয়ে গেলো।

তিনি যখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিচালনা করছিলেন তখনো শিক্ষা বিভাগের দুর্নীতির খবর বহু বাধা- ভয়-ভীতির পরেও কিছু কিছু বেড়িযে আসতো। আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখেছি চাঁদপুর বিশ্ববিদ্যালয় ভূমি অধিগ্রহণে ঘুষ কাণ্ড! সেখানকার ডিসি এর বিরোধিতা করায় ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাকে বদলির কাণ্ড! এখন যেহেতু একটু পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তাই শিক্ষা বিভাগের দুর্নীতির খতিয়ান বের হতে শুরু করেছে এবং আমরা যে বলতাম তাদের শিক্ষা নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই, তাদের চিন্তা অন্যদিকে সেসব বিষয় এখন পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে। গত ২৩ আগস্ট ২০২৪ একটি বাংলা জাতীয় দৈনিক দীপু মনির দুর্নীতির একটি প্রতিবেদন ছেপেছে। তাতে লেখা ‘দীপু মনির দুর্নীতি ও অপকর্মের মূল সহযোগী ছিলেন তার ভাই ওয়াদুদ টিপু। এ টিপুর নেতৃত্বে প্রথমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়। চক্রে চাঁদপুর পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদারও ছিলেন।’ দীপু মনির টাকার মেশিন ছিলেন চাঁদপুর সদরের লক্ষীপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সেলিম খান ওরফে চোরা সেলিম। তার মাধ্যমে চাঁদপুর বালুমহাল থেকে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন দীপু মনি ও তার ভাই। 

প্রতিবেদনে আরো জানা যায় যে, শিক্ষামন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালীন ক্ষমতার অপব্যবহার করে দীপু মনি পাঁচটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কুক্ষিগত করেন। শিক্ষাখাতে ঘুস দুর্নীতির বিষয় টিপু ছাড়াও স্থানীয়ভাবে দেখতেন চাঁদপুর পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার। টিপু ও রতন মিলে সব বদলি, নিয়োগসহ মন্ত্রণালয়ের নানা কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ পর্যন্ত তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ ছিলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগের জন্য দুই কোটি টাকা এবং কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য তিনি ৫৫ লাখ টাকা ঘুস নিতেন। আর দুই লাখ থেকে বিশ লাখ টাকা কেনা বেচা হতো শিক্ষা প্রশাসনের নানা পদ।  

রাজধানীর কলাবাগান ও বনানীতে ছায়া অফিসের মাধ্যমে দীপু মনির মন্ত্রণালয়ের অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করত তার ভাই টিপুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট যার নাম ছিলো ’রাজনৈতিক স্বজন’। শিক্ষা মন্ত্রী থাকা কালে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে বেসরকারি নর্থ-সাউথ ও মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ড পরিবর্তনের নামে এগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয় একটি চক্র যার নেপথ্যে ছিলেন দীপু মনি। এভাবে তার অনুগত পার্টির লোক দিয়ে নর্থ-সাউথ, মানারাতের ট্রাষ্টি বোর্ড, বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা দখল করেন। শুধু তাই নয়, গুলশানের মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ দখল করতে গেলে প্রতিষ্ঠানটির সমানে মানববন্ধন করেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা এবং উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়ে রক্ষা পায় প্রতিষ্ঠানটি। স্কুল-কলেজ ভবন নির্মানে ৫ শতাংশ কমিশন, শিক্ষার উন্নয়ন বাজেটের বেশিরভাগ বরাদ্দ পায় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। এ খাতে ঠিকাদারকে ৫ শতাংশ কমিশন দিয়ে কাজ নিতে হতো। এর নিয়ন্ত্রণ তৎকালীন পুরোটাই ছিলো দীপু মনির হাতে। অর্থাৎ যেখানেই অর্থ সেখানেই তারা ছিলেন।

নতুন শিক্ষাক্রমে নোট-গাইড বিক্রি নিষিদ্ধ করার নামে গাইড বিক্রেতাদের কাছ থেকে নিয়মিত কমিশন নিতেন।এক প্রকাশণীর মালিক এ কাজে তাকে সহায়তা করতেন যার বাড়িও চাঁদপুর। এক নোট-গাইড প্রকাশক জানান, তিন মাস পর পর অন্তত ২৫ কোটি টাকা কমিশন নিতেন দীপু মনি। নোট গাইডের সঙ্গে জড়িত আট থেকে দশ লক্ষ লোক। তাদেরকে ক্রিয়েটিভ উপায়ে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, শিক্ষায় তারা কিভাবে অবদান রাখতে পারেন সেগুলো চিন্তা না করে লোক দেখানো শ্লোগান ‘নোট-গাইড বন্ধ’ আর বছরে কোটি কোটি টাকা তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া জাতি ধ্বংসের আরেকটি অধ্যায়। বোর্ডের প্রশ্নপত্র এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে নোট-গাইড থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের ধারণার বিস্তৃতি ঘটাতে পারেন কিন্তু  হুবহু মুখস্থ কিছু লিখতে না পারেন। এসব চিন্তা কে করবে? যিনি করাবেন তিনি তো ব্যস্ত ছিলেন টাকার খাম নেযার জন্য আর যাদের মাধ্যমে করাবেন তারাওতো টাকার মোটা খাম দিয়ে পদায়ন নিয়েছেন। অতএব শিক্ষার যা হওয়ার তাই হয়েছে। 

একজন মানুষের জীবনে কতো টাকা লাগে? সাবেক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী আট হাজার কোটি টাকার মালিক এবং তিনি খাবার দাবার খেতেন সব পাঁচ তারকা হোটেলের। অনেক ব্যবসায়ী আছেন যাদের সম্পদ ও নগদ অর্থ অনেক আছে এবং থাকতে পারে। কারণ, তারা তাদের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বড় করেন যেখানে দেশের অনেক মানুষ কাজ জীবিকা নির্বাহ করেন। সেটির একটি যৌক্তিকতা আছে কিন্তু একজন মন্ত্রী এবং বিশেষ করে শিক্ষামন্ত্রী তার যদি এ ধরনের অর্থ-বিত্ত থাকে এবং সেটি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে তাহলে শিক্ষার কি দশা হয় তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমরা দেখলাম। লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী যখন পড়াশুনা বাদ দিয়ে, বিদ্যালয়ে আসা বাদ দিয়ে পুরো এক নতুন অজানা অধ্যায়ে পা বাড়াচ্ছিল, হাজার হাজার অভিভাবক, শিক্ষক এবং বহু শিক্ষাবিদ দুটো বছর যাবত চীৎকার করে কাটাচেছন যে, এই কারিকুলাম জাতিকে ধ্বংস করছে। তখন ওই শিক্ষামন্ত্রী কানে তুলো দিয়ে রাখলেন। আর তার সঙ্গে কয়েকজন তারা যেকোনো উপায়ে এটি চালু করার জন্য পুরো শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষক সমাজের ওপর প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করলেন। কারণ, সেখানে যে, অর্থের বেসাতি আছে। আরো আছে যে কথা ড. কলিমউল্লাহ বলেছেন যে, একটি দেশের প্রেসক্রিপশনে পুরো জাতি ধ্বংসের খেলায় মেতেছিলেন তারা। শিক্ষার বর্তমান অবস্থাকে তিনি আইসিইউ-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। এটি যথার্থই বলেছেন। কারণ, একজন ভিসি যদি দুই কোটি টাকা দিয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হন তাহলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বারোটা বাজাবেন না তো কী করবেন? শিক্ষার সঙ্গে ওইসব ভিসিদের কোনো সম্পর্ক আছে? পুরো জাতি ধ্বংসের খেলায় তার মত্ত ছিলেন। একজন অধ্যক্ষকের যদি ৫৫ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে অধ্যক্ষ হতে হয় তাহলে তিনি সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ-উপার্জন ছাড়া আর কী করবেন? জানি না আমার শিক্ষার অবস্থা কবে এবং কীভাবে পরিবর্তন হবে। তবে, মঙ্গলের প্রত্যাশায় থাকলাম।

লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক 

অনুদান পেতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবেদনের সময় বাড়লো - dainik shiksha অনুদান পেতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবেদনের সময় বাড়লো চার হাজার আনসার সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha চার হাজার আনসার সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা সচিবালয় ও প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের আশপাশে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ - dainik shiksha সচিবালয় ও প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের আশপাশে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ সব দাবি-দাওয়া একমাস বন্ধ রাখার আহ্বান নুরের - dainik shiksha সব দাবি-দাওয়া একমাস বন্ধ রাখার আহ্বান নুরের মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বে রেজাউল করীম - dainik shiksha মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বে রেজাউল করীম শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর একদিনের বেতন ত্রাণ তহবিলে - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর একদিনের বেতন ত্রাণ তহবিলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পদত্যাগের জন্য বল প্রয়োগ করা যাবে না: শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পদত্যাগের জন্য বল প্রয়োগ করা যাবে না: শিক্ষা উপদেষ্টা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের - dainik shiksha গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের শিক্ষায় আমূল সংস্কারের উদ্যোগ নেবো: ড. ইউনূস - dainik shiksha শিক্ষায় আমূল সংস্কারের উদ্যোগ নেবো: ড. ইউনূস কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031821727752686