অভ্যন্তরীণ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এবার চিনি রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে ভারত। আগামী অক্টোবর থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। এর আগে চাল ও গম রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় ভারত। ৪০ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয় পেঁয়াজ রফতানিতেও। চারটি পণ্যের ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ বড় একটি অংশ ভারত থেকে আমদানি করে থাকে। ফলে সার্বিকভাবে ভারতের এসব বিধিনিষেধ বাংলাদেশের বাজারকে প্রভাবিত করবে বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।
বিশ্ববাজারে চিনির দাম ঊর্ধ্বমুখী। এর প্রভাবে দেশের বাজারেও অস্থিরতা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। রাজধানীর বিভিন্ন দোকানে বর্তমানে প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকায়। সরকারিভাবে চিনির দাম প্রতি কেজি ১৩০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হলেও তা মানছেন না ব্যবসায়ীরা। আবার বাজারে প্যাকেটজাত চিনির সরবরাহ একেবারেই কম। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত বছরের এ সময়ে প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৮৮-৯০ টাকা। সে হিসেবে গত এক বছরে দেশে চিনির দাম প্রায় ৬৫ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে গতকাল ভারতের চিনি রফতানিতে নিষেধাজ্ঞার খবর প্রকাশ হয়। সাত বছরের মধ্যে এবারই প্রথম এ পণ্য রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে দেশটি। চলতি মৌসুমে (অক্টোবর থেকে সেপ্টেম্বর) মিলগুলোকে ৬১ লাখ টন চিনি রফতানি করার অনুমোদন দেয়া হয়, যা এরই মধ্যে রফতানি করেছে ভারত। এর আগের মৌসুমে দেশটি ১ কোটি ১১ লাখ টন চিনি রফতানি করে। যদিও ২০১৬ সাল থেকে চিনি রফতানিতে ২০ শতাংশ করারোপ অব্যাহত রেখেছে ভারত।
ভারতের বাণিজ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে (এপ্রিল-মার্চ) ভারত থেকে ৪৬ কোটি ৪৫ লাখ ডলারের চিনি আমদানি করে বাংলাদেশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি করেছিল ৫৬ কোটি ৫৬ লাখ ডলারের। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭ কোটি ৪৪ লাখ ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৪ কোটি ৬৪ লাখ ডলার এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ কোটি ৫২ লাখ ডলারের চিনি আমদানি করে বাংলাদেশ।
পণ্যবাজারের মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের নিয়মিত প্রতিবেদনের (পিংকশিট) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল থেকেই বিশ্ববাজারে চিনির দাম বাড়তে শুরু করে। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৫৪ সেন্ট। এর আগের প্রান্তিক অর্থাৎ জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে প্রতি কেজির দাম ছিল ৪৪ সেন্ট। সর্বশেষ জুলাইয়ে প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৫২ সেন্ট। যদিও ২০২০ সালে বিশ্ববাজারে প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ২৮ সেন্ট।
এদিকে আগামী ২০২৩-২৪ বিপণন মৌসুমে বিশ্ববাজারে ২১ লাখ ২০ হাজার টন চিনি ঘাটতির পূর্বাভাস দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল সুগার অর্গানাইজেশন (আইএসও)। আগামী অক্টোবরে এ মৌসুম শুরু হয়ে শেষ হবে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে। সংস্থাটি জানায়, বিশ্বের শীর্ষ চিনি উৎপাদক দেশ ব্রাজিল। বৈরী আবহাওয়ায় দেশটিতে উৎপাদন কমার শঙ্কা রয়েছে।
প্রান্তিকভিত্তিক এক প্রতিবেদনে আইএসও জানায়, ২০২২-২৩ অর্থাৎ চলতি মৌসুমে বিশ্বজুড়ে ৮ লাখ ৫০ হাজার টন চিনি উদ্বৃত্ত থাকার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু নানা সমস্যার কারণে উদ্বৃত্তের পরিমাণ কমে ৪ লাখ ৯৩ হাজার টনে নেমে আসতে পারে। সংস্থাটি আরো জানায়, আইসিই ফিউচারস এক্সচেঞ্জে গত এপ্রিলে চিনির দাম বেড়ে এক দশকের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। বর্তমানে ভোগ্যপণ্যটির দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করছে। তবে তিন মাসের মধ্যে বাজার কিছুটা স্থিতিশীল হতে পারে।
আইএসও জানায়, বৈরী আবহাওয়া, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় চলতি মৌসুমে ভারত, থাইল্যান্ড, চীন ও ইউরোপের চিনি উৎপাদন আশঙ্কার চেয়েও অনেক বেশি কমতে পারে। ভারতে ২০২২-২৩ বিপণন মৌসুমে চিনি উৎপাদন আরো কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে। উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৩ কোটি ২৮ লাখ টনে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে আখ উৎপাদন কমে গেছে। এ কারণে ইন্ডিয়ান সুগার মিলস অ্যাসোসিয়েশন (ইসমা) উৎপাদন পূর্বাভাস আগের তুলনায় ৩ দশমিক ৫ শতাংশ কমিয়েছে।
চিনি ছাড়াও এর আগে চাল ও গম রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। দেশে চাল আমদানির প্রায় ৭৩ শতাংশই ভারত থেকে আসে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে গত ২০ জুলাই থেকে সব ধরনের নন-বাসমতী চাল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ভারত সরকার।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের আরএম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ও চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক আলমগীর পারভেজ বলেন, ‘ভারত থেকে আগে আমদানি হতো। তবে এখন বাজারে ভারতের চিনি নেই বললেই চলে। মিল মালিকরা যথাযথ সরবরাহ করলে চিনির কোনো সমস্যা হবে না। বর্তমানে কোনো সংকট নেই। ভারত রফতানি বন্ধ করলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রভাব পড়বে। তবে বিকল্প উৎসগুলো থেকে সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে কোনো সমস্যা হবে না।’
আগে বাংলাদেশের গম আমদানিতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের ওপর নির্ভরতা ছিল বেশি। যদিও সহজ উৎস হিসেবে এ দুই দেশের মধ্যে চলমান যুদ্ধ শুরুর আগেই গমের প্রধান আমদানি উৎস হয়ে উঠেছিল ভারত। যুদ্ধ শুরুর সময়েই গম আমদানিতে বাংলাদেশের ভারতনির্ভরতা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৭০ শতাংশে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজার ঠিক রাখতে যুদ্ধ শুরুর পরের মাসেই (গত বছরের মার্চে) গম রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ভারত। তবে এর মধ্যেও বাংলাদেশে কিছু মাত্রায় গম রফতানি বজায় রাখে দেশটি। কিন্তু বর্তমানে দেশটিতে গমের দাম বেড়ে যাওয়ায় রফতানিতে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়িয়েছে দেশটি।
এদিকে চলতি মাসে পেঁয়াজ রফতানিতে ৪০ শতাংশ শুল্কারোপ করেছে ভারত। এতে বাংলাদেশের বাজারে একদিনের ব্যবধানে প্রতি কেজি পেঁয়াজে ২০ টাকা বৃদ্ধি পায়। চাহিদার প্রায় ২০-২৫ শতাংশ পেঁয়াজ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করে বাংলাদেশ। আর এর সিংহভাগই ভারত থেকে আমদানি হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরেও ভারত থেকে ৭ লাখ ৪৩ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি চিনি উৎপাদন করে ব্রাজিল। এর পরই ভারতের অবস্থান। ফলে নতুন করে এ পণ্যটিতে ভারতের রফতানি নিষেধাজ্ঞা বিশ্ববাজারে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সাবেক খাদ্য সচিব আব্দুল লতিফ মন্ডল বলেন, ‘বেশির ভাগ কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ভারতের ওপর নির্ভরশীল। ভারত থেকে খুব সহজে আমদানি করা যায়। সরাসরি স্থলবন্দর দিয়ে চলে আসে, সময়ও কম লাগে। আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্য চাল ও গমের বাইরে চিনি, পেঁয়াজ, তেল, ডালসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্য রয়েছে। ফলে ভারতের যেকোনো সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে কিছুটা প্রভাব ফেলে। চাল ও গমের একটি অংশ ভারত থেকে আমদানি করি। চাল ও গমে আগেই রফতানি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। পেঁয়াজে শুল্কারোপের পর দেশের বাজারে প্রভাব ফেলেছে। আবার নতুন করে চিনি রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে দেশটি। এতে করে সব সময় একটি পক্ষ সুযোগ নিয়ে সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে দেশে সংকট তৈরি করে। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাট চাপ সৃষ্টি করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘দীর্ঘদিন থেকেই আমরা ভারত থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বার্ষিক কোটার বিষয়ে বলে আসছি। বিষয়টা অনেক দূর এগিয়েছে। অর্থাৎ ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি হবে যে প্রতি বছর ভারত থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য আমদানি করতে হবে। এক্ষেত্রে দেশে উৎপাদন বেশি হলেও নিতে হবে আবার কম হলেও নিতে হবে। তাহলে রফতানি নিষেধাজ্ঞা কোনো প্রভাব ফেলবে না। ভারত থেকে সস্তায় আমদানি করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে খরচ কমে যায়।’
তবে ভারতের চিনি রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণায় দেশের বাজারে প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। দেশটি থেকে চিনি আমদানিতে তুলনামূলক নির্ভরতাও কম বলে উল্লেখ করেছেন তারা।
চিনি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘ভারতের রফতানি নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশে কোনো প্রভাব ফেলবে না। সংকটের কোনো আশঙ্কাও নেই। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশে দাম একটু বেশি পড়ছে। প্রতি কেজিতে ৪২ টাকা শুল্ক দিতে হচ্ছে। ডলারের দাম যত বাড়বে তত শুল্কের পরিমাণ বাড়বে।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘আমাদের যে পরিমাণ চিনি আমদানি হয় তার বেশির ভাগই ব্রাজিল থেকে। ভারত থেকে খুব কম আসে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম হয়তো একটু বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে আমাদের হয়তো একটু বেশি দাম দিয়ে কিনতে হতে পারে। বার্ষিক কোটার মধ্যে চিনি রয়েছে। ভারত রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলেও তখন আমরা আনতে পারব।’