টিনের চালে বড় বড় ছিদ্র। বৃষ্টি হলেই ঝর ঝর করে পড়ছে পানি। এতে শিক্ষার্থীদের ভিজে যায় বই-খাতা। ধীরে ধীরে সেই পানিতে ভরে যায় শ্রেণিকক্ষও।
খুলনার দৌলতপুরের সেনপাড়া এলাকার জহীরউদ্দীন গণবিদ্যাপীঠ সরকারি বিদ্যালয়ের এই করুণ অবস্থা।
এমন হীন পরিস্থিতিতেও পাঠদান ছাড়েননি সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বৃষ্টি শুরু হলে শ্রেণিকক্ষের ভেতরে ছাতা মাথায় দিয়ে ক্লাস করান তারা।
তবে বিদ্যালয়টির অবকাঠামোগত জড়াজীর্ণতার কারণে শিক্ষার্থীরা স্কুলের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। অনেকে স্কুল ছাড়ছে। চলমান দুরবস্থার কোনো সমাধান না হওয়ায় চলতি বছরে প্রায় চল্লিশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয় ছেড়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা মেলে, প্রায় চিকন চিকন বাঁশ এবং টিন দিয়ে ছাউনি দেওয়া ৪০/৪৫ ফিট লম্বা এবং ১২/১৫ফিট চওড়া একচালা টিনশেডের ছাপরার মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি মোট ৬টি ক্লাসের ১২০ জন শিক্ষার্থীর পাঠদান চলছে। হঠাৎ বৃষ্টি নামতে একচালা খোলামেলা টিন দিয়ে পানি পড়ে শিক্ষার্থীদের গায়ে। ছাতা মাথায় ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক। সামান্য বৃষ্টিতে শিক্ষার্থীদের বইখাতা ভিজে যাচ্ছে। মেঝেতেও পা রাখতে পারছে না তারা। তাদের পায়ের নিচে জমে যাচ্ছে পানি।
জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪) - এর আওতায় নতুন ভবন নির্মাণে এক বছর আগে বিদ্যালয়ের পুরাতন সেমিপাকা টিনশেড ভবনটি ভেঙে নিয়ে যায় টেন্ডার পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরপর থেকে প্রায় এক বছরের বেশি সময় বিদ্যালয়ের ১২০ জন শিক্ষার্থী রোদ-বৃষ্টিতে চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে ক্লাশ করছে।
এই অবস্থায় চরমভাবে বিঘ্ন হচ্ছে বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। বিদ্যালয়ের কোমলমতিদের দুরবস্থা দেখে থানা সহকারী শিক্ষা অফিসার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে জরুরি তহবিল থেকে অস্থায়ী সুরক্ষিত শ্রেণিকক্ষ করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মহানগরীর ফুলবাড়ী বি.কে ক্লাস্টারের আওতায় ১৯৯১ সালে দৌলতপুর থানাধীন সেনপাড়াসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় জহীরউদ্দীন বিদ্যাপীঠটি প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের নির্বাচনী এলাকায় হওয়া যাত্রা শুরুর পর ২০১৩ সালে বিদ্যালয়টি সরকারিকরণ হয়।
২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪) এর আওতায় যে ৬০৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন ভবন/অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষ এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ওয়াশব্লক নির্মাণের নির্দেশ দেওয়া হয় ওই তালিকার ৫৮০ নম্বরে স্থান পায় জহীরউদ্দীন গণবিদ্যাপীঠ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
নতুন ভবন নির্মাণের অনুমোদনে বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ে। নতুন ভবন নির্মাণে পুরাতন সেমিপাকা টিনশেড ভবনটি ভেঙে ফেলতে আহ্বান করা হয় টেন্ডার বিজ্ঞপ্তির। টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে গত বছরের মার্চের দিকে বিদ্যালয়ের পুরাতন ভবনটি সম্পূর্ণ ভেঙে নিয়ে যায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান।
শ্রেণি পাঠদান উপযোগী ক্লাস রুম না করে পুরাতন ভবন ভেঙে নিয়ে যাওয়ার পর শুরু হয় শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি। অস্থায়ী ভিত্তিতে একচালা টিনের ছাপরা করে চলে শিক্ষা কার্যক্রম।
পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র রুবেল জানায়, বৃষ্টি হলে বইখাতা আর জামাকাপড় ভিজে বাড়ি যেতে হয়। আর রোদের সময় গরমে অসুস্থ হয়ে পড়তে হয়। এই অবস্থায় আমাদের বাবা-মা বিদ্যালয়ের আসতে দিতে চায় না।
এ বিষয়ে থানা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মঞ্জুরুল আলম বলেন, সম্প্রতি যোগদান করেছি। বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ সংকটের বিষয়টি ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থানা শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবহিত করেছি। ভবনের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যে তালিকা পাঠিয়েছি তাতে এক নম্বরে আছে এটি।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাসলিমা খাতুন বলেন, এক বছর আগে পুরাতন ভবনটি ভেঙে নিয়ে যাওয়ার সময় ঠিকাদারের কাছ থেকে ১২ ফিট বাই ১০ ফিটের একটি টিনের কক্ষ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে বিদ্যালয়ের বই-খাতা, কাগজপত্র এবং শিক্ষকদের কোনোরকম একটু বসার জায়গা করি। বিদ্যালয়ের অবকাঠামো না থাকায় শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম চরমভাবে বিঘ্ন হচ্ছে। ফলে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে অপরাগতা প্রকাশ করছেন। চলতি বছরে প্রায় ৪০ জন শিক্ষার্থী বিদ্যালয় ত্যাগ করেছে।