জরায়ু ক্যান্সারের নকল ভ্যাকসিন তৈরির হোতা পলাতক হিমেল সিদ্দিক ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা। তার বিরুদ্ধে মাদক কারবারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও রয়েছে। আল্ট্রাসনোগ্রাম ও থেরাপি দেওয়ার সময় ব্যবহৃত এক ধরনের জেল তৈরির নামে কেরানীগঞ্জে কারখানা চালু করেন হিমেল ও তার সহযোগী সাইফুল ইসলাম শিপন। সেখানেই তৈরি করতেন জরায়ু ক্যান্সারের নকল ভ্যাকসিন। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে এসব তথ্য মিলেছে। শিপনকে ডিবি গ্রেপ্তার করতে পারলেও পলাতক রয়েছেন হিমেল।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছেন, এ চক্রটি শুধু ঢাকাতেই অন্তত ১৪০টি স্কুলের শিক্ষিকা ও ছাত্রীদের এ নকল ভ্যাকসিন দিয়েছে। বিষয়টি জানাজানির পর তারা এখন আতঙ্কে রয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার হিমেল-শিপন চক্রের সাইফুল ইসলাম শিপন, মো. ফয়সাল আহম্মেদ, মো. আল-আমিন, মো. নুরুজ্জামান সাগর ও মো. আতিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। তাদের কাছ থেকে ভুয়া ভ্যাকসিন তৈরির যন্ত্রপাতি এবং বিভিন্ন ওষুধ উদ্ধার করা হয়। তারা সবাই রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকার বাসিন্দা।
ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, চক্রটি ক্যান্সারের প্রতিষেধক হিসেবে যা দিচ্ছে তা হচ্ছে ‘জেনেভ্যাক-বি’ নামে আমদানি নিষিদ্ধ হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন। একটি জেনেভ্যাক-বি ভ্যাকসিন ভারত থেকে অবৈধ পথে মাত্র ৩৫০ টাকা করে আনে চক্রটি। এরপর একটি দিয়ে ১০টি নকল জরায়ু ক্যান্সারের ভ্যাকসিন তৈরি করা হয় এবং একেকটি আড়াই হাজার টাকা করে বিক্রি করা হয়।
এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা নথি ও গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যানুযায়ী এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্তত ৬ হাজার নারীকে এ ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে।
ওই পাঁচজনকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো ডিবির তেজগাঁও বিভাগের ডিসি গোলাম সবুর বলেন, ভুক্তভোগীরা কেউই প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেননি। চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারের পর বিষয়টি জানাজানি হয়। ভুক্তভোগীরা এখন স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা চিন্তা করে শঙ্কিত।
তিনি বলেন, এ চক্রের গ্রেপ্তার ও পলাতক সদস্যদের বিরুদ্ধে রাজধানীর দক্ষিণখান থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়েছে। মামলায় পাঁচজনকে দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তাদের কাছ থেকে নতুন কিছু তথ্য মিলেছে। এসব যাচাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নকল ভ্যাকসিন চক্রের মূলহোতা হিমেল রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নানা অপকর্ম চালিয়ে আসছিলেন। তিনি একসময় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি ছিলেন, বর্তমানে কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। স্বাস্থ্য বিভাগ বা বেসরকারি পর্যায়ে ভ্যাকসিন আমদানি ও প্রয়োগের অনুমোদিত কোনো প্রতিষ্ঠান তার সঙ্গে ছিল কি না, সে তদন্ত শুরু হয়েছে।
হিমেলের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক রমজান আলী। তবে তিনি হিমেলের অপরাধের বিষয়ে জানেন না বলে দাবি করেন।
ডিবির মোহাম্মদপুর জোনের এক কর্মকর্তা বলেন, চক্রটি ভয়াবহ কাজ করে আসছিল। তাদের ধরা না গেলে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়তে হতো। এরা সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টার্গেট করে প্রচারণা চালিয়ে নকল ভ্যাকসিন বিক্রি করে আসছিল। বিশেষ করে রাজধানীর বনশ্রী ও রামপুরা এলাকায় তাদের কার্যক্রম বেশি।
ওই কর্মকর্তা বলেন, এ চক্রের কার্যক্রম পুরোপুরি জানা সম্ভব হয়নি। জিজ্ঞাসাবাদে তারা অন্তত দুই বছর ধরে এসব অপকর্ম করে আসছিল বলে স্বীকার করেছে। অন্য কোনো চক্র রয়েছে কি না, তা জানার চেষ্টা চলছে।
গত বৃহস্পতিবার ডিবি কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, নকল ভ্যাকসিনের প্রচারণা ও বাজারজাতকরণে ডা. এ আর খান ফাউন্ডেশন, আল নূর ফাউন্ডেশন ও পপুলার ভ্যাকসিনেশন সেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে। প্রকৃতপক্ষে তাদের কী ভূমিকা ছিল, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।