জনশক্তি রপ্তানি, অধোমুখি প্রবাসী আয় - দৈনিকশিক্ষা

জনশক্তি রপ্তানি, অধোমুখি প্রবাসী আয়

শাকিল কালাম |
জনশক্তি কর্মসংস্থা ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়।ওই বছর ৬ হাজার ৮৭ জন কর্মী বিদেশে যান।তারপর থেকে প্রায় প্রতি বছরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়মিত জনশক্তি রপ্তানি হচ্ছে।প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়নের পাশাপাশি ব্যক্তিপর্যায়ে মানুষের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে,গ্রামীণ অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দিয়েছে।আজকের গ্রামের বাড়িঘর,রাস্তাঘাট এবং আধুনিক নাগরিক সুবিধা ভোগের প্রবণতা থেকেই বোঝা যায়, প্রবাসী আয় গ্রামীণ জনগোষ্ঠির জীবনমান কতোটা পরিবর্তন ও উন্নত করেছে! প্রবাসীদের ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষিত হয়ে উঠছে।আবার কেউ কেউ কেউ কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে জনশক্তি বা মানবসম্পদে পরিণত হয়ে উঠছে।অর্থনীতির পরিভাষায়..কোনো দেশ বা অঞ্চলের মানুষের কাজ করার সক্ষমতা বিবেচনায় দু’ভাগে ভাগ করা যায়।
 
দক্ষ এবং অদক্ষ মানবসম্পদ বা জনশক্তি।তবে আমাদের দেশ থেকে রপ্তানিকৃত অধিকাংশ মানবসম্পদই অদক্ষ ও অশিক্ষিত।নানা শ্রেণী-পেশার ক্ষেত্রে এর রকমফের আছে।যেমন, ডাক্তার,প্রকৌশলী,নার্স,শিক্ষাবিদ, সিস্টেম এনালিষ্ট, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, ফ্যাশন ডিজাইনার ইত্যাদি পেশার জনশক্তি অত্যন্ত দক্ষ।হিসাব বিজ্ঞানের নিয়মানুযায়ী, যতো বেশী মানবসম্পদ বিদেশে রপ্ততানি হবে, প্রবাসী আয়ও ততো বেশী হবে।কিন্তু আমাদের দেশের প্রবাসী আয়ের চিত্র পুরোটাই বিপরীত।অর্থাৎ মানবসম্পদের রপ্তানি বেশি কিন্তু আয় কম। নিচের পরিসংখ্যান  থেকে তার পুরো চিত্রই উপলব্ধি করা সম্ভব।

 

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে  মানবসম্পদ রপ্তানির পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি..তবে প্রবাসী আয় হয়েছে ১৪.২২ বিলিয়ন ডলার।উপরোক্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৫ থেকে ২০২২ পর্যন্ত বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মানবশক্তি রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হার ইতিবাচক ছিলো।প্রবাসী আয় প্রবৃদ্ধির হার বেশির ভাগ ইতিবাচক থাকলেও তা জনশক্তি রপ্তানির প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে অনেক কম।এ হার হ্রাসের পেছনে যেসব কারণ বিদ্যমান..তা হলো, প্রবাসীর পরিবার যাতে প্রেরিত অর্থ যাতে দ্রুততম সময় পেয়ে যায়..সে জন্য তারা তাঁদের অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে প্রেরণ করে থাকে।আবার বিদেশী মুদ্রার বিনিময় হারও এর জন্য কম দায়ী নয়।যদি প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ প্রেরণ করেন..তাহলে তাঁরা কম অর্থ পেয়ে থাকেন।আবার তাঁরা যদি হুন্ডির মাধ্যমে প্রেরণ করেন, তাহলে দ্রুততম সময়ে তাঁদের পরিবার-পরিজন বেশী অর্থ পেয়ে থাকেন।তাছাড়া ব্যাংক কর্মকর্তাদের টালবাহনা ও কারসাজিও প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ প্রেরণে নিরুৎসাহিত করে থাকে।
আমাদের রপ্তানিকৃত জনশক্তি কম দক্ষ বা অদক্ষ বলে তাঁর কম বেতন বা পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন।তাই আমাদের দেশে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় প্রবাসী আয় অর্জিত হয় না।সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি হলো,প্রবাসীরা বাড়িতে অর্থ পাঠানোর জন্য অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল ব্যবহার করে থাকেন।কারণ..তারা এটি সহজ বলে মনে করেন এবং বিনিময় হার বেশী পেয়ে থাকেন।তাই অফিসিয়াল রেমিট্যান্স সংখ্যা কম।
ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠানোকে উৎসাহিত করা এবং প্রবাসী আয়ের প্রকৃত পরিমাণ নির্ণয়ের নিমিত্তে সরকার ২০২০-২১ খ্রিষ্টাব্দে ২% এবং ২০২১-২২ খ্রিষ্টাব্দে  ২.৫% হারে ক্যাশ ইনসেনটিভ ঘোষণা করেন।তথাপিও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি বা ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশীদের অর্থ প্রেরণের হার বৃদ্ধি পায়নি।এ প্রণোদনা কীভাবে কাজ করেছে,তা স্পষ্ট নয়।সুতরাং ক্যাশ  ইনসেনটিভের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিকগুলো খতিয়ে দেখা দরকার।
বিদেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসে,তার কোনো পরিসংখ্যান কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা পরিসংখ্যান ব্যুরোর কাছে নেই!এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মোঃ মেজবাউল হক বলেন,অভিবাসীদের দেশে বা বিদেশে কী ধরনের গোপন অর্থ প্রদান করতে হয়..সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য নেই।যদি তা হয়,তাহলে এটা স্পষ্ট যে,তারা যে পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠাবেন তার থেকে কম রেমিটেন্স পাঠাবেন।অপরদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের পরিচালক ও অধ্যাপক সিআর আবরার বলেন, প্রবাসীরা মনে করেন..রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য হুন্ডিই,ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে বেশি লাভজনক।  
 
তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে অনেক রপ্তানিকারক আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে পণ্য রপ্তানি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।অর্থাৎ প্রকৃতমূল্যের চেয়ে কম মূল্য দেখিয়ে পণ্য রপ্তানি করে থাকে।অতিরিক্ত অর্থ বিদেশী ক্রেতা তাঁদের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন।এতে প্রতীয়মান হয়,প্রকৃত রপ্তানিমূল্য দেশে প্রত্যাবাসিত হয় না বলে আমাদের বৈদেশিক আয়ের প্রকৃত চিত্র আমাদের অর্থনৈতিক প্রতিবেদন এবং বৈদেশিক রিজার্ভে প্রতিফলিত হতে দেখা যায় না।
বিদেশী চাকরির ভিসা বিক্রি বা কেনা সম্পূর্ণভাবে বেআইনি।কিন্তু আমাদের দেশে কেনাবেচার সংস্কৃতি বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে।প্রবাসীদের নিয়োগের খরচের একটি বড় অংশ ভিসা ব্যবসায়ীদের দিতে হয়।তারা নিয়োগকর্তা বা গন্তব্য দেশগুলোর দালাল হয়ে থাকে।বিএমইটিএ’র প্রাক্তন পরিচালক নুরুল ইসলাম বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে ভিসা ট্রেডিং এবং হুন্ডি নিয়ে কথা বলছি।কিন্তু বহুবর্ষজীবী সমস্যা সমাধানের জন্য খুব কমই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।ভিসা ট্রেডিংয়ের ফলে উচ্চ নিয়োগ খরচ হলো, শ্রম অভিবাসন খাতে সবচেয়ে বিপজ্জনক কারণ।এটি জালিয়াতি,অপব্যবহার এবং অর্থনৈতিক কষ্টের একটি ‘দুষ্টুচক্র’ তৈরি করেছে। ফলে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমাদের জনশক্তি কাঙ্খিত মাত্রায় বিদেশে যেতে পারছে না।ভিসা বেচাকেনাসহ অন্যান্য বিষয়গুলোর ব্যাপারে সরকারি প্রশাসন বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের দ্বারা কোনো ব্যবস্থা নেয়ার দৃষ্টান্ত বা আলামত দেখা যায় না।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জাতীয় সমীক্ষা অনুযায়ী, একজন শ্রমিককে বিদেশে যেতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়, সে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতে তাঁদের সাড়ে ১৭ মাস সময় লেগে যায়।
তাছাড়া বিদেশে কর্মরত প্রবাসীদের তাঁদের কথিত কফিলদের আকামা এবং মাসিক বা বার্ষিক হারে..নির্দিষ্ট হারে অর্থ প্রদান করতে হয়।অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের আয়ের ৫০-৬০ শতাংশ বিদেশেই ব্যয় করতে হয়।ফলে প্রবাসীরা তাঁদের প্রকৃত আয়ের অর্থ দেশে প্রেরণ করতে পারেন না।যদি অবৈধ ভিসা লেনদেন বন্ধ করা যেতো,তাহলে বাংলাদেশ আরো বেশি পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারতো।
বাংলাদেশের সমৃদ্ধ অর্থনীতিতে প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের গুরুত্ব অপরিসীম।এ প্রবাহ সরাসরি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে গতিশীল করার পাশাপাশি জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে দেশের বিপুল বেকারত্ব লাঘব করছে।বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অভিবাসী প্রেরণকারী দেশ। সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় অর্জনকারী ১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম।শিল্পবিপ্লবের যুগে..প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে দক্ষ জনশক্তির বিকল্প নেই। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষা পাঠক্রম এবং কারিগরি শিক্ষা পদ্ধতি এখনো পুরোনো ধাঁচের তাত্ত্বিক বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল।তাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।আমাদের জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে রূপান্তরিত করতে হলে শিক্ষা পদ্ধতিতে প্রযুক্তি ও কর্মমুখী শিক্ষাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
 
লেখক: কবি ও মানবাধিকারকর্মী

 

 

অধ্যক্ষের অনুপস্থিতিতে শিক্ষকদের বেতন সভাপতির একক স্বাক্ষরে - dainik shiksha অধ্যক্ষের অনুপস্থিতিতে শিক্ষকদের বেতন সভাপতির একক স্বাক্ষরে জোর করে পদত্যাগ, ভালো নেই স্ট্রোক করা সেই অধ্যক্ষ - dainik shiksha জোর করে পদত্যাগ, ভালো নেই স্ট্রোক করা সেই অধ্যক্ষ বরিশালে থানায় শিক্ষার্থীদের হামলা-ভাঙচুর - dainik shiksha বরিশালে থানায় শিক্ষার্থীদের হামলা-ভাঙচুর হাজিরা মেশিন কাজে আসেনি ১৬৯ বিদ্যালয়ে, গচ্চা ৩৭ লাখ টাকা - dainik shiksha হাজিরা মেশিন কাজে আসেনি ১৬৯ বিদ্যালয়ে, গচ্চা ৩৭ লাখ টাকা পদ্মার ভাঙনে বিলীনের শঙ্কায় দুই স্কুল - dainik shiksha পদ্মার ভাঙনে বিলীনের শঙ্কায় দুই স্কুল কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037710666656494