জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার কেনো নয় - দৈনিকশিক্ষা

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার কেনো নয়

সাধন সরকার, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ অক্টোবর বিশ্বের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার লক্ষ্যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ৭৯ বছর উদ্যাপন চলছে। ১৯৩ সদস্যদেশভুক্ত জাতিসংঘের ৫ স্থায়ী ও ১০ অস্থায়ী (দুই বছর পরপর নির্বাচিত হয়) সদস্য নিয়ে গঠিত ‘নিরাপত্তা পরিষদ’। নিরাপত্তা পরিষদের মূলকাজ আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, নিরাপত্তা পরিষদের ৫ স্থায়ী রাষ্ট্রের (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন ও ফ্রান্স) ‘ভেটো’ বা ‘বিরোধিতা করার ক্ষমতা’ প্রয়োগের ফলে বিশ্বের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শান্তি-নিরাপত্তা আজ স্বার্থের খাঁচায় বন্দি। ভাবতে অবাক লাগে, একবিংশ শতাব্দীতে এসে জাতিসংঘ গুটিকয়েক দেশের দ্বারা পরিচালিত হবে- এটা অগ্রহণযোগ্য। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রতি দুই বছর পর পর ১০ অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হলেও যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে শেষমেশ ৫ স্থায়ী সদস্যের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়। কেনোনা অস্থায়ী সদস্যের ‘সুপার পাওয়ার’ নামে খ্যাত ‘ভেটো’ ক্ষমতা নেই, যা স্থায়ী সদস্যভুক্ত দেশের আছে।  

প্রশ্ন জাগে, নিরাপত্তা পরিষদ কি পেরেছে সম্প্রতি বিশ্ব মানবতার সংকটে সাড়া দিয়ে রোহিঙ্গা সংকটের কার্যকরী সমাধানের পথ খুঁজতে? রোহিঙ্গা সমস্যায় জাতিসংঘের দুই স্থায়ী শক্তিশালী সদস্য চীন ও রাশিয়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে মিয়ানমারের পক্ষে পরোক্ষভাবে ওকালতি করছে বলে মনে হয়। ফলে নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের ব্যর্থতায় মিয়ানমার সরকার মানবতাবিরোধী ও গণহত্যার মতো অপরাধ করতে আরো বেশি সাহস পেয়েছে। জাতিসংঘ কী পেরেছে মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘদিনের অশান্তির আগুন নেভাতে? ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার আগ্রাসী থাবার সমাধান কেনো জাতিসংঘ করতে পারছে না? অভিবাসীদের সুরক্ষা ও অধিকারের মতো বিষয়গুলোর কার্যকর সমাধান ও সঠিক পথের সন্ধান দিতে জাতিসংঘ কী পেরেছে? সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেয়ার এমন আরো উদাহরণ আছে।

জাতিসংঘ কী পেরেছে ফিলিস্তিনের নিরাপরাধ শিশু হত্যা বন্ধ করতে?  ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে আগ্রাসন ও বিগত কয়েক বছরে অব্যাহতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেও এখনো নিরাপত্তা পরিষদ এ ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে একমত হতে পারছে না। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে হবে। যেকোনো ঘটনায় সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একথা এখন বলার সময় হয়েছে যে, জাতিসংঘ ছোট দেশগুলোর সমস্যা সমাধানে কমই গুরুত্ব দিয়ে থাকে। দেশে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হলেও জাতিসংঘ যেনো স্থায়ী সদস্যের সিদ্ধান্তের কাছে বন্দি। একটা অভিযোগ অনেক সময় শোনা যায় যে, যে দেশ যত বেশি শক্তিশালী সে দেশ তত বেশি জাতিসংঘ নীতি লঙ্ঘন করে থাকে।

শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধ মীমাংসার যে দায়িত্ব নিরাপত্তা পরিষদের ওপর ন্যস্ত হয়েছে, সে দায়িত্ব পালনে এই পরিষদ আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে পুরোপুরিভাবে সফল হয়নি।  ১৯৫৯ থেকে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সংঘটিত ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ঘটনাবলি তার প্রমাণ। জাতিসংঘের এই শক্তিশালী পরিষদ পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ করতে পেরেছে কি ? তাই বাস্তবতার নিরিখে নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার জরুরি। 

এবার ‘স্থায়ী সদস্যের’ দিক দিয়ে বিচার করা যাক। ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা  যায়,  ইউরোপ মহাদেশ পৃথিবীর মোট ভূখণ্ডের মাত্র ৬.৬ শতাংশ। অথচ নিরাপত্তা পরিষদে তাদের প্রতিনিধিত্বের হার ৬০ শতাংশ (৩ টি দেশ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য)। পৃথিবীর মোট ভূখণ্ডের মধ্যে আফ্রিকা ২০ শতাংশের অধিকারী, অথচ পৃথিবীর  দ্বিতীয় বৃহত্তম এ মহাদেশ থেকে নিরাপত্তা পরিষদে কোনো ‘স্থায়ী সদস্য’ দেশ  নেই। প্রায় ১২ শতাংশ ভূখণ্ডের অধিকারী দক্ষিণ আমেরিকা, অথচ এখান থেকেও স্থায়ী কোনো সদস্য দেশ নেই। আবার এশিয়া মহাদেশে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বেশি বাস করলেও নিরাপত্তা পরিষদে এ মহাদেশের  প্রতিনিধিত্বের হার মাত্র ২০ শতাংশ (১টি দেশ স্থায়ী সদস্য)। আঞ্চলিক ক্ষেত্রে অবস্থান, মহাদেশভিত্তিক জনসংখ্যা এবং বর্তমান অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় নিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ দেশকে নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য করা সময়ের দাবি। বর্তমান বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৮৩০ কোটির বেশি, যা ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেয়ে প্রায় ৫ গুণ।  তাছাড়া এখন এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বেশিরভাগ দেশই স্বাধীন। বর্তমান বিশ্ব পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার বা স্থায়ী সদস্য দেশ বৃদ্ধির সময় আসন্ন। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ও জনসংখ্যার দেশ ভারতকে কেনো স্থায়ী পরিষদের সদস্য করা হবে না ? পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ তথা ১৪০ কোটির বেশি জনসংখ্যার দেশ ভারত জাতিসংঘের সদস্য নয়, এটা শুভকর কোনো সংবাদ নয়। জাতিসংঘের অন্যতম বৃহত্তম চাঁদা প্রদানকারী দেশ, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে সবচেয়ে আর্থিক সহায়তা প্রদানকারী জাপানকে কেনো স্থায়ী সদস্য করা হবে না ? দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল, আফ্রিকা মহাদেশের নাইজেরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ কি নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার যোগ্য নয় ?

জাতিসংঘকে আন্তর্জাতিক সংগঠন না বলে পাঁচটি বৃহৎ রাষ্ট্রের বিশেষায়িত সংগঠন বললেও অত্যুক্তি হবে না। বর্তমান যুগে বাস্তবতার নিরিখে ‘ভেটো’ ক্ষমতার বিষয়টিকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার সাড়ে সাত দশক পরে এসে ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির ভারসাম্য রক্ষায় নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার-ই হবে যৌক্তিক ও সময়োপয়োগী পদক্ষেপ। বিশ্বের বৃহত্তম সংগঠন জাতিসংঘে যদি বিশ্ব জনমতের প্রতিফলন কিংবা অধিকারের ভারসাম্য না থাকে তাহলে কিভাবে জাতিসংঘ দেশে দেশে গণতন্ত্র ও সমান অধিকারের কথা বলে ? ভৌগোলিক ও আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারটা জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে গুরুত্ব পেলেও নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যের বৃদ্ধির বেলায় সেটা কেনো অনুপস্থিত ? অবিলম্বে ‘জাতিসংঘ সনদের’ সংস্কার এনে নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার কিংবা স্থায়ী আসন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক ভারসাম্য ও প্রতিনিধিত্ব রক্ষা, জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব, রাজনৈতিক গুরুত্ব, সমতাভিত্তিক অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক সমৃদ্ধি প্রভৃতি বিবেচনায় নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কারের বিকল্প নেই।   

লেখক: শিক্ষক

 

ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা - dainik shiksha বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান - dainik shiksha ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ - dainik shiksha সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ - dainik shiksha সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন - dainik shiksha পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0075769424438477