জামায়েত ইসলামী যে তাদের ‘চরিত্র পাল্টায়নি’, ভোররাতে পুলিশের ওপর আক্রমণ করে আবারও তা প্রমাণ করেছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকার পুলিশ কমিশনার খন্দকার ফারুক আহমেদ।
মঙ্গলবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। এ সময় তিনি এও জানান, বুধবার ঢাকায় যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর গায়েবানা জানাজার অনুমতি দেওয়া হবে না।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা সাঈদী গত সোমবার রাতে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ‘হার্ট অ্যাটাকে’ মারা যান।
পুলিশ কমিশনার বলেন, সাঈদীর মরদেহ হস্তান্তরকে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবির ও তার স্বজনরা রাতভর নাটক করেছে ও তাণ্ডব চালিয়েছে। সাঈদীর মৃত্যুর পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি তার দুই ছেলেকে জানায়। পরে তার দুই ছেলে মরদেহ পিরোজপুরে তাদের গ্রামের বাড়িতে নেওয়ার জন্য কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে।
এর মধ্যে কারা কর্তৃপক্ষ নিয়ম অনুযায়ী মরদেহের ময়নাতদন্ত করার প্রস্তুতি নেয়। ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে আসা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট এসে মরদেহের সুরতহাল করেন। যখন ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ ঢাকা মেডিকেলের মর্গে নিয়ে যাওয়া হবে, সেই মুহূর্তে সাঈদীর ছেলেরা জোর দাবি জানান যে তারা ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ নিয়ে যেতে চান।
বিষয়টি নিয়ে অনেক সময় ক্ষেপণ হয় এবং রাত দেড়টার দিকে সাঈদীর ছেলেরা কারা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পায়। মরদেহের গোসল শেষে পরিবারের সদস্যরা পিরোজপুরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন।
পুলিশ কমিশনার বলেন, তখন বিএসএমএমইউ ও শাহবাগে অবস্থান নেওয়া কয়েক হাজার জামায়াত-শিবির কর্মী দাবি তোলে যে তারা জানাজা পড়ে তারপর মরদেহ নিতে চায়। তখন আমরা তাদের বলি, আপনারা এখানে জানাজা পড়তে পারেন, কারণ আগামীকাল জাতীয় শোক দিবস, আমাদের ব্যস্ততা আছে, আপনারা এখন জানাজা পড়ে মরদেহ নিয়ে যেতে পারেন। রাত সোয়া ২টার দিকে তারা জানাজার পরিবর্তে মোনাজাত করে আধা ঘণ্টা। তারা বলে, ‘আমরা জানাজা পড়ব না মোনাজাত করেছি, পরে আমরা গায়েবানা জানাজা পড়ব’।
পুলিশ কমিশনার বলেন, যখন মরদেহ গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়, তখন হাজার হাজার জামায়াত-শিবির লাশবাহী গাড়ির সামনে শুয়ে পড়ে। তারা কোনো মতে এই মরদেহ পিরোজপুরে নিয়ে যেতে দেবে না। এসময় লাশবাহী গাড়ির সঙ্গে থাকা পুলিশ অফিসার ও পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা করে জামায়াত-শিবির। সঙ্গে তারা গাড়ি ভাঙচুর শুরু করে।এই হামলায় ডিসি রমনাসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র অফিসার আহত হন। তারা পুলিশের চার থেকে পাঁচটি গাড়ি ভাঙচুর করে এবং দুটি মোটরসাইকেল আগুন ধরিয়ে দেয়। আমরা ধৈর্য্য সহকারে এই তাণ্ডব সহ্য করি যে তারা একটা মরদেহ নিয়ে যেতে চাচ্ছে নিয়ে যাক। তারপরেও আমরা কোনো শক্তি প্রয়োগ করিনি। ফজরের নামাজের পরে তাদের আবারও অনুমতি দেওয়া হল জানাজা পড়ার। কিন্তু তারা আমাদের অফিসারদের বের করে বিএসএমএমইউ দখলে নিয়ে নিল। তারা মরদেহ পিরোজপুর নিতে দেবে না। এর মধ্যে তারা ফেসবুকে প্রচার করতে শুরু করল, সারা দেশ থেকে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের শাহবাগে আসার জন্য। তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আশঙ্কায় তাদের ওপরে আমরা অত্যন্ত সীমিত আকারে শক্তি প্রয়োগ করি। আমরা টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে বিএসএমএমইউ মুক্ত করে সাঈদীর মরদেহ পিরোজপুরে পাঠানোর ব্যবস্থা করি।
এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ কমিশনার বলেন, আমারা গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছিলাম যে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা জড়ো হচ্ছেন। সাঈদীর দুই ছেলে প্রথম থেকে আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন, তাদের বাবার মরদেহ তারা নিয়ে যাবেন, কোনো ধরনের সমস্যা হবে না। আমরা তাদের ওপর বিশ্বাস করে প্রথম থেকে কোনো প্রকার শক্তি প্রয়োগ করি নাই। যেহেতু তারা তাদের নেতার মরদহ নিয়ে যাওয়ার জন্য, কেউবা মৃত্যুর সংবাদ শুনে, আবার অনেকে মরদেহ দেখার জন্য এসেছেন, তাই মানবিক কারণে আমরা প্রথম থেকে কোনো ধরনের অ্যাকশন নেই নাই। কিন্তু জামায়াত-শিবির যে তাদের চরিত্রটা পাল্টায় নাই, এটা তারা আবারও প্রমাণ করল। বিগত ২০১২-১৩ খ্রিষ্টাব্দে তারা যেভাবে পুলিশকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা, হেলমেট দিয়ে পিটিয়ে পুলিশের মাথা থেঁতলে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে, সেই চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ তারা আবারও করল।
প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, নির্যাতন ও ধর্মান্তরে বাধ্য করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের তখনকার নায়েবে আমির সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। পরে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আপিল বিভাগ।
ট্রাইব্যুনালে সাঈদীর রায়ের পর দেশজুড়ে সহিংসতা চালায় জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীরা। ওই তাণ্ডবে প্রথম তিন দিনেই নিহত হন অন্তত ৭০ জন। এছাড়া বহু গাড়ি-দোকানপাট ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, হিন্দুদের মন্দির-ঘরবাড়ি ভাংচুর করা হয়।
সে সময় গুজব ছড়ানো হয়েছিল যে সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে। তেমনি সোমবার রাতের ভূমিকম্পের সঙ্গে সাঈদীর মৃত্যুকে জড়িয়ে গুজব ছড়ানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ডিএমপির সাইবার সেল কী করছে প্রশ্ন করলে পুলিশ কমিশনার বলেন, আমাদের সাইবার ইউনিট সক্রিয় আছে। তারা যে বিভিন্ন গুজব ছড়াচ্ছিল সেই তথ্য আমরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছিলাম।