জীবন এক শিক্ষা সফরের নাম। বিছিন্নভাবে হলেও এখানে প্রতিনিয়ত অভিজ্ঞতার সঞ্চারণ ঘটে। গেলো বছর তিনেক পূর্বে এমনি এক অভিজ্ঞতা জুটেছে। সচারচর ঈদের সময়টায় বাড়ি ফেরায় মানুষের ঢল নামে। যার কারণে টিকিট পাওয়া এবং হঠাৎ করে উঠে যাওয়া, দুই-ই যাত্রীদের মুশকিলের সম্মুখীন করে। একারণে দেখা যায়, একশ্রেণির তরুণ, যুবকরা মোটরযান নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হয়ে যান। তবে এটা ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। এই টিকিট জটিলতা ও তারুণ্যের অবাধ্য সাহস নিজেকে মোটরযানযোগের অভিজ্ঞতার ভান্ডারকে পূর্ণ করে।
ঢাকা থেকে বাড়ির পথের দীর্ঘ যাত্রায় প্রচণ্ড রোদ ও ধুলোবালি ক্লান্তিকর অবস্থার জন্ম দেয়। এজন্য সামান্য প্রশান্তির জন্য পথের ধারে মসজিদের উঠোন হয় নিরাপদ আশ্রয়। পাশে থাকা ওজুখানায় গিয়ে মুখে-চোখে পানিও দেয়ার পর যখন ক্লান্তি প্রশমিত হওয়ার পথে- তখনই অভিজ্ঞতার পাল্লাটা ভারি হওয়ার সুযোগ পায়। মসজিদের বারান্দা পরিষ্কারকারী এক ব্যক্তি ওযুখানা ব্যবহারের বিনিময়ে পয়সা দাবি করে বসেন। বিস্মিত হয়ে বলতে হয়েছে, এটা তো মসজিদ- গণশৌচাগার নয়। এরপর শুরু হয় তার অনৈতিক আচরণ। অথচ সর্বত্রই মসজিদ, মাদরাসা কেন্দ্রিক খাদেম, হুজুরবৃন্দের ব্যবহার প্রশংসনীয়।
শৈশবে মক্তবে হুজুরের সুরেলা কণ্ঠের কায়দা পড়া, আমপারা পড়া এবং পরম যত্নে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য শেখানোর মমত্ববোধের বিপরীতে সেই ব্যক্তির পয়সা কেন্দ্রিক আচরণ সম্পূর্ণ বৈপরীত্য সৃষ্টি করে। এজন্য অবশ্য একশ্রেণির নব্য ধনীরা দায়ী। রাতারাতি পয়সা কামিয়ে নিজেদের পাপ মোচন ও পুণ্যের আশায় অপরিকল্পিতভাবে মসজিদ, মাদরাসা গড়ে তুলছেন। দান কিংবা স্থাপনা নির্মাণ শেষে একবার ছবি তোলা, খবর প্রচার শেষ হয়ে গেলে প্রতিষ্ঠাকারী নিরুদ্দেশ। এরপর সেখানে কি চলছে, কোন খোঁজ নেই।
আধুনিক দেশ গড়তে সুশিক্ষা প্রয়োজন। প্রায় ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে অবশ্যই সঠিকভাবে শেখার ও শেখানোর ওপর নিয়ন্ত্রণ, পর্যবেক্ষণ থাকা জরুরি। তুরস্কের মত মুসলিম দেশ বিজ্ঞান ও বৈশ্বিক চর্চায় এগিয়েছে- কারণ তাদের দেশে পর্যবেক্ষক আছে, নিয়ম আছে, নিয়ন্ত্রণ আছে। যে কেউ চাইলেই মসজিদ স্থাপন করতে পারবেন না, ইমামতিও করতে পারবেন না। ইমাম হতে হলে অবশ্যই ‘ইমাম হাতিপ’ নামক প্রতিষ্ঠান থেকে উত্তীর্ণ হতে হয়।
সম্প্রতি দশজন নিয়ে একটি মহল্লায় নিরীক্ষা চালিয়ে দেখা যায়, প্রায় অপরিকল্পিত ও বিচ্ছিন্নভাবে মক্তব-মাদরাসা, মসজিদ গড়ে উঠছে। এই চিত্র প্রায় সর্বত্র। এর সাথে যুক্ত হয়েছে লোক দেখানো এসি ব্যবহারের নানা বাহার। অথচ একটা মহল্লায় মানুষের সংখ্যা গণনা করে সেখানে কয়টি মসজিদ প্রয়োজন তার কোন পরিসংখ্যান নেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার প্রত্যেক উপজেলায় একটি মডেল মসজিদ ও ধর্মীয় সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র নির্মাণ করছেন। এই নির্মাণের সাথে যুক্ত হতে পারে ভেন্টিলেশন সিস্টেম বা বাতাস চলাচল ব্যবস্থা। এটা থাকলে অস্বাস্থ্যকর পণ্য এসি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ অপচয় বন্ধ হবে। বরং এই বিদ্যুৎ দেশের উৎপাদনমুখী, বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনে খরচ করার সুযোগ তৈরি হবে। সাথে তুরস্কের মত একধরণের পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা জরুরি। এতে আচরণ ও প্রজ্ঞার আলোকে নির্বাচিত ইমামরা আরো আলো ছড়াতে পারবেন।
বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামের প্রতি আনুগত্যশীল ছিলেন। তবে ধর্ম নিয়ে সুযোগ সন্ধানীদের বিরুদ্ধে তিনি আমৃত্যু লড়াই করেছেন। এই প্রেক্ষপটে ভাবলে স্পষ্ট, অপরিকল্পিত হারে মসজিদ নির্মাণ আদতে একশ্রেণির মুনাফালোভী শ্রেণি তৈরি করছে, সাথে বাড়ছে বিচ্ছিন্নতা- যেখানে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যের। কারণ অর্থনৈতিক, ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে দেশ ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার দিকে এগোচ্ছে।
ধর্মচর্চাকারী ও ধর্মব্যবসায়ীদের পথ ভিন্ন। এদেশের মানুষ সহজিয়া সংস্কৃতির। আল্লাহর প্রতি আনুগত্যে, মহানবী হয়রত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনী, বিদায়ী ভাষণ পড়ে ও শুনে এখনো চোখ ভেজায়। আল্লাহর পেয়ারে মুহাম্মদ (সা.) এর মানসিক ও স্বাপ্নিক দর্শন পাওয়ার আশায় পুণ্য করেন। কাজেই এই সহজিয়া ও পুণ্যপ্রার্থী মানুষগুলোর বিশ্বাস নিয়ে কেউ যেন ব্যবসা করতে না পারে সেজন্য সজাগ হতে হবে। পথে খানিক জিরিয়ে নেয়ার বিনিময়ে অর্থ চাওয়া ও না দেয়ার বিনিময়ে দুর্ব্যবহারের মত কষ্ট যেন কাউকে বয়ে না বেড়াতে হয়- সেজন্য আচরণগত দিক সুরক্ষায় সকলকে মনযোগী হতে হবে।
মক্তব, মাদরাসা ও মসজিদগুলোর খেদমতকারীদের পুরো ব্যবস্থাকে শেখার, শিক্ষার ও পরীক্ষার ভেতর নিয়ে আসতে হবে। তাহলে আচরণগত উন্নয়ন আরো প্রবল হবে। পাশাপাশি মক্তব-মাদরাসা পরিচালনায় পোস্টার, মাইক টানাটানি, মার্কেটিং ভোটের মত বিভাজন, বিদ্বেষ বন্ধ হবে বা কমে আসবে। অন্যথায় প্রতি মাসে একজন করে নামাজী মসজিদের খবরাখবর নিবেন, নিজেকে খাদেম হিসেবে বিবেচনা করবেন- এই রীতি তৈরি করাই হতে পারে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।
দেশের ইমামরা যথেষ্ট মার্জিত ও জ্ঞানী। এখন প্রয়োজন তাদের হাত ধরে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়েও আলোচনা, বয়ান হওয়া। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের উদ্যোগে নির্মিত ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্রগুলোকে স্থানীয় পর্যায়ে কাজে লাগানো যেতে পারে। এটা করা গেলে ইসলামী জ্ঞানের সাথে বিজ্ঞান মনস্ক ও স্বনির্ভর জাতি গঠনে উৎপাদনমুখী আচরণ তৈরি হবে। মিলবে আচরণগত প্রশান্তি এবং ইসলামী সম্প্রীতি ও সাম্যের বাংলাদেশ।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা