দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক: দেশের বাজারে বহুল ব্যবহৃত টুথপেস্ট ও হ্যান্ডওয়াশে বিপদজনক মাত্রায় রাসায়নিক ‘প্যারাবেন’ পাওয়া গেছে, যা মানবদেহে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াবে। এছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং কিডনির সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
সাউথ কোরিয়ার ওনজিন ইনস্টিটিউট ফর অকুপেশনাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল হেলথ (ডব্লিউআইওইএইচ) সংস্থার সহযোগিতায় এই গবেষণাটি পরিচালনা করে বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো)।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারকে এই রাসায়নিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি টুথপেস্ট ও হ্যান্ডওয়াশে প্যারাবেনের উপস্থিতি সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
প্যারাবেন কী?
প্যারাবেন হলো জেনোস্ট্রোজেন। অর্থাৎ মানবদেহে বিদ্যমান হরমোনের মতোই এর রাসায়নিক গঠন। প্যারাবেন যা সাধারণত প্রসাধনী, দৈনন্দিন ব্যবহৃত ব্যক্তিগত পরিচর্যা পণ্য (টুথপেস্ট, হ্যান্ডওয়াশ, সাবান, শ্যাম্পু) মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এগুলো কার্যকর প্রিজারভেটিভ বা সংরক্ষক হিসেবে কাজ করে। প্যারাবেন কম খরচ এবং সহজলভ্য হওয়ার কারণে উৎপাদনকারীরা এটি বেশি পরিমাণে ব্যবহার করে থাকে।
শতাধিক বছরেরও বেশি সময় ধরে খাদ্য, ফার্মাসিউটিক্যাল, ব্যক্তিগত যত্ন এবং প্রসাধনী শিল্পগুলিতে প্যারাবেনগুলি সংরক্ষণাগার হিসাবে নিরাপদে ব্যবহৃত হয়েছে। প্যারাবেনের প্রধান ধরণগুলির মধ্যে মেথিলপ্যারাবেন, এথিলপ্যারাবেন, প্রোপলপ্যারাবেন, বুটিলপ্যারাবেন, আইসোপ্রাইপ্যারাবেন এবং আইসোবটিয়ালপ্যারাবেন।
যা পাওয়া গেল গবেষণায়
বাংলাদেশের জনপ্রিয় টুথপেস্ট এবং হ্যান্ডওয়াশগুলোতে প্যারাবেনের ব্যবহারের মাত্রা অনুসন্ধানের গবেষণা পরিচালনা করে এসডো। গবেষণা পরিচালনার জন্য ঢাকার বিভিন্ন স্থানীয় দোকান থেকে টুথপেস্ট এবং হ্যান্ডওয়াশের ৩০টি নমুনা সংগ্রহ করার পর ল্যাব পরীক্ষার জন্য সাউথ কোরিয়ার ওনজিন ইনস্টিটিউট ফর অকুপেশনাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল হেলথ (ডব্লিউআইওইএইচ) সংস্থায় পাঠানো হয়।
গবেষণায় দেখা যায়, টুথপেস্ট এবং হ্যান্ডওয়াশের সকল নমুনাতেই নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রার রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। নমুনাগুলোতে ফ্লোরাইড (শুধু টুথপেস্টে) এবং সোডিয়াম ডাইক্লোরাইডের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। প্রাপ্তবয়স্কদের পারসোনাল কেয়ার পণ্যে ২২টি নমুনার মধ্যে ৫টি পণ্যে সর্বোচ্চ মাত্রায় প্যারাবেনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিশেষ করে, একটি টুথপেস্টে ১ হাজার ৮২৩ মাইক্রোগ্রাম এবং দুটি হ্যান্ডওয়াশের নমুনায় ১ হাজার ৪০৩ মাইক্রোগ্রাম ও ১ হাজার ৮৩৪ মাইক্রোগ্রামের প্যারাবেনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
এমনকি শিশুদের একটি টুথপেস্টেও ৬৫৯ মাইক্রোগ্রাম মিথাইলপ্যারাবেন এবং ৫০.৫ মাইক্রোগ্রাম বিউটাইলপ্যারাবেনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) সেক্রেটারি জেনারেল ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, প্রাপ্তবয়স্কদের টুথপেস্ট মেডিপ্লাসে সবচেয়ে বেশি প্যারাবেন পাওয়া গেছে। কোলগেটেও প্যারাবেনের উপস্থিতি ছিল বেশি। হ্যান্ডওয়াশ স্যাভলন, সেপনিল ও লাইফবয়তে প্যারাবেনের উপস্থিতি বেশি পাওয়া যায়। শিশুদের টুথপেস্ট কোডোমোতে ভয়ংকর রকমের উচ্চ মাত্রায় প্যারাবেন পাওয়া গেছে। এ গবেষণায় সাতটি অন্যান্য দেশের নমুনাও বিশ্লেষণ করা হয়। কিন্তু দেখা গেছে যে, বাংলাদেশী পণ্যগুলিতেই সবচেয়ে বেশি মাত্রায় প্যারাবেন ব্যবহার করা হয়। তাই এসব পণ্যের ব্যবহার সীমিত করতে হবে।
নীরবে হচ্ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি!
গবেষণাটিতে মানব স্বাস্থ্যের উপর এসব রাসায়নিক পদার্থের সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাবের বিষয়গুলোও তুলে আনা হয়েছে। যেমন প্যারাবেনের কারণে হরমোন নিয়ন্ত্রণে ব্যাঘাত, প্রজনন সমস্যা এবং এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকিও সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে ফ্লোরাইডের অতিরিক্ত ব্যবহার হাড়ের ভারসাম্য নষ্ট করে এবং দাঁতের এনামেল গঠনে সমস্যা তৈরি করে। তাছাড়া অতিরিক্ত সোডিয়াম ডাইক্লোরাইড ব্যবহারের ফলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং কিডনির সমস্যাও সৃষ্টি হতে পারে।
এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) নির্বাহী পরিচালক সিদ্দিকা সুলতানা বলেন, প্রসাধনীতে ব্যবহৃত রাসায়নিককে অ্যান্ডোক্রাইন ডিসরাপ্টর (ইডিসি) বলা হয়। যা কৃত্রিমভাবে সংরক্ষণের ব্যবহার হয়। এগুলি আমাদের শরীরের হরমোন নিয়ন্ত্রণে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে এবং প্রজনন সংক্রান্ত জটিলতাও সৃষ্টি করতে পারে।
যা করণীয়
যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ)গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক পণ্যেই এমন উপাদান থাকে যা শরীরকে ব্যাক্টেরিয়ার হাত থেকে রক্ষা করার বদলে উল্টো ক্ষতি করে। এ জন্য মার্কিন সরকার দুই হাজারের বেশি পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
হ্যান্ডওয়াশের দুটি উপাদান শরীরের জন্য বেশি ক্ষতিকর। ট্রাইক্লোসান ও ট্রাইক্লোকার্বন নামের এই দুই উপাদানের উপস্থিতি ব্যাক্টেরিয়া ধ্বংস করতে পারলেও শরীরের জন্য মোটেই ভালো নয়। সাধারণ ভাবে জীবাণুনাশকের পরিমাণ ০.৩ শতাংশের বেশি হলে তা ব্যবহার করা উচিত নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর পরামর্শ হলো, হাত জীবাণুমুক্ত করতে চাইলে অ্যালকোহল দিয়ে তৈরি পণ্য ব্যবহার করা উচিত। এগুলো জীবাণু মারে, কিন্তু শরীরের অন্য কোনো ক্ষতি করে না। কাজেই বাজারে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল হিসেবে যে সব হ্যান্ডওয়াশ বিক্রি করা হয় তাতে কী কী উপাদান রয়েছে তা ভালোভাবে জেনে তবেই ব্যবহার করা উচিত। অতিরিক্ত রাসায়নিক মেশানো হ্যান্ডওয়াশ ব্যবহারের ফলে এমন জীবাণু জন্ম নিতে পারে যা কোনও ঔষধেই মরে না।
মানুষের মধ্যে সচেতনতা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়ে এসডো বলছে, অবশ্যই দৈনন্দিন পণ্য কেনার আগে লেবেল দেখে কেনা। এসব পণ্যে সঠিক মাত্রা নির্ধারণের আইন সুনিশ্চিত করা।
এসডো’র চেয়ারপার্সন ও সরকারের সাবেক সচিব সৈয়দ মারগুব মোর্শেদ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি এই রাসায়নিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি টুথপেস্ট ও হ্যান্ডওয়াশে প্যারাবেনের উপস্থিতি সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।