কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নের জন্য ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে ‘৬৪ টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রকল্প’ হাতে নেয় সরকার। কিন্তু সাড়ে চার বছর পার হলেও প্রকল্পের কাজ এখনো ৫৫ শতাংশ বাকি। ভবন নির্মাণ না হলেও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই আসবাব ও যন্ত্রপাতি কেনাকাটা চলছে পুরোদমে। অথচ আগামী ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে। ১ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার এ প্রকল্পের ভবন নির্মাণেও ব্যবহৃত হচ্ছে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী।
সম্প্রতি সরকারের বাস্তবায়ন পরীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তৈরি এক প্রতিবেদনে প্রকল্পটির নানা অনিয়মের চিত্র উঠে আসে। তারা ৬৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩২টি সরেজমিন পরিদর্শন করেছে। প্রতিবেদনের কপি দৈনিক আমাদের বার্তার হাতে রয়েছে।
প্রতিবেদনের সাতটি প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পন্ন করতে হলে কর্মপরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের প্রতি গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। নির্মাণসামগ্রী ও নির্মাণকাজের গুণগতমান নিশ্চিত করতে তদারিক ব্যবস্থা জোরদার, নিয়মিতভাবে প্রতি অর্থবছরে অডিট সম্পন্ন করা, শূন্যপদে জনবল নিয়োগসহ ভবিষ্যতে অনুরূপ প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই বাধ্যতামূলক করতে বলা হয়েছে।
গত মে মাস পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি মাত্র ৪৫ শতাংশ। তবে ৬৪ টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের মধ্যে মাত্র একটির নির্মাণকাজ শতভাগ শেষ হয়েছে এবং হস্তান্তরের অপেক্ষায় আছে। ১৮টির অগ্রগতি ৭৫ শতাংশের ওপরে, ১২টির অগ্রগতি ৫০ শতাংশের ওপরে, ১৫টির অগ্রগতি ২৫ শতাংশের ওপরে, ১৭টির অগ্রগতি ২৫ শতাংশের নিচে। ঝালকাঠি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের অগ্রগতি সর্বনিম্ন, যা মাত্র ৬ শতাংশ। তবে পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ৪৪টি প্যাকেজের মধ্যে ১৩টির কেনাকাটা হয়ে গেছে, বাকি ৩১টি প্যাকেজের কেনাকাটা প্রক্রিয়াধীন।
প্রকল্পটির পরিচালক সুব্রত পাল জানান, ‘প্রকল্পটির অগ্রগতি হয়েছে ৪৭ শতাংশ। আর প্রকল্পটি হচ্ছে বিদ্যমান টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সক্ষমতা বাড়ানো। এজন্য যন্ত্রপাতি ও আসবাব যে শুধু নতুন ভবনের জন্য কেনা হয়েছে, তা নয়। আগের পুরনো ভবনেও কিছু ব্যবহার হবে এবং নতুন ভবনে ব্যবহার হবে। আর নির্মাণকাজে নিম্নমানের ইট ব্যবহারের যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, আমরা সে ব্যাপারে ভবন নির্মাণে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছি।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বর্তমানে নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় ভবন নির্মাণকাজে আগ্রহ কমে গেছে ঠিকাদারদের। ফলে তারা নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের চেষ্টা করছে। যা নিয়ে বিপাকে রয়েছে ইইডি। তবে যন্ত্রপাতি ও আসবাব কেনা হয় প্রকল্প অফিস থেকেই। আর এ কাজে বড় অঙ্কের কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। ফলে ভবন নির্মাণ হোক আর নাই হোক, আসবাব ও যন্ত্রপাতি কেনাকাটা পুরোদমেই চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে প্রকল্প থেকে। আর টেকনিক্যাল স্কুলের সক্ষমতা বৃদ্ধির এ প্রকল্পের আসবাব মূলত নতুন ভবনের জন্যই। এমনকি যন্ত্রপাতিও নতুন ভবন নির্মাণের পরই সেখানে স্থাপন করার কথা।’
আইএমইডির প্রতিনিধিদল শরীয়তপুর টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়ে দেখতে পান, ভবন নির্মাণ শেষ না হলেও আসবাবপত্র ঠিকই সরবরাহ করা হয়েছে। নির্মাণকাজে রয়েছে যথেষ্ট ধীরগতি। আরও কিছু প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায়, ভবনগুলোর নিচতলার বারান্দাতে গ্রিলের ব্যবস্থা করা হলেও দোতলা থেকে ওপরের তলাগুলোতে তা দেওয়া হয়নি। কিন্তু অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মতে, শিক্ষার্থীরা বিপজ্জনকভাবে বারান্দার উন্মুক্ত দেয়ালে বসে থাকে, লাফালাফি করে। এতে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই গ্রিলের পাশাপাশি বাউন্ডারি ও ক্লোজ সার্কিট (সিসি) টিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা করা দরকার। এ ছাড়া হস্তান্তর করা স্কুলে ফায়ার ফাইটার সরঞ্জামও দেখতে পায়নি প্রতিনিধিদল।
প্রকল্পের গুণগত মানের ব্যাপারে বলা হয়েছে, পরিদর্শন করা ৩২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইটের পরীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য ১৭টি, পাথরের ১৫টি, বালুর ১৩টি, সিমেন্টের ১৯টি, রডের ২০টি এবং ঢালাইয়ের কংক্রিট সিলিন্ডার টেস্ট পরীক্ষায় ৬টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া যায়। সেখানে ইটের মান ৬৫ শতাংশ ভালো থাকলেও বাকি ৩৫ শতাংশ ইটের মান নিম্নমানের পাওয়া গেছে। এ ছাড়া পাথর, বালু, সিমেন্ট, রড ও ঢালাইয়ের কংক্রিট সিলিন্ডার টেস্ট পরীক্ষায় শতভাগ ভালো থাকলেও, পাথরের সাইজের ক্ষেত্রে ৬৭ ভাগ ওভার সাইজ পাওয়া যায়।
এ ছাড়া প্রকল্প শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র একবার অডিট হয়েছে। তবে এখনো অডিট রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। প্রকল্প পরিচালক প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছে, কোনো অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয়নি। বর্তমান পরিচালক ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে এ প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছেন।
আইএমইডি প্রতিনিধিদল সমীক্ষাকালীন গুচ্ছ দৈবচয়নের ভিত্তিতে নির্বাচিত ৩২ প্রতিষ্ঠানের ৮০০ জন শিক্ষার্থী, ৯৬ জন শিক্ষক ও ৩২০ জন অভিভাবকসহ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে ১ হাজার ৩৭৬ জনের সরাসরি সাক্ষাৎকার নেয়। তথ্য-উপাত্ত, ফলাফল ও পর্যালোচনার ভিত্তিতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তরদাতারা মনে করেন, চাহিদার আলোকে প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ জনবল নেই। জরুরি ভিত্তিতে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের বিদ্যমান শূন্যপদে জনবল (শিক্ষক ও প্রশিক্ষক) নিয়োগের মাধ্যমে প্রকল্পকে আরও বেশি গতিশীল করা সম্ভব হবে।