বই পড়ার মধ্য দিয়ে অবশ্যই সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ কমে আসবে। একটা মানুষ যদি ঠিক ঠিক বই পড়ে ভেতর থেকে সাম্প্র্রদায়িকতা কমে আসবেই। আমি অনেক ‘ডেঞ্জারাস বই’ দেখেছি। যে বই পড়লে মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যাবে। গোপনে পড়া লাগবে। ভালো সাহিত্য কিংবা ক্লাসিকস বই পড়লে অবশ্যই মানসিক বিকাশ ঘটবে, উন্নতি হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। বই পড়ার মধ্য দিয়ে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ এসব কমে আসবে কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষাবিদ কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানান।
প্রথম মেলার দেখা কবে পেয়েছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আপনাদের জন্মের আগে। তখন ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তধারার চিত্তদা (চিত্তরঞ্জন) কিছু বই নিয়ে বসেছিলেন। সেটাই প্রথম বইমেলা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে বটতলায় চটের উপর বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। কেউ চিন্তাও করেনি, সেই বইমেলা এভাবে বিকশিত হবে। এটা সারা পৃথিবীর একমাত্র বইমেলা, যেটা একমাস ধরেই চলে। এ রকম মেলা পৃথিবীতেই নেই। তরুণ প্রজন্ম বই পড়ার চেয়ে ফেসবুক, টুইটারে ব্যস্ত। তাদের উদ্দেশে জাফর ইকবাল বলেন, খুবই সহজ কথা আমার। এটা তো তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। আমি চাই, আমাদের তরুণরা প্রযুক্তিতে দক্ষ হোক। এতে কোনো আপত্তি নেই। আমার একটাই অনুরোধ তাদের কাছে, তারা প্রযুক্তিটাকে ব্যবহার করুক। প্রযুক্তি যেন তাদের ব্যবহার না করে। কিন্তু আনফরচুনেটলি সেটাই হয়ে যাচ্ছে। তারা প্রযুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। স্মার্টফোনটা একটু পর পর না দেখলে তাদের ভালোই লাগে না। টিং করে একটা শব্দ হয়, তখন তাকিয়ে দেখতে হয় কী হয়েছে! আমি চাই যে, তরুণরা এর থেকে বের হয়ে আসুক। কারণ পৃথিবীটা চালাচ্ছে কারা? সেই মানুষই, যাদের মস্তিষ্ক বিকশিত। যারা নাকি বই পড়ে। প্লেইন এন্ড সিম্পল। মানুষের মস্তিষ্ককে বিকশিত করার জন্য এর থেকে সহজ আর কোনো উপায় নেই। তাই বলি, যার বইয়ের সখ আছে সে বই পড়বে। আমি বলছি না যে, কঠিন কোনো বই পড়তে হবে। তার যে বই পছন্দ সেই বই-ই পড়–ক। কিন্তু বই পড়–ক।
ডিজিটাল মাধ্যমে ছাপার অক্ষর নিয়ে অনেকে শঙ্কিত, আপনার কি মনে হয় ছাপার অক্ষর থাকবে? উত্তরে জাফর ইকবাল বলেন, আজ থেকে একশ বছর পর ছাপার অক্ষর থাকবে কিনা আমি জানি না। কিন্তু আপাতত আছে এবং থাকবে। আমরা যতদিন বেঁচে থাকি। যদিও এখন অডিও বুক এসে গেছে। সেটা ঠিক আছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজের চোখে দেখে বই পড়াটা পছন্দ করি। এর মধ্য দিয়ে মস্তিষ্কের প্রক্রিয়াটা বেশি হয়। চোখে দেখছি, ব্রেনে যাচ্ছে, ব্রেন কাজ করে। শুনলে বিভিন্ন স্টেপ বাদ পড়ে যায়।
বইমেলায় তরুণদের কাজ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের দেশের তরুণরা অনেক ভালো কাজ করছে। এর মধ্যে যদি প্রচ্ছদ শিল্পীদের কথা বলি, তাহলে বলতে হয় তরুণ প্রচ্ছদশিল্পীদের কথা। তারা অনেক সুন্দর মনকাড়া প্রচ্ছদ করছে। তবে অপ্রত্যাশিতভাবে কাগজের দাম অনেক বেশিই। সেজন্য বইয়ের দামও বেশি হয়ে গেছে। যে কারণে মনে কষ্ট পেয়েছি। সরকার যেভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করে, সেভাবে যদি কাগজের দামটাও নিয়ন্ত্রণ করত তাহলে খুব খুশি হতাম। কারণ কাগজটা তো বাচ্চাদের লেখাপড়া কিংবা বইপ্রকাশের জন্য কাজে লাগে। এর মূল্যটা বাড়িয়ে দিলে তো সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেজন্য বেশ কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম বইমেলার আগে কাগজের দামটা কমবে, কিন্তু কমেনি। এতে হতাশ হয়েছি।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে বইয়ের পৃষ্ঠাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। একটা বই নিউজপ্রিন্টে হোক আর অফসেট প্রিন্টেই হোক। বই তো আমি একবারই পড়ব। পৃষ্ঠা দীর্ঘদিন থাকতে হবে ব্যক্তিগতভাবে এ ব্যাপারে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে সার্বিকভাবে বইয়ের মূল্য যদি কম হতো তাহলে বেশি খুশি হতাম। বইয়ের দাম অনেক বেড়ে গেছে। এটা নিয়ে ভাবতে হবে।
বইয়ের দাম বাড়ায় তরুণরা বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা বই কিনতে পারছে না। এছাড়া সরকার যে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গড়ার উদ্যোগ গ্রহণ করছে এক্ষেত্রে হোঁচট খাবে কিনা জানতে চাইলে এই শিক্ষাবিদ আরো বলেন, একটু তো হোঁচট খাবেই। তবে এটা কিন্তু একমাত্র ইস্যু না। আর তরুণদের বই কেনা প্রসঙ্গে বলি, আগে একটা তরুণ বই কিনত, এখন দুইটা তরুণ মিলে একটা বই কিনুক। একজন আরেকজনকে নিয়ে মিলেমিশে পড়–ক। আমরা যখন বড় হয়েছি, আমাদের কাছে কি বই কেনার পয়সা ছিল? ছিল না। তাই বলে আমরা কি বই পড়িনি? আমরা প্রচুর বই পড়েছি। আমি সব সময় বলি, কেউ যদি মনে করে বই কিনে পড়বে, তাহলে সে বই পড়ার মানুষ না। যে বই পড়ে, সে বই কিনে পড়ে না। যেখান থেকেই হোক জোগাড় করে বই পড়ে। তবে হ্যাঁ, আমি চাচ্ছি বইয়ের দাম কমানো হোক। যাতে সবার বই পড়াটা বেশি হয়।
মেলার আয়োজন সম্পর্কে জানতে চাইলে এই কথাসাহিত্যিক বলেন, এখন পর্যন্ত যা দেখলাম, বইমেলা বেশ সাজানো গোছানো পরিপাটি আছে। বিশেষ করে শিশুদের জন্য আলাদা বইয়ের কর্নার করা হয়েছে, এটা দেখে বেশ ভালো লেগেছে। সার্বিকভাবে বইমেলা ভালো লাগছে। তবে একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি, আগে আমার কাছে মানুষ আসতো অটোগ্রাফ নিতে, সেটা খুব ভালো লাগতো। এখন আসে ছবি তুলতে।