উচ্চ শিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বপ্নের জায়গা। শতবর্ষী বয়সি এই বিশ্ববিদ্যালয় নানান কৃতিত্বের সঙ্গেই তার কর্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বলার মতো যেমন অনেক সফলতার গল্প আছে তেমনি আছে নানা সীমাবদ্ধতার জায়গা। আবাসন-সংকট তার একটি বড় দৃষ্টান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি হলেই গণরুমের কালচার আছে। যেখানে ধারণক্ষমতার চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে বসবাস করছে। বর্তমানে বিভিন্ন বর্ষের দুই সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর এইসব গণরুমে বসবাস করতে সরেজমিন দেখা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আবাসন-সংকটকে একটি বড় সমস্যা হিসেবেই দেখছেন। আবাসন-সংকট দূরীকরণ ও সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে গত দুই বছর থেকেই সিট সংখ্যা কমিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের এই পরিকল্পনার সুফল পেতে আরো চার-পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) অনুরোধের ভিত্তিতে প্রভোস্ট কমিটির এক মিটিংয়ে গণরুমগুলোকে ‘বন্ধুরুম’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে গণরুমগুলোতে বাঙ্কবেড বসানোর কথা বলা হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি। এই বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ‘এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে কথা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সার্বিক দিক বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত ফলপ্রসূ ছিল না। তাই শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছি আমরা।’
সরেজমিন দেখা যায়, প্রথম বর্ষের সব শিক্ষার্থী গণরুমে থাকেন। ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে থাকা এসব রুমে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। রুমে শিক্ষার্থীদের নেই পড়াশোনা ও সুন্দর জীবনযাপনের পরিবেশ। তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের নেই বিন্দুমাত্র নিরাপত্তা। প্রচণ্ড গরমে এসব রুমে একসঙ্গে গাদাগাদি করে থাকাও কষ্টকর। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছেলেদের কিছু হলে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা নিজ হল ক্যান্টিনে খেতে পারেন না। নিজ হল দোকান থেকে কিছু কিনতে পারেন না। নিজ হল রিডিং রুমে পড়াশোনাও করতে পারেন না। সবখানেই বড় ভাইদের নিষেধাজ্ঞা আছে। আগে শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে উঠলেই সিট পেয়ে যেত। এখন সিট-সংকট এত চরম যে, মুহসিন হলের মতো বড় হলগুলোয় মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরাও সিট পাচ্ছেন না। মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের ছোট একটি রুমে ১২/১৪ জন করে থাকতে হচ্ছে।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়কে যেভাবে কল্পনা করেছি এখানে তার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখছি। ঠিকমতো রুমে ঘুমানো যায় না। পড়াশোনা করা যায় না। মাঝেমধ্যে রাতে হল থেকে বের করে দিচ্ছে ঘোরার জন্য। পরদিন সকালে ক্লাস ধরতেই কষ্ট হচ্ছে। নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বাইরে থাকারও কোনো ব্যবস্থা নেই।’
সব হলের গণরুম ও শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলে ১১০টি গণরুম আছে। এসব গণরুমে বিভিন্ন বর্ষের ২ হাজার ২৯৪ জন শিক্ষার্থী বসবাস করেন। হিসাব মতে গড়ে প্রতিটি হলে ছয়টির বেশি গণরুম আছে। প্রতি রুমে গড়ে ২০ দশমিক ৮৫ জন শিক্ষার্থী বসবাস করেন। ছেলেদের ১৩টি হলে ৮৪টি গণরুমে ১ হাজার ৭৫৯ শিক্ষার্থীর বসবাস আর মেয়েদের পাঁচটি হলে ২৬টি গণরুমে ৫৩৫ শিক্ষার্থীর বসবাস। ছেলেদের হলের সবগুলো গণরুম ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে আর মেয়েদের হলে কিছু ছাত্রলীগ আর কিছু হল প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে।
এ বিষয়ে প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. আব্দুল বাছির বলেন, ‘অনেক আগ থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন-সংকট হয়ে আসছে। তবে এখন তা কিছুটা মাত্রাতিরিক্ত। সরকারের সদিচ্ছা আছে নতুন হল তৈরির ব্যাপারে। তবে আমাদের জায়গার সংকুলান আছে। কোথায় হল তৈরি করা হবে তা একটি চ্যালেঞ্জ। আবার মেয়ে শিক্ষার্থীদের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এখন মেয়েদের জন্যও চিন্তা করতে হচ্ছে। আবাসন-সংকট নিয়ে গত সিনেটে বিস্তারিত কথা হয়েছে। সার্বিক চ্যালেঞ্জ বিবেচনা করেই আমাদের একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে।’
সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা ভর্তিতে আসন সংখ্যা কমিয়েছি। এখন হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের চাপ কমেছে। আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে আবাসন-সংকট কমিয়ে আনতে পারব বলে আমরা আশাবাদী।’