আমি সবসময়ই প্রত্যাশাকে অনেক বড় করে দেখি। আমার এই সাতাশি বছরের জীবনে ইংরেজ শাসন থেকে শুরু করে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ পর্বের সবকিছুই আমি দেখেছি। আমরা যে পাকিস্তানের হাত থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পেরেছি—সেই মুক্তির পেছনের শক্তিটির কথা আমরা ভুলে গেছি। আমাদের প্রত্যাশাগুলোকে, আমাদের বর্তমানকে আশানুরূপ করতে হলে অতীতের সত্যের সন্ধান করতে হবে। প্রকৃত প্রস্তাবে নিকট অতীতের ইতিহাস না জানলে বর্তমানকে বোঝাও যায় না, নিজেদের উপযোগী করে তাকে প্রতিষ্ঠাও করা যায় না। ইতিহাসে আমরা যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন করেছিলাম, সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কথাটি আজকের দিনে আমরা প্রায় ভুলে গেছি।
আমাদের এই দেশটি স্বাধীন করেছিলাম আমরা বুকের রক্ত দিয়ে। শুধু স্বাধীনই করি নাই, স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার জন্য আমরা চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি গ্রহণ করেছিলাম। এই চার মূলনীতি যদি আমরা যথার্থভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারতাম, তাহলে স্বাধীনতার জন্য আমাদের যে প্রত্যাশা ছিল—সেই প্রত্যাশাটা পূরণ হতে পারত। সেটি হয়নি। কেন হয়নি, তা সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়। তবে একটা জিনিস আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, স্বাধীনতা অর্জনের পর সেই আন্দোলনকে আমরা ভুলে গেছি, বর্জন করেছি। তাকে বহাল রাখতে পারলে এ বাংলাদেশের প্রকৃত মর্যাদা আমরা রক্ষা করতে পারতাম, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত মূল্যবোধ আমরা রক্ষা করতে পারতাম। আমাদের প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির একটা অসামঞ্জস্য ঘটে গেছে।
তবে আমি নিজেকে সব সময়ই আশাবাদী মনে করি। এই অর্ধশতাব্দীতে আমাদের যা প্রাপ্তি হয়েছে তা যথেষ্ট নয় ঠিকই, তবে স্বাধীনতা নিজেই একটা প্রাপ্তি। সেই স্বাধীনতাকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। তার জন্য আমাদের যে পথে অগ্রসর হতে হবে, সেই পথটা যদি আমরা এখনো না ধরতে পারি—তাহলে স্বাধীনতার চার বছর যেতে না যেতেই আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে যারা ক্ষমতায় আরোহণ করেছিল, তারা বাংলাদেশের বুকে আবারও পাকিস্তানের যে ভূতকে নামিয়ে এনেছিল, সেই ভূতকে তাড়ানোর প্রত্যয় ধারণ করতে পারব না। আর তা না পারলে যে প্রত্যাশা নিয়ে আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলাম, সেই প্রত্যাশা কোনোদিন পূরণ হবে না। তার জন্যই আজকে আমাদের স্বাধীনতার সেই মূল্যবোধগুলোকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। আমি খুবই দুঃখিত এবং আশ্চর্য হয়ে যাই যে, আমাদের তরুণ প্রজন্ম প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের বাংলাদেশের সৃষ্টির ইতিহাসটা বোঝে না। স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই। এ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার দায়িত্বটা কিন্তু আমাদেরই ছিল। দেরি হয়ে গেলেও সেই দায়িত্ব আজকে আমাদের পালন করে যেতে হবে।
স্বাধীনতার জন্য যে দল নেতৃত্ব দিয়েছিল যদিও আজ সেই দলই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছে, তার পরও পাকিস্তানের ভূতকে তারা তাড়াতে পারে নাই। এখনো আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির মধ্যে একটি বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। একটা বিশেষ ধর্ম রাষ্ট্রধর্ম থাকবে, আবার কীভাবে স্বাধীনতার চার মূলনীতিও বজায় থাকবে, আমি এ ব্যাপারটাই বুঝতে পারি না। রাষ্ট্রের আত্মা থেকে এই গোঁজামিলের অবসান করতে হবে। সেটি না পারলে স্বাধীনতার প্রত্যাশার যে প্রাপ্তি, সেই প্রাপ্তি আমরা পাব না।
কাজেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মূল্যবোধের মধ্যেই আমাদের দেশের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সব কথা নিহিত আছে। আমাদের এবং আমাদের নতুন প্রজন্মকে সেই ইতিহাস ও মূল্যবোধের কথা জানাতে হবে। তবেই আমরা আমাদের হারানো পথে আবার উঠে দাঁড়াতে পারব। তরুণ প্রজন্মের হাত ধরেই আমাদের স্বাধীনতার প্রত্যাশার প্রাপ্তি হবে। নতুন বছরে এই আমার প্রত্যাশা।
লেখক : যতীন সরকার, প্রাবন্ধিক ও বুদ্ধিজীবী।