‘Bay of Bengal Pilot’- এর দুইটি ভলিউম পাই গ্রিক বণিকপোত ‘এমভি এলপিদা’য়। ব্রিজরুমের এককোণে স্টিলওয়াল সেঁটে সুদৃশ্য এক আলমারিতে সারি সারি আরো বই। সমুদ্র চিনতে ও জানতে বইগুলো অপরিহার্য। অত বইয়ের মাঝে ‘ÔBengal’ শব্দটি আমাকে আকর্ষণ করে স্বাদেশিক মায়ায়। প্রথম ভলিউমে আছে ‘বঙ্গোপসাগর’-এর পরিচিতিমূলক পাঠ। আছে বঙ্গীয় জনপদ, জীবনাচার আর বিশ্বের বিপুল জলরাশির বৃহত্তম ‘উপসাগর’-এর পরিব্যাপ্তির কথা। দ্বিতীয়টিতে সামুদ্রিক বৈশিষ্ট্যাবলি। সে প্রায় সাড়ে তিনদশক আগের কথা। দশককাল আগে আমরা এই উপসাগরের আরো বিশাল পরিধির মালিকানা পেয়েছি আদালতের রায়ে।
বিজ্ঞান বলে, পৃথিবী প্রাণহীন ছিলো শতকোটি বছর। ভূ-মণ্ডলের তিনভাগ জল, আর এই জলই ছিলো প্রথম প্রাণের আধার। মহাসাগর, সাগর, উপসাগর, হ্রদ, প্রণালী ইত্যাদি সব মিলেই জলভাগ। জলজ এককোষী জেলির মতো পদার্থই প্রথম প্রাণবিন্দু, প্রাণি তাকে বলা যায় না। তবে প্রথম জীবনের ছোঁয়া বলে তার নাম Protoplasm । গ্রিক শব্দ। ‘প্রোটোস’ মানে প্রথম আর ‘প্লাজম’ মানে জীবন। পৃথিবীর এই আদি প্রাণসত্তা সাগরে ভেসে বেড়িয়েছে আরো শতকোটি বছর। ক্রমে ক্রমে সেটি ভেঙেছে, বেড়েছে কোষ। মাছের আদলে সেই কোষ রূপান্তরিত হয়েছে লক্ষ-কোটি বছর ধরে। যুগ-বিভক্তির হিসেব ধরে ‘অর্ডোভিসিয়ান’, সিলুরিয়ান, ডেভোনিয়ান, পারমিয়ান, ট্রায়াসিক. ক্রিটেশাস ইত্যাদি যুগ অতিক্রমকালে প্রাণিকুলের বিবর্তন হয়েছে বিস্ময়কর গঠনশৈলীর চমকে। সঙ্গে স্থলভাগে ভেসে এসছে অচিনপুরের উদ্ভিদ। আধুনিককাল অবধি বিজ্ঞানীরা জল-স্থল মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ প্রাণির হিসেব পেয়েছে, যার ১৬ শতাংশ বাস করে সমুদ্রে। এদের মাত্র ২ শতাংশ সাগরের মধ্যগহীনে আর ৯৮ শতাংশ ভাগ একবারে তলদেশে। ধরা-ছোঁয়ার প্রায় বাইরে।
আমাদের বঙ্গোপসাগর ভারত মহাসাগরের কোলে ত্রিভুজাকৃতির একটি উপসাগর, যার আয়তন ২১ লাখ ৭২ হাজার বর্গকি.মি.। এর গভীরতম স্থানটি ৫.২৫ কি.মি.। লবণাক্ততাই সাগরের লাবণ্য। এর তারতম্য ঘটে স্রোতধারা, তাপ, ঋতুবৈচিত্র্য ইত্যাদির রূপান্তরে। ২০০-৩০০ মিটার গভীরতায় ৩৫ শতাংশ এবং ৫০০ মিটার গভীরতায় রয়েছে ৩৫.১০ শতাংশ লবণাক্ততা। অতি গভীরতায় লবণাক্ততা কমে আসে। ১ কি.মি.পরে লবণাক্ততা ৩৪.৯৫ শতাংশ এবং ৪.৫ কি.মি. গভীরতায় সেটি ৩৪.৭% শতাংশে পৌঁছায়। বঙ্গোপসাগরের পানির রং অন্যান্য সাগরের মতোই গাঢ় নীল। তবে উপকূলভাগে সবুজাভ এবং ক্রমান্বয়ে হালকা নীল থেকে গভীর-গাঢ় নীলে তার শ্রীবৃদ্ধি। পানির স্বচ্ছতা নয়নসুখকর। খালি চোখে ৪০ থেকে ৫০ মিটার গভীর পর্যন্ত দেখা যায়। এই উপসাগরের পৃষ্ঠতলে ঋতুগত পরিবর্তনের ব্যাপকতা প্রবল যা পৃথিবীর আর কোনো সাগর-মহাসাগরে দেখা যায় না। এখানে অর্ধ-আহ্নিক ধরনের জোয়ার-ভাটা হয়, অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টার কিছু বেশি সময়ে দুবার জোয়ার ও দুবার ভাটা হয়। এই জোয়ার-ভাটার ওপর সমুদ্র তলদেশের ভূ-প্রকৃতি ও উপকূলের গঠন-প্রকৃতি নির্ভর করে।
জলরাশির দক্ষিণে গভীর সমুদ্রের বুকে মাছ ধরা আমাদের সাহসী জেলেদের এক ঐতিহ্যিক কর্মযজ্ঞ। মাছ আহরণ-বিপননের অর্থনৈতিক এলাকার আয়তন ১ লাখ ২০ হাজার বর্গকি.মি.। একে Continental shelf বলে। সাধারণত ২০০ মিটার গভীরতার ঊর্ধ্বে মাছ পাওয়া যায় না। এই ২০০ মিটার গভীরতাসম্পন্ন মূল মহীসোপান এলাকার পরিমাণ ৬৫ থেকে ৭০ হাজার বর্গকি.মি. যেখানে জেলেদের বিচরণ বেশি। উক্ত পরিমাণ এলাকার মধ্যে ৩৭ হাজার বর্গকি.মি. এলাকা ৫০ মিটার গভীরতাসম্পন্ন। এই অঞ্চলটিতেই মাছ থাকে বেশি। সামুদ্রিক মাছ কি মিঠেপানির মাছের মতো সুস্বাদু? এই প্রশ্নের উত্তরে শুধু এই বলা যায় যে, খাদ্যাভ্যাস জনপদ থেকে জনপদে যেমন ভিন্ন, ব্যক্তির রুচির কাছেও তা অভিন্ন নয়। পৃথিবীতে সাগরধোয়া যে কয়টি দেশ আছে তার অধিবাসীরা সবাই লোনাজলের মাছের সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত। আমরা হিমালয় থেকে উৎসারিত জলধারায় বিপুল পলির যৌগিক উপাদানে যে সবুজ শস্যশয্যা পাই তার ভোক্তামূল্য এবং একই ধারায় সৃষ্ট নদী-বিল-ঝিল-হাওরে যে মৎস-সম্পদ পাই তাই নিয়েই আমাদের চিরসন্তুষ্টি। সাগরের দিকে, বিশেষ করে মাছ খাওয়ার প্রশ্নে আমাদের রয়েছে রুচির সীমাবদ্ধতা।
তবে আজ সেই দৃষ্টি পাল্টেছে অনেকটাই। এখন বাজারে আমরা দু-চার রকমের সামুদ্রিক মাছের পাশাপাশি তার শুঁটকিও পাই প্রচুর।
বঙ্গোপসাগরে প্রধানত শিরপদী (Cephalopoda), তরুণাস্থি (Chondrichthyes) ও অস্থিযুক্ত মাছের (Osteichthyes/Gymnothorax) আধিক্য রয়েছে। গোটা দশেক শিরপদী মাছের মধ্যে প্রধান দুটি মাছ হলো নুইল্লা এবং চেয়াই। তরুণাস্থি মাছের ধরন বিশ-একুশ, যার অন্তর্ভুক্ত হাঙর এবং বিদ্যুৎ মাছ। আর অস্থিময় মাছের সংখ্যা কম-বেশি দেড়শ’। এই গোত্রের মধ্যে রয়েছে ইলিশ, ফ্যাঁসা, চেলা, মাগুর, কোড়াল, উড়াল, চান্দা, কৈ, সলি, মৌরি, পোয়া, খল্যা, রঙ্গিলা, বাইল্যা, পোটকা ইত্যাদি। আমাদের অতি প্রিয় ইলিশের রয়েছে তিনটি জাতি- গুত্তা ইলিশ (Hilsa Kelee), পদ্মা ইলিশ (Hilsa/Ilisa) এবং চন্দনা ইলিশ (Hilsa Toli)। এই তিন-এর জন্মস্থান বঙ্গোপসাগর। উল্লেখ্য যে, তরুণাস্থি প্রজাতির মাছের অন্যতম প্রধান তিমি ও হাঙর, তবে বঙ্গোপসাগরে তিমির অস্তিত্ব প্রায় শূন্যের ঘরে।
১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে আরাকান উপকূলে একটি তিমি ধরা পড়েছিলো। শতবর্ষপরে ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে কক্সবাজারের কাছে সোনাদিয়া দ্বীপে এবং ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে কাছাকাছি এলাকায় একটি করে দুইটি তিমি আটকা পড়েছিলো বলে জানা যায়। সবশেষ ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে সুন্দরবনের খাড়িতে ধরা পড়ে একটি। বিজ্ঞানীদের ধারণা এগুলো সব দলছুট তিমি। আর হাঙরের রয়েছে এগারোটি প্রজাতি। এগুলো তেমন আক্রমণাত্মক নয়। সামুদ্রিক মাছের প্রধান আকর্ষণের দিক পুষ্টিগুণ। আমাদের শরীরে আমিষের প্রয়োজন ছাড়াও এর তেল-চর্বি (বিশেষ করে যকৃতের) সবার জন্য ভালো কারণ সেখানে রয়েছে ভিটামিন-এ। অবশ্য সতর্কবার্তাও আছে, ভিটামিন-এ’র আধিক্য পাকস্থলির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। খোলসযুক্ত মাছে রয়েছে ‘পাওলিন’ নামক উপাদান যা টিউমার বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে।
বঙ্গোপসাগরের জেলেরা নানা বর্ণের, নানা ধর্মের। জোয়ারের সময় গঙ্গাপূজা দিয়ে হিন্দু জেলেরা সাগরে ভাসায় নৌকা। শরৎকালের শুরুতেই তুলনামূলকভাবে শান্ত সাগরের উপকূলীয় এলাকায় জাল আর নৌকা নিয়ে তারা নামে গভীর প্রত্যাশা নিয়ে। তারা ‘জলদাস’। এটি তাদের বংশগত পদবি। মুসলমান জেলের সংখ্যা এখনও কম। জীবিকার কারণে তারা অনেকেই হিন্দু জেলেপল্লিতেই বসবাস করে। সপাল অরিত্রধারী তরিত্র সাগরবক্ষে নাচিয়ে শত বছরের ঐতিহ্য রক্ষা করেছে জলদাসরা। ঊর্মিমুখর বেতাল-বেসামাল সফেন সাগর মৎসজীবীদের জন্য কখনও কখনও হয়ে ওঠে বহুমুখী রণক্ষেত্র। জলাবর্তের নিষ্ঠুর টানে নৌকা বা জীবন কোনোটিই রক্ষা পায় না। সাধারণ নৌকার পাশাপাশি এখন এসেছে কয়েক হাজার যন্ত্রচালিত নৌকা। সেই সঙ্গে আছে গভীর সাগরে যাওয়ার ট্রলার।
মাছ ধরা চলে একটানা ছয় মাসাধিককাল। প্রধানত চৈত্র-বৈশাখে জেলেরা সাগরমুখী হয় না। যন্ত্রচালিত নৌকাগুলো প্রতি ট্রিপে মাছ পায় এক থেকে তিন টন পর্যন্ত। সাগরে বিচরণকালও সীমিত। ট্রলারগুলো মাছ ধরে মাসাধিককাল ধরে। আছে তাদের মাছ হিমায়িত করার ব্যবস্থা। মাছ ধরার প্রাচীন এক পদ্ধতি আজও সচল বঙ্গোপসাগরে। শিকারের মৌসুমে জেলেরা বেছে নেয় উপকূলবর্তী কোনো দ্বীপ, চর বা গ্রাম। মাছ শিকার করে তার বিপনন ও শুঁটকি করার সুবিধার জন্যই এই ব্যবস্থা। পটুয়াখালির কুয়াকাটাসহ বেশ কিছু চর এই মৎস-মজুদের জন্য উত্তম জায়গা। কিন্তু রোমাঞ্চকর এই জীবন-ব্যবস্থায় কৃষকের মতোই জোতদারের যষ্ঠিতলে জীবন যায় জেলেদের।
এক মৌসুম শেষে আরেক মৌসুমের মাছ ধরার আর্ধিক যোগান আর তাদের অবশিষ্ট থাকে না। ঝড় বা সাইক্লোনে নৌকাডুবিতে মাছসহ অসংখ্য জীবনহানি ঘটে। মেনে নেয় তারা অদৃষ্টকে। জেলেজীবনের সবচেয়ে অসহায়ত্বের দিক হচ্ছে তাদের স্বাস্থ্যগত অপরিচ্ছন্নতা। এটি অপরিত্যাজ্য বৈশিষ্ট্যও বটে। সাগরফেরত জেলে বড় নখ আর চুল-দাঁড়িতে আচ্ছন্ন চেহারায় রূপ নেয় অরণ্যচারী দস্যুর মতো। পেশিময় বলিষ্ঠ শরীর কাঠামোটি তখন নিতান্তই গৌণ হয়ে যায়। তারপরও পেশার নেশায় অবিচল জেলেরা দেশকে দিচ্ছে বিপুল পুষ্টিসম্ভার।
মৎস সম্পদ ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের রয়েছে আগাছা, শৈবাল বা শেওলা, ঝিনুক, কাছিম ও কাঁকড়া। ১৬৫ প্রজাতির আগাছা বা শৈবাল পাওয়া যায় সেন্টমার্টিন-উপকূলবর্তী অঞ্চলে। ‘সি-ফুড’-এর তালিকায় এই আগাছা/শৈবাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই শৈবালে রয়েছে আমিষ, চর্বি, খনিজপদার্থ, আঁশ, শর্করা, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লোহা, থায়ামিন, নায়াসিন, ভিটামিন-সি, ক্যারোটিন এবং খাদ্যশক্তি। এই কারণে রাশিয়াতে শৈবালকে ‘সামুদ্রিক বাঁধাকপি’ বলে। স্যুপ, জেলি, পুডিং ও সালাদ তৈরিতেও এই শৈবালের ভূমিকা অসামান্য। অন্যসব সম্পদের মধ্যে স্বর্ণ, হিরক, তেল, গ্যাস ছাড়াও রয়েছে লবণ। সাগর থেকে বছরে আমরা পাই ১৫ লাখ টন লবণ। সামুদ্রিক ঝিনুক আরেক অর্থকরী সম্পদ। ঝিনুক থেকে চুন, শাঁখা ইত্যাদি উৎপাদিত হলেও মূল লক্ষ্য থাকে মুক্তার দিকে।
সামুদ্রিক ঝিনুক ১.৫২ মি. পর্যন্ত লম্বা হয়। এর খোলসের রয়েছে বেশ কয়েকটি স্তর। এইসব স্তরের মধ্যে থাকে ন্যাক্রিয়াস স্তর বা ÔMother of pearl’, এটি ক্যালসিয়াম কার্বোনেট ও কনকিওলিনের স্তর দিয়ে তৈরি। এই স্তরেই মুক্তা জন্মে। সাগরে ঝিনুকের চাষ হয় ৩ থেকে ৩০ মিটার গভীরতায়। এখানে সহনীয় তাপমাত্রা ৪ থেকে ৩২ ডি. সেলসিয়াস আর লবণাক্ততার পরিমাণ ২০-৩৭ শতাংশ। সাধারণভাবে দেখা গেছে কাদা-বালির মিশ্র তলভাগ ঝিনুক চাষের জন্য উত্তম।
বঙ্গোপসাগরের পরিসীমায় আমাদের বেশ কিছু দ্বীপ এবং চর রয়েছে। এসব সাগরভাসা ভূখণ্ড কিছু জেগে ওঠে স্থায়ী রূপ পায়, কিছু লীন হয় প্রাকৃতিক কারণেই। ‘সেন্টমার্টিনস’-এর কথা আমরা সবাই জানি। নয়নাভিরাম পর্যটনস্থল এখন। সুপ্রাচীন এই দ্বীপের আধিবাসীরা শতভাগই ছিলো জেলে। এখন জীবিকা বহুধা। টেকনাফ থেকে প্রায় ২১ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমের এই দ্বীপটির স্থানীয় নাম ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’। এছাড়া ভোলা, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া, মহেশখালি ইত্যাদি সুপরিচিত। হাতিয়া থেকে ৯৭ কি.মি. দক্ষিণে ৪৮৪ বর্গকি.মি. আয়তনের নতুন আরেক ভূমিখণ্ডের নাম ‘নিঝুম দ্বীপ’। এছাড়া সুন্দরবনের হাড়িয়াভাঙা ও রায়মঙ্গল নদীর মোহনার ঠিক দক্ষিণে শতবর্ষ আগে জেগে ওঠে এক দ্বীপ। ১৯২৭-২৯ খ্রিষ্টাব্দে সুন্দরবনের জরিপের সময় দ্বীপটিতে দেখা যায় এক বিশাল তালগাছ।
সেই থেকে দ্বীপের নামকরণ হয় ‘তালপট্টি’। ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমানায় আগের দ্বীপটির কাছেই জেগে ওঠে আরেক দ্বীপ, যা ‘দক্ষিণ তালপট্টি’ নামে পরিচিত পায়। কাছাকাছি অপেক্ষাকৃত ছোটো আরো একটি দ্বীপের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর নাম ‘নয়াদ্বীপ’। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে উড়িরচরের প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে দক্ষিণ তালপট্টি সাগরে বিলীন হয়ে যায়। বিস্ময়কর এই যে, ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের পর প্রণীত প্রতিটি ম্যাপে তালপট্টিকে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় রাখা হয়নি।
‘চর’ মূলত ভঙুর ভূখণ্ড। আমাদের আছে বাগাদোনা, চর গজারিয়া, পুতনি, চর কুকরি-মুকরি, মনপুরা, মার্গারেট, আন্দার চর, কালী চর, উড়ির চর, দুবলার চর ইত্যাদি। আরো নাম না জানা অনেক ছোটো ছোটো চর রয়েছে বঙ্গোপসাগরে।
ভারতের সঙ্গে উপসাগরের সীমা নিয়ে বিরোধ ছিলো আমাদের। সম্প্রতি বিরোধপূর্ণ ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকি.মি.-এর মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকি.মি. পেয়েছে বাংলাদেশ। নেদারল্যান্ডসের ‘হেগ’-এ অবস্থিত আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতে ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে এই বিরোধ-নিষ্পত্তি হয়। শুরুটা ছিলো মিয়ানমারকে নিয়েও। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বিরোধ-নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ উক্ত আদালতে যায়। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মিয়ানমারের সঙ্গে মামলার নিষ্পত্তি হয় এবং আমরা বিরোধপূর্ণ ৮০ হাজার বর্গকি.মি. সমুদ্রজলের মধ্যে ৭০ হাজার বর্গকি.মি.-এর অধিকার লাভ করি।
ভারতের সঙ্গে বিরোধের মিমাংসা হওয়ায় বাংলাদেশ ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে মহীসোপানে অবাধ প্রবেশাধিকার পায়। এই মামলার রায়ের ফলে বাংলাদেশ আগের চাইতে ১লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকি.মি. বেশি টেরিটোলিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইলে একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশের সব ধরনের প্রাণিজ-অপ্রাণিজ সম্পদের অধিকারী হলো। অস্তিত্ব না থাকলেও ‘দক্ষিণ তালপট্টি’র অঞ্চলের সাগরবক্ষ আদালতের রায়ে ভারতের অধিকারে গেছে।
একজন সমুদ্রবিজ্ঞানী বলেছেন, ‘সমুদ্রের সুনীল জলরাশি, দূরদিগন্তে বিলীয়মান দিক চক্রবাল রেখার চিহ্ন, সঙ্গে শ্বেত, নীল বা রক্তিম আকাশের মিলনদৃশ্য দেখে আমার ব্যাকুল মন দুলে ওঠে, আমি যেন ধরিত্রীর হৃদস্পন্দন শুনতে পাই।’
লেখক: অন-লাইন ফ্রিল্যান্সার