দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এর জন্মদিন আজ। তিনি বিশ শতকের বাংলার সবচেয়ে প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অন্যতম।
মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের এক উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান চিত্তরঞ্জন দাশ ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ভূবনমোহন দাশ কলকাতা হাইকোর্টে ‘সলিসিটা’র ছিলেন। প্রথম জীবনে সি আর দাস ভবানীপুরের (কলকাতা) লন্ডন মিশনারি সোসাইটির ইনস্টিটিউশনে শিক্ষা লাভ করেন। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ইংল্যান্ডে গিয়ে ইনার টেম্পলে যোগদান করেন এবং ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে ব্যারিস্টার হন ।
ঐ একই বছর তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং কলকাতা হাইকোর্টে ব্যারিস্টার হিসেবে নিজের নাম তালিকাভুক্ত করেন। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে অরবিন্দ ঘোষের বিচার সি.আর দাশকে পেশাগত মঞ্চের সম্মুখ সারিতে নিয়ে আসে। তিনি এমন চমৎকারভাবে কেসটির পক্ষসমর্থন করেন যে অরবিন্দকে শেষ পর্যন্ত বেকসুর খালাস দেয়া হয়।
বিশ শতকের প্রথম দিকে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। অনুশীলন সমিতির মতো বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। এস.এন ব্যানার্জী, বি.সি পাল ও অরবিন্দ ঘোষের সহকর্মী হিসেবে তিনি বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫)-কে বাংলায় বিপ্লবী কর্মকান্ড বিস্তৃত করতে সদ্ব্যবহার করেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে ভবানীপুরে অনুষ্ঠিত বাংলার প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন তিনি। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে এম. কে গান্ধীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আইনজীবীর পেশা পরিত্যাগ করেন এবং ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে প্রিন্স অব ওয়েলসের কলকাতা সফর বর্জনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। সরকার তাকে অনেকবার কারাগারে অন্তরীণ করে।
গান্ধী যখন অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করেন তখন চিত্তরঞ্জন দাশ তার তীব্র সমালোচনা করেন এবং বিষয়টিকে গুরুতর ভুল বলে নিন্দা করেন। তার মতে, গান্ধীর এ কাজ রাজনৈতিক কর্মীদের মনোবল বহুল পরিমাণে কমিয়ে দেয়। ঐ চরম সংকটপূর্ণ সময়ে তিনি পরিষদে প্রবেশ কর্মসূচি অর্থাৎ পরিষদের অভ্যন্তরে অবস্থান নিয়ে অসহযোগ চালিয়ে যাবার সূত্র নিয়ে এগিয়ে আসেন। কংগ্রেসের আইন পরিষদ বর্জনের নীতিকে তিনি দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করেন।
দেশবন্ধুর অভিমত ছিলো যে, বঙ্গীয় আইন পরিষদ এ বলিষ্ঠ গ্রুপ সৃষ্টিকারী মুসলিম সদস্যদের আন্তরিক সহযোগিতা ব্যতিরেকে স্বরাজবাদীদের বাধাদানের নীতি সফল হবে না। বস্ত্তত, দৃঢ় প্রত্যয় ও বিশ্বাসসহ তিনি ছিলেন রাজনৈতিক বাস্তববাদী এবং প্রচন্ড বিরোধিতার মুখেও তিনি নিজ অবস্থান থেকে কখনও বিচ্যুত হতেন না।
তিনি নিজে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জ্বলন্ত অগ্রদূত ছিলেন বলে বাংলার সাম্প্রদায়িক সমস্যা নিরসনে স্মরণীয়ভাবে সাফল্যলাভ করেছেন। বেঙ্গল প্যাক্ট নামে সাধারণভাবে পরিচিত এক চুক্তির মাধ্যমে তিনি বাংলার মুসলমানদের আস্থাভাজন হয়ে তাদেরকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসেন।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত স্বরাজ্য পরিষদ দলের এক সভায় চুক্তিটির শর্তাবলি গৃহীত হয়। দুঃখের বিষয় যে, বাংলায় কংগ্রেসের অনেক নেতা চুক্তিটির বিরোধিতা করে।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা কর্পোরেশন-এর নির্বাচনে স্বরাজবাদী বিজয় অর্জন করে এবং সি.আর দাশ প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। পরবর্তী মেয়াদের জন্যও তিনি পুনর্নির্বাচিত হন। ১৯২৩ ও ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে যথাক্রমে লাহোর ও কলকাতায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত শ্রমিক ইউনিয়নের কংগ্রেসে তিনি সভাপতিত্ব করেন।
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুন মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ পরলোকগমন করেন।