আমাদের উপমহাদেশের নারী সাংবাদিকতার শুরু হয় কবি সুফিয়া কামালের মাধ্যমে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জুলাই 'সাপ্তাহিক বেগম' পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন সুফিয়া কামাল। পরে নূরজাহান বেগম পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই সংবাদমাধ্যমে নারীদের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় শহিদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন 'শিলালিপি' পত্রিকায় পাকিস্তানের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে সেভার ছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী দীর্ঘ সময় ধরে নারী সাংবাদিক ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন। শুক্রবার (৮ মার্চ) খবরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন মারজান ইমু।
প্রতিবেদনে আরো জানা যায়, সাংবাদিকতায় তরুণীদের ব্যাপক আগ্রহ শুরু হয় দেশের প্রথম বেসরকারি টিভি একুশে টেলিভিশনের একঝাক নতুন মুখের রিপোর্ট। দেখে। ২০০০ সাল থেকে গণমাধ্যমে নারীর উপস্থিতি যেমন বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে গণমাধ্যমের সংখ্যাও। বিগত দুই যুগে অনেক নারী সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তবু চ্যালেঞ্জিং ও ঝুঁকিপূর্ণ এই পেশায় অন্য যেকোনো পেশার চেয়ে এখনো নারীর উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে অনেক কম। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সহস্রাধিক স্যাংবাদিকের মধ্যে নারী সাংবাদিকের সংখ্যা মাত্র ৭২। এ ছাড়া ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রায় ছয় হাজার সদস্যের মধ্যে নারী সাংবাদিকের সংখ্যা ১৫০-এর বেশি নয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে সাংবাদিকতা পেশায় প্রায় এক হাজার নারী অছেন।
বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক বলেন, '২০০১ খ্রিষ্টাব্দে নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের যাত্রাকালে নারী সাংবাদিক ছিলেন ২০০ জন। বর্তমানে সারা দেশে সংখ্যাটি এক হাজার ছাড়িয়েছে।
দেশি গণমাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে নিবন্ধনের বাইরে বেশ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী কাজ করছেন মিডিয়াতে। পত্রিকার পাশাপাশি টেলিভিশন সাংবাদিকতায় নারীর উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। তবে এখনো আমাদের নারীরা ঘরে- বাইরে কাজের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। সাংবাদিকতায় নারীর উপস্থিতি বাড়লেও নীতিনির্ধারক পর্যায়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন হাতেগোনা কয়েকজন। তবে আমরা আশাবাদী। মেয়েদের সব জায়গায় লড়াই করেই টিকে থাকতে হয়। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও সেটিই করতে হবে। পরিস্থিতি যা-ই আসুক, হার মানা যাবে না। সাহস, শক্তি আর মনোবল নিয়ে লড়াই করতে হবে।' প্রথম সারির বেশ কিছু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ তৈরি হয়েছে। বর্তমানে দেশের প্রায় ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে (সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে) সাংবাদিকতা বিভাগে বছরে গড়ে ৪০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছেন। এর মধ্যে ছাত্রীসংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ বা তারও কম। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে সাংবাদিকতা বিভাগ চালু হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে এবং ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিভাগের যাত্রা শুরু হয়। পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ প্রভৃতিতে সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন বলেন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে আগের তুলনায় নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও সেটা এখনো এক-তৃতীয়াংশেরও কম। এ ছাড়া যেসব নারী সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হচ্ছেন, এদের প্রায় শতভাগ সফলতার সঙ্গে পড়াশোনা শেষ করলেও শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন অল্প কয়েকজন। গবেষণায় দেখা গেছে, ২১ থেকে ৩৫ বছর বয়সী পর্যন্ত নারীদের দৃশ্যমান পাওয়া যায় ইলেকট্রনিক দৃশ্যমাধ্যম বা টেলিভিশনে। এই সংখ্যা মুদ্রণ মাধ্যমে আরও অনেক কম। এর বেশ কিছু কারণ রয়েছে। বেশির ভাগই ওই বয়সের পর ঝরে পড়েন। কারণ দেশে এখনো নারী সাংবাদিকদের কাজের উপযুক্ত মূল্যায়ন করা হয় না। কর্মক্ষেত্রে এন্ট্রি লেভেলে নারীর সংখ্যা বাড়লেও শুধু নারী বলেই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা নীতিনির্ধারক পর্যায়ে যেতে পারেন না। অথচ আমাদের দেশে সরকার আইন করে দিয়েছে যে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কাবেরী গায়েন আরও বলেন, অন্যান্য পেশায় উচ্চপদে নারীরা বেশ এগালেও গণমাধ্যমে সেটি একেবারেই অনুপস্থিত। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, হাতে গোনা যে কজন নারী মিডিয়াতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যেতে পেরেছেন, তারাও তাদের কর্মক্ষেত্রে নারীবান্ধব কাজের পরিবেশ বা নারী নেতৃত্ব তৈরির 'পথ সুগম করতে পারেননি। সফল সাংবাদিক হিসেবে নারীর সংখ্যা বাড়াতে হলে সবার আগে নিয়োগকর্তাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। নারীদের পুরুষের সম-সুযোগ দিতে হবে, যেমনটা এ বছরের নারী দিবসের প্রতিপাদ্যে বলা হয়েছে।'