ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়কে বলা হয় ভারতের নবজাগরণের পথিকৃৎ। তিনি জন্মেছিলেন এক সম্ভ্রান্ত রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারে। কিন্তু পরে হিন্দু ধর্মীয় প্রথা এবং সামাজিক ব্যবস্থায় সংস্কার সাধনই হয়ে ওঠে তার জীবনের মূল লক্ষ্য। আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী।
কলকাতা থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে হুগলির রাধানগর গ্রামে ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২২ মে জন্মগ্রহণ করেন রামমোহন রায়। বাবা রামকান্ত রায় এবং মা তারিণী দেবী। গ্রামের পাঠশালাতেই তার বাল্যশিক্ষার শুরু।
তিনি আঠারো শতকের ভারতের গতানুগতিক সনাতনী শিক্ষা লাভ করেন। তার বাল্যাকালে ও প্রথম যৌবনে তিনি হিন্দি ও তার মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও বেশ কয়েকটি প্রাচ্যভাষা, যেমন সংস্কৃত, আরবি ও ফারসিতে উল্লেখযোগ্য ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। তিনি হিন্দু ধর্মগ্রন্থসমূহ ভালভাবে আয়ত্ত করেন এবং মুসলমান পন্ডিত ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকারের রাজস্ব ও বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে তিনি ইসলামি ধর্মতত্ত্ব ও আইনশাস্ত্রে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেন।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকারের রাজস্ব আদায় ও বিচারকার্য পরিচালনায় সরকারি কার্যনির্বাহের ভাষা হিসেবে ফারসি প্রচলিত ছিলো। আরবি ভাষার মাধ্যমে প্রাচীন গ্রিক দর্শনশাস্ত্র ও বিজ্ঞান যেমন অ্যারিস্টোটলের যুক্তিবিদ্যা ও ইউক্লিডের মূলনীতিসমূহের প্রাথমিক পর্যায়ের সঙ্গে রামমোহনের পরিচয় ঘটে। ফলে তিনি কিছুটা সমালোচনামূলক ও যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি আত্মস্থ করেন। ইসলাম ও হিন্দুধর্মের শাস্ত্রসম্মত বিধানসমূহের তুলনামূলক অধ্যয়ন এবং পারস্যের সুফি মরমিয়াবাদী কবিদের কাব্যসমূহের সঙ্গে তার পরিচিতি ও সেই সঙ্গে অ্যারিস্টোটলীয় যুক্তিবিদ্যা অল্প বয়সে তাকে সনাতন ধর্মসমূহের ব্যাপারে কিছুটা বিপ্লবী মনোভাবাপন্ন করে তোলে।
রামমোহনের প্রথম দিকের রচনাসমূহ ছিলো আরবি ও ফারসি ভাষায়। মনযারাতুল্ আদিয়ান শীর্ষক তার প্রথম গবেষণামূলক গ্রন্থটি বিভিন্ন ধর্মের আলোচনায় নিবেদিত। এটি কখনও ছাপা হয়নি ও পরে হারিয়ে যায়। আরবি ভাষায় শিরোনাম ও মুখবন্ধ সম্বলিত ফারসি ভাষায় লিখিত তার গবেষণামূলক পুস্তিকা তুহফাত-উল-মুওয়াহিদ্দীন-এ রামমোহন শুধু এ গ্রন্থটির কথা উল্লেখ করেছেন। গ্রন্থটি ১৮০৩-০৪ খ্রিষ্টাব্দে মুর্শিদাবাদে প্রকাশিত হয়, তখন তিনি মুর্শিদাবাদে বাস করতেন। এ উল্লেখযোগ্য পুস্তিকায় রামমোহন ঘোষণা করেন যে, ‘কোনো রকম পার্থক্য ব্যতিরেকে সকল ধর্মেই সচরাচর ভ্রান্ত মত পরিদৃষ্ট হয়,’ এবং মত পোষণ করেন যে, কোনো নবী, ধর্মীয় কর্তৃত্ব ও প্রত্যাদেশের সাহায্য ছাড়াই নিজস্ব কর্মক্ষমতার মাধ্যমে সর্বজনীন সর্বোৎকৃষ্ট সত্তাকে অনুধাবন করা সম্ভব। বস্ত্তত, তুহফাত প্রকাশিত হওয়ার কয়েক বছর পূর্বে রামমোহন হিন্দুদের সনাতন প্রতিমা পূজা মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং প্রায়শ যুগ যুগ ধরে চলে আসা হিন্দু প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি সমালোচনামুখর ছিলেন।
অল্প বয়সে রামমোহন তার নিজস্ব স্বাধীন সম্পত্তির মালিক হন এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জড়িয়ে পড়েন। তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বুদ্ধিগত বন্ধন-মুক্ত অর্জনের সহায়ক হয়। রামমোহন ঐ সময়কার কলকাতা ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ ও সদর দীউয়ানি আদালতের সঙ্গে যুক্ত নেতৃস্থানীয় ভারতীয় পন্ডিতদের সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি ইউরোপীয় কর্মকর্তা ও বণিকদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসেন, যাদের অনেকেই উদারবাদী চিন্তা ও ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। রামমোহন ইতোপূর্বেই ইংরেজি শিখেছিলেন এবং তার ইংরেজ বন্ধুদের সান্নিধ্যে এসে সমকালীন ইউরোপীয় চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হন।
১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে তিনি কলকাতায় বসতি স্থাপন করেন এবং তার জীবনের নতুন এক পর্ব শুরু হয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি তার জীবনকে সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের উদ্দেশে উৎসর্গ করবেন। তার কলকাতা পৌঁছার এক বছরের মধ্যেই সমমনা ব্যক্তিদের নিয়ে তিনি আত্মীয় সভা (বন্ধুদের সমিতি) নামে একটি একান্ত সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এর সদস্যবৃন্দ ওই সময়কার ধর্মীয় ও সামাজিক সমস্যাবলি নিয়ে আলোচনার জন্য তার বাসায় নিয়মিত মিলিত হতেন। শীঘ্রই রামমোহন তার চারপাশে ছোট কিন্তু প্রভাবশালী একটি বন্ধু-মহল গড়ে তুলতে সমর্থ হন, যাদের মধ্যে ছিলেন ভারতীয় ও ইউরোপীয় উভয়ই। তার ঘনিষ্ঠ ভারতীয় বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর ও প্রসন্নকুমার ঠাকুর। তারা দুজন ছিলেন নেতৃস্থানীয় ও সম্পদশালী জমিদার, যাদের ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্বন্ধ ছিলো। যদিও তারা ধর্মবিষয়ে রামমোহনের আমূল সংস্কারের ধারণাসমূহের সঙ্গে পুরোপুরি একমত হননি, তবুও তারা সামাজিক সংস্কার সাধন ও পাশ্চত্য শিক্ষা বিস্তারের জন্য তার সকল প্রচেষ্টাকে মনেপ্রাণে সমর্থন করেন।
রামমোহন হিন্দু সংস্কারের এক মহান যুগের সূত্রপাত করেন। তিনি সতীদাহের মতো কুপ্রথার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে সক্ষম হন, যা ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে বিশেষ আইনের মাধ্যমে এ প্রথা বন্ধ করতে সরকারকে প্রভাবিত করে। রামমোহন প্রতিমা পূজাকেও দৃঢ়ভাবে বর্জন করেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে, হিন্দুধর্ম এক সর্বজনীন ঈশ্বরের পূজা করতে নির্দেশ দেয়।
১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে রামমোহন ব্রাহ্মসভা (পরবর্তীসময়ে ব্রাহ্মসমাজ) অর্থাৎ ঈশ্বরের সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা বস্ত্তত হিন্দুধর্মের নতুন একটি শাখা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। রামমোহনের ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা মৌলিক হলেও তা ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম দ্বারা খানিকটা প্রভাবিত হয়েছিলো। তার সংস্কারমূলক ও উদারবাদী ধারণাসমূহের প্রচারের জন্য ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দে রামমোহন সম্বাদ কৌমুদী নামে বাংলা সংবাদপত্র ও ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে মিরাত-উল-আখবার নামে ফারসি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন।
উপমহাদেশে জাতীয় চেতনার উন্মেষেও প্রভূত অবদান ছিলো রামমোহন রায়ের। তার রাজনৈতিক ধারণা গড়ে তুলতে তিনি জেরেমী বেন্থামের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। রামমোহন ও তার অনুসারী বাংলার অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ রাজ-এর অনুগত সমর্থক ছিলেন। তারা বিশ্বাস করতেন যে, কালাক্রমে ব্রিটিশ জনগণ তাদের নিজের দেশে যে রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে তা’ দূর সমুদ্রের পরপারে অবস্থিত ব্রিটিশ ভূখন্ডসমূহের জনগণের জন্যও প্রসারিত হবে। ভারতীয় জনগণের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন বৈষম্যমূলক আচরণে তারা ক্ষুব্ধ ছিলেন। ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে গভর্নর জেনারেল জন অ্যাডাম যখন ভারতীয় প্রেসের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন, তখন রামমোহন ও তার বন্ধুরা প্রিভি কাউন্সিলে স্মারকলিপি পেশ করে বলিষ্ঠভাবে এর প্রতিবাদ জানান। স্মারকলিপিটি এ যুক্তিতে প্রত্যাখ্যান করা হয় যে, যে দেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করে না সেখানে প্রেসের স্বাধীনতা থাকতে পারে না। আবার, রামমোহন ও তার বন্ধু দ্বারকানাথ ঠাকুর উদ্যোগ গ্রহণ করে ১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দের ভারতীয় জুরি আইনের নির্দিষ্ট কিছুসংখ্যক বৈষম্যমূলক ধারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে কলকাতার হিন্দু ও মুসলমান নাগরিকদের পক্ষে একটি স্বাক্ষরিত আবেদন-পত্র ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাঠান। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার জমিদারদের স্বার্থ বিরোধী সরকারের রাজস্ব নীতির বিরুদ্ধে রামমোহন ও তার বন্ধুরা গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্কের কাছে ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে আরেকটি আবেদনপত্র পেশ করেন। প্রধানত রামমোহন রায়ের উদ্যোগে বিদেশি সরকারের নীতির বিরুদ্ধে জনসাধারণের প্রতিবাদসমূহের মধ্যেই জাতীয় চেতনাবোধের প্রাথমিক প্রকাশ পরিদৃষ্ট হয়। তার সময়ে সংঘটিত ইংল্যান্ডের সংস্কার আন্দোলন এবং ইউরোপের উদারবাদী ও জাতীয়তাবাদী বিপ্লবসমূহের অগ্রগতি রামমোহন গভীর আগ্রহের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতেন। তিনি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতেন যে ‘স্বাধীনতার শত্রুরা ও স্বৈরতন্ত্রের বন্ধুরা কখনও সাফল্যমন্ডিত হয়নি এবং কখনও হবেও না’। জেমস সিল্ক বাকিংহামের কাছে লেখা তার ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ আগস্টের চিঠিতে এ বিশ্বাসের প্রকাশ দেখা যায়।
১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে খেতাবসর্বস্ব মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর রামমোহন রায়কে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং তার পক্ষে ব্রিটিশ রাজ ও পার্লামেন্টে ওকালতি করার জন্য ইংল্যান্ডে পাঠান। ইংল্যান্ডে ব্রিটিশ সমাজের নেতৃবৃন্দ কর্তৃক তিনি বিপুলভাবে সংবর্ধিত হন। ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ফ্রান্সও সফর করেন।
মেনিনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে রাজা রামমোহন পরলোকগমন করেন।
উনবিংশ শতাব্দীতে রামমোহন যে মুক্ত চিন্তাচেতনার আলো জ্বেলে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই আলোতেই ভারতে নব-জাগরণের পথটি ত্বরান্বিত হয়েছিলো।