ছেলেমেয়েরা বাসায় বই নিয়ে বসছে না, সারাক্ষণই ইন্টারনেটে মগ্ন থাকছে। স্কুলগুলো পরীক্ষার নামে তামাশা করছে। পরীক্ষার কক্ষে মোবাইল ফোন নিয়ে ঢুকছে এবং গুগল থেকে দেখে দেখে পরীক্ষার উত্তরপত্রে লিখছে। সিলেবাস/কারিকুলাম ত্রুটিপূর্ণ, প্রচলিত কারিকুলাম শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধনে অন্তরায়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রির সনদ নিয়ে বের হয়ে আসছে কিন্তু বাস্তবে কোনো জ্ঞান লাভ করছে না। বাংলা অথবা ইংরেজি কোনোটাই শুদ্ধভাবে লিখতে পারছে না। এই শিক্ষাব্যবস্থা কর্মক্ষেত্রের প্রয়োজনীয় দক্ষতা প্রদানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ, বিসিএসসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। চাকরিক্ষেত্রে কোনো যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। দক্ষ শিক্ষকের অভাব, শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, মেধাবীরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন বিভিন্ন উন্নত দেশে। দক্ষ জনশক্তি তৈরি হচ্ছে না। দেশে–অভিভাবক এবং বুদ্ধিজীবী মহলে এমন হাজারও গুঞ্জন, লাখো প্রশ্ন কিন্তু জবাব দেবে কে? শিক্ষা নিয়ে কতো গবেষণা, কতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা, কতো গিনিপিগ-টেস্ট, কতো কমিশন গঠন ও সুপারিশমালা প্রদান সবই যেনো বৃথা আস্ফালন মাত্র।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুলাই গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের উদ্দেশ্যই ছিলো মান্ধাতা আমলের শিক্ষাব্যবস্থার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমাজ গঠনমূলক একটি সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা প্রণয়ন। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে গঠিত এ কমিশনের রিপোর্টে ৩৬টি অধ্যায় ছিলো-(১) শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যাবলি (২) চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব গঠন (৩) কর্ম অভিজ্ঞতা (৪) শিক্ষার মাধ্যম (৫) শিক্ষায় বিদেশি ভাষার স্থান (৬) শিক্ষক-শিক্ষার্থীর হার (৭) প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা (৮) প্রাথমিক শিক্ষা (৯) মাধ্যমিক শিক্ষা (১০) বৃত্তিমূলক শিক্ষা (১১) ডিপ্লোমা স্তরে প্রকৌশল শিক্ষা ও প্রযুক্তি বিদ্যা (১২) মাদরাসা শিক্ষা ও টোল শিক্ষা (১৩) শিক্ষক প্রশিক্ষণ (১৪) উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা (১৫) ডিগ্রি স্তরে প্রকৌশল শিক্ষা ও প্রযুক্তিবিদ্যা।(১৬) বিজ্ঞান শিক্ষা (১৭) কৃষি শিক্ষা (১৮) বাণিজ্য শিক্ষা (১৯) আইন শিক্ষা (২০) ললিত কলা (২১) পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি (২২) শিক্ষকের দায়িত্ব ও মর্যাদা (২৩) নিরক্ষরতা দূরীকরণ (২৪) বয়স্ক শিক্ষা ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা (২৫) নারী শিক্ষা (২৬) বিশেষ শিক্ষা (২৭) শারীরিক ও মানসিক বাধাগ্রস্তদের এবং বিশেষ মেধাবিদের জন্য শিক্ষা (২৮) স্বাস্থ্য শিক্ষা (২৯) শরীর চর্চা ও সামরিক শিক্ষা (৩০) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি (৩১) শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক (৩২) শিক্ষাগৃহ ও শিক্ষার উপকরণ (৩৩) গ্রন্থাগার (৩৪) শিক্ষাক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা (৩৫) শিক্ষার্খী নির্দেশনা ও পরামর্শ দান (৩৬) ছাত্রকল্যাণ ও জাতীয় সেবা, শিক্ষার জন্য অর্থসংস্থান ও পরিশেষ।
সময়ের স্রোতে অনেক কিছুই ভেসে যায়, তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে কুদরাত-এ-খুদা কমিশন প্রদত্ত সুপারিশের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হবার আগেই দেশের সরকার পরিবর্তন হয়েছে এবং সময়ের দাবিতে একের পর এক শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। তবে কুদরাত-এ-খুদা কমিশন প্রদত্ত রিপোর্টকেই ভিত্তি হিসেবে ধরে নিয়ে বিভিন্ন অধ্যয়ের পরিবর্তন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন, সংযোজন অথবা বিয়োজন করা হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বর্তমানে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাক্রমে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে সেটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠেছে। একজন সচেতন অভিভাবক এই কারিকুলাম নিয়ে তার গভীর পর্যবেক্ষণের পর ক্ষোভ প্রকাশসহ বেশ কিছু প্রশ্ন করলেন। তার ভাষায়, ‘কারিকুলামের পক্ষের কয়েকজন বিশেষজ্ঞের বক্তব্য থেকে বুঝলাম কারিকুলামটি যুগোপযোগী, আর এটাও বুঝতে দেরি হলো না যে, এ কারিকুলাম শহরভিত্তিক শিক্ষার্থিদের জন্য প্রণীত। আমাদের জনসংখ্যার শতকরা ৯০ জনই গ্রামে বাস করে। তাদের বিষয়টি চিন্তা করেই কতোগুলো প্রশ্ন আসে।
১. গ্রামের স্কুলগুলোতে এ কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার/ভৌত অবকাঠামো আছে কি?
২. শ্রেণিকক্ষে পাঠদানকালে প্রতিনিয়ত যেসব শিক্ষা-উপকরণ প্রয়োজন হবে গ্রাম এলাকায় তার সহজলভ্যতা আছে কি? পোস্টার পেপার, আর্টশিট, কর্কশিট, কালার পেন্সিল, মোমবাতি এসব আমাদের গ্রামসমূহের স্থানীয় বাজারে পাওয়া যায় না। এমতাবস্থায় প্রায়ই শহরে গিয়ে একজন ছাত্রের কৃষক পিতার পক্ষে ওই উপকরণ সংগ্রহ করা কি সম্ভব? এরপর ধরা যাক, বাংলার একজন শিক্ষক সুকুমার রায়ের একটি কবিতা পড়ানোর পর ছাত্রকে অনুরূপ ৪ লাইন কবিতা লিখতে বললেন, তারপর বাসায় গিয়ে সুকুমার রায়ের একটি কবিতার বই সংগ্রহ করে পরের ক্লাসে আনতে বললেন এবং সেখান থেকে পছন্দের একটি কবিতা নিয়ে ছাত্রকে আলোচনা করতে বললেন। এটি কি প্রত্যন্ত একটি গ্রামের স্কুলে সম্ভব?
৩. গ্রামের একটি স্কুলের লাইব্রেরিতে কয়টি বই থাকে? সব স্কুলে আদৌ কোনো লাইব্রেরি আছে কি না-এ বিষয়টিও কি ভেবে দেখা উচিত ছিলো না? কম্পিউটর ল্যাব তারা কোথায় পাবে? ওই লেভেলের সব ছাত্রের পক্ষে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন কেনা কি সম্ভব? দ্রুত গতির ইন্টারনেট তারা কোথায় পাবে? সন্তানের জন্য মাসে মাসে ইন্টারনেট প্যাকেজের বিল একজন অসচ্ছল কৃষকপিতা কীভাবে দেবেন?
৪. গ্রামের স্কুলে যে পদ্ধতিতে, যে মানের শিক্ষক নিয়োগ করা হয়, তাদের দ্বারা এ কারিকুলাম বাস্তবায়ন সম্ভব কি? রাতারাতি দক্ষ শিক্ষক কোথায় পাওয়া যাবে?
৫, শহরে বসবাসরত একজন পয়সাওয়ালা অভিভাবকের জন্য এই কারিকুলাম উপযোগী হতে পারে কিন্তু যাদের কথা উল্লিখিত হলো তাদের ব্যাপারে সরকারের কী পরিকল্পনা আছে?
এ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমার জানার অধিকার আছে। কেউ একজন জানাবেন কি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের হতদরিদ্র কৃষক-মজদুরের সন্তানরা কীভাবে এই কারিকুলামে শিক্ষা লাভ করবে?’
বছরের শেষে লিখিত পরীক্ষা, মেধা মূল্যায়ন পদ্ধতি ইত্যাদি নিয়েও তিনি অনেক প্রশ্ন করেছিলেন যার সন্তোষজনক উত্তর তিনি পাননি। এনসিটিবি’র বিশেষজ্ঞরা তাদের প্রণীত কারিকুলামকে কেন্দ্র করে যেসব প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে সেসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর নিজেরাও জানেন কি না সেটি নিয়েও অনেকে সন্দিহান। কারণ, আমরা অনেকেই এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর খুঁজে না পেয়ে এখনও অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছি।
সর্বশেষ শিক্ষাকমিশন গঠিত হয়েছিল ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে যা কবির চৌধুরী শিক্ষা কমিশন নামে পরিচিত। মাধ্যমিক স্তর সম্পর্কে এ কমিশনের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিলো- ‘মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা হবে ৪ শিক্ষাবর্ষ অর্থাৎ নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রসারিত হবে এবং দশম শ্রেণির শেষে সরকারি পাবলিক পরীক্ষা নেয়া হবে। চূড়ান্ত মাধ্যমিক পরীক্ষা দ্বাদশ শ্রেণির শেষে অনুষ্ঠিত হবে। মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যক্রমের বিভিন্ন ধারায় বাংলা, নৈতিক শিক্ষা, বাংলাদেশের অধ্যয়ন, গণিত, প্রকৃতি ও পরিবেশ, সামাজিক গবেষণা, তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞানসহ কয়েকটি মৌলিক বিষয় বাধ্যতামূলক করা হবে। নীতিমালাটিতে সকল মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিছু প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রবর্তন করারও আহ্বান জানানো হয়েছিলো। বর্তমান কারিকুলাম কোন শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের আলোকে তৈরি তা বোধগম্য নয়। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন বর্তমানে প্রচলিত কারিকুলাম ফিনল্যান্ডের কারিকুলামকে অনুসরণ করে প্রণীত হয়েছে। যদি তাই হয়ে থাকে তবে প্রথমেই প্রশ্ন উঠে আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভৌত অবকাঠামো কি ফিনল্যান্ডের মতো? ফিনল্যান্ড সে দেশের নাগরিকদেরকে যে ধরনের প্রযুক্তিগত সুবিধা দিতে পারে আমাদের সরকার কি সে সমস্ত সুবিধা প্রদানে সক্ষম? আমাদের শিক্ষকদের আমরা কি যথেষ্ট বেতন দিতে পারি যা ফিনল্যান্ড পারে? আমাদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি আছে, দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য আছে, সবকিছুকে বিবেচনায় না নিয়ে অন্যদেশ থেকে আমদানিকৃত একটি কারিকুলামের বিষয়ে শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট নাগরিক এবং অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা না করে হুট করে চালু করে দেবার চেষ্টা হঠকারিতার মধ্যেই পড়ে যা কারিকুলাম-প্রণেতারা বুঝতে অক্ষম। তা ছাড়া মুদ্রিত বইয়েও রয়েছে অসংখ্য ছাপার ভুলসহ নানান রকম অসংগতি। শিক্ষাব্যবস্থার এই বেহাল দশায় জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে প্রতিনিয়তই। যাদের সামর্থ্য আছে তারা সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন উন্নততর শিক্ষা এবং পরবর্তীতে উন্নত জীবন লাভের আশায়। মেধাবিরা বৃত্তি নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। দেশ ক্রমেই তার মেধাবি সন্তানদের হারাচ্ছে।
আসল সমস্যা কোথায়? অল্প কথায় এর জবাব আশা করা যায় না। শিক্ষা খাতকে চরম অবজ্ঞা প্রদর্শনই এর মূল কারণ। সব সরকারই উন্নয়ন দেখাতে চান ইট-পাথরে নির্মিত প্রাণহীন কিছু সৌধ অথবা সাঁকোর মধ্যে অথচ প্রাণের জাগরণে, উন্নত জীবন যাপনে এবং মানবতার বিকাশ সাধনে শিক্ষা নামের যে জিনিসটি অতি আবশ্যক তা চির অবহেলিতই রয়ে গেলো। প্রতিবছরই সংসদে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার পর সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় বিশেষ করে শিক্ষা খাতে অপ্রতুল বরাদ্দ নিয়ে। বরাদ্দ যতোটুকু দেয়া হয় সেখানেও প্রয়োজনীয় ব্যয়ের চেয়ে দুর্নীতি হয় অনেক বেশি। অতীব পরিতাপের বিষয় শিক্ষা নিয়ে গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার চেয়ে বরং নোংরা রাজনীতির চর্চা হয় অনেক বেশি, শিক্ষকেরা ব্যস্ত সময় কাটান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। শিক্ষা দানের চেয়ে বরং বড় একটি পদ বাগানোই যেনো তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। যোগ্য অধ্যাপকদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ না দিয়ে হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থে নিয়োগ দেয়া হয় সরকারের তল্পীবাহক হয়ে, আজ্ঞাবহ দাস হয়ে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে দ্বিধাবোধ করবে না-এমন মেরুদণ্ডহীন শিক্ষকদের যারা দায়িত্ব গ্রহণ করেই শুরু করেন নিয়োগ বাণিজ্য। প্রথমে নিজেদের অযোগ্য সন্তানদের চাকরি পাইয়ে দেন, পরে সরকার দলের হোমরাচোমরাদের সুপারিশকৃত প্রার্থিদের অথবা বিপুল অঙ্কের অর্থ আদান-প্রদানের মাধ্যমে নিয়োগ দেন। এরপর শুরু হয় রাজনীতির নামে আরো নোংরা খেলা। শিক্ষার্থীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে, হেলমেট ও মোটরসাইকেল তুলে দিয়ে তাদেরকে বানানো হয় হেলমেটবাহিনী যারা প্রতিপক্ষকে খুন করতে এতোটুকু দ্বিধা বোধ করে না। শিক্ষার্থীদেরকে জ্ঞানাহরণে ব্যস্ত রাখার কৌশল এবং ইচ্ছে, এ দুটোই শিক্ষকদের মধ্যে অনুপস্থিত। এই জ্ঞানপাপীদের কাজই হলো সরকারের স্তুতি গাওয়া, আর সুযোগমত দুর্নীতি করা। এই স্তাবকগোষ্ঠীর অনেককেই দেখেছি তাদের ১৫ মিনিটের একটি বক্তৃতায় প্রথম ৫ মিনিট অত্যন্ত নির্লজ্জ, বেহায়ার মত শুধু প্রধানমন্ত্রীর গুণকীর্তন করে চলেছেন। তারা বেমালুম ভুলে যান তাদের অবস্থানের কথা, আত্মসম্মান এবং আত্মমর্যাদার কথা।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো, তাই এই খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। কিন্তু এই লাভজনক খাতে বিনিয়োগে কেনো এতো কার্পণ্য, কেনো এতো অনীহা, জবাবহীন সে প্রশ্ন রয়েই যায় প্রতিবছর। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমন হওয়া প্রয়োজন যেখানে প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্মীয়/নৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত থাকবে যাতে শিশুরা গোড়া থেকেই চরিত্রবান হয়ে উঠার প্রেরণা পায়। মাতৃভাষা বাংলাকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে একুশের ভাষা-শহীদদের আত্মদানের বিষয়টি স্মরণ রেখে। বর্তমান বিশ্বে ইংরেজি ভাষার ওপর দখল না থাকলে চলা মুশকিল। কাজেই ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্বকে অবহেলা করবার কোনো সুযোগ নেই। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর। সাংস্কৃতিক চর্চা ছাত্রজীবনের একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবেই রাখতে হবে যাতে শিক্ষার্থিদের মানসিক বিকাশ ঘটে। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাটাই যেনো একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে গেছে।
অতি সম্প্রতি দেশে একটা পট পরিবর্তন হয়েছে, ছাত্র-জনতার ব্যাপক রোষের মুখে সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়েছে। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালিন সরকার যার মূখ্য উদ্দেশ্য দেশে হারানো গণতন্ত্র উদ্ধার করে, দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করে সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু একটি নির্বাচনের আয়োজন করে একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করা। শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের কাজ নয়। কিন্তু অসহায় জনগণের প্রাণের দাবি- এই সরকারই যেনো জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারে উদ্যোগী হন এবং উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করে আনেন। আশার কথা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইতোমধ্যেই আশার বাণী শুনিয়ে বলেছেন, ‘অভিভাবকরা যদি চান তবে বর্তমান কারিকুলাম অবশ্যই পরিবর্তন করা হবে।‘ হিমালয়সম বিশাল সমস্যা কাঁধে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যাত্রা করেছেন, সময়ই বলে দেবে তারা শিক্ষার জন্য আসলেই কতোটুকু কী করতে পারবেন। তবে সরকার-প্রধানের আশার বাণীতেই জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা-কবে অসহায় জাতি একটি যুগোপযোগী কারিকুলাম হাতে পাবে। সুশিক্ষা অর্জন করে আজকের প্রজন্ম ভবিষ্যৎ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারবে। বাঙালি সাহসী জাতি, বীরের জাতি, এ কথা বারবারই প্রমাণিত হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেসব মহৎ কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন সেটির একটি আশাব্যঞ্জক সফল সমাপ্তি ঘটবে বলে জাতি আশায় মুখিয়ে আছে।
লেখক: যুগ্মপরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়