চাকরিতে গ্রেড পরিবর্তন নিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, অডিটরসহ কয়েক শ্রেণির সরকারি চাকরিজীবীদের আন্দোলন চলছে। কেউ সরকারের উচ্চপর্যায়ে প্রস্তাব জানাচ্ছেন, কেউ দাবি আদায়ে মামলা করছেন। ওপর মহল থেকে কেউ আশ্বাস পাচ্ছে আবার কারো দাবি পূরণ হচ্ছে। রাষ্ট্র যেটা যৌক্তিক মনে করছে না, সেটাকে কৌশলে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। কোনো কোনো আন্দোলন নিয়ে বা দাবি শুনে খোদ সরকার অস্বস্তি অনুভব করছে। প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে বেতন স্কেল উন্নীত করার যে দাবি তা প্রাথমিকে কর্মরতদের কাছে সর্বোচ্চ যৌক্তিক চাওয়া। অডিটরদের মধ্যে যারা ১১তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেড চান তাদের যুক্তি হচ্ছে ১০ম গ্রেডে কর্মরত এবং ১১তম গ্রেডে কর্মরতরা একই কাজ করেন। কাজেই সম্মান ও বেতনের তফাৎ হবে কেনো? বর্তমানে যারা যে দাবি তুলছে তাদের পক্ষ থেকে যে ভাবনা ও যুক্তি তাতে তাদের প্রত্যেকের দাবি পৃথিবীর সবচেয়ে যৌক্তিক চাওয়া-অন্তত তারা মনে করে। বরং তাদেরকে দীর্ঘদিন বঞ্চিত করা হয়েছে-এই ক্ষোভে তারা অনেক কিছু বলতেও চায়। আমরা জাতি হিসেবে যতো সহজের পরের বিচার করতে পারি ততো সহজে নিজেদের ভুল দেখি না।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরতদের ১৩তম গ্রেড থেকে দাবি মেনে ১০ম গ্রেডে আনলে গোটা গ্রেড চেইন যে ভেঙে পড়বে, শিক্ষকদের মধ্যে বিরাজমান বিভিন্ন স্তর, অন্যান্য চাকরিজীবীদের সঙ্গে নতুন ঝামেলার সৃষ্টি-এসব দাবি আদায়ের জন্য দপ্তরে দপ্তরে ঘোরা, মাঠে শ্লোগান তোলা-তাদের কেউ ভাবছে না। ভাববেও না, সেটাই স্বাভাবিক। অন্তত আমাদের জাতীয় চরিত্র এটাই নির্দেশ করে। তবে যারা নীতি নির্ধারক তাদেরকে চিন্তা করতে হবে এবং সুচিন্তিত পরিকল্পনায় পদক্ষেপ নিতে হবে। কেউ কারো বিরোধিতার জন্য নয় বরং অন্যান্য যে সমস্যা সৃষ্টি হবে সেসবের সমাধান কী হবে সেটাও নিশ্চয়ই রাষ্ট্র বিবেচনায় রাখবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় ১ম থেকে ২০তম গ্রেড চালু আছে। সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন গ্রেডের বেতনের পার্থক্য বিশাল। যোগ্যতা ও দায়িত্বের পার্থক্য ও পরিধিও নিঃসন্দেহে বিস্তৃত। উপজেলা পর্যায়ে এন্ট্রি লেভেলের একজন অফিস সহায়ক সর্ব সাকুল্যে ১৬ হাজার টাকার মতো বেতন পান। এই বেতন দিয়ে নিজ ও সংসারের ব্যয় নির্বাহ করা শুধু কঠিন নয় বরং প্রায় অসম্ভব। চড়া মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, চিকিৎসা ব্যয় কিংবা শিক্ষা খরচ নির্বাহ করে মাস শেষে হিমশিম খান না-এমন চাকরিজীবীর সংখ্যা কম। ধার-দেনা, ঋণ লেগেই থাকে।
যারা উচ্চ গ্রেডের বেতনভুক্ত তাদের বৈধ আয়েও সম্মান নিয়ে সমাজে বেঁচে থাকা মুশকিল। সামাজিকতা টিকিয়ে রেখে, আত্মীয় স্বজনের দাবি মিটিয়ে বর্তমান বেতনে টিকে থাকা ভয়ানকভাবে চ্যালেঞ্জের। বাজারমূল্যের সঙ্গে বেতন যখন অসামঞ্জস্য হয় তখন ঘুষ নৈতিকার বাধা ভেঙে প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং সার্বিক বিষয়ে পর্যালোচনা করে নবম পে-স্কেল ঘোষণা সরকারের অগ্রাধিকারমূলক সংস্কারের পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যে অস্থিরতা-অসন্তোষ বিরাজিত, যে সংকট উদ্ভূত তা দূরীকরণের সবচেয়ে সহজ তরিকা হতে পারে নতুন বেতন কাঠামো নির্ধারণের সিদ্ধান্ত। বিদ্যামান বেতনে গ্রেডের সংখ্যা ২০টি। এর কোনো কোনোটির সঙ্গে ওপর-নিচের ব্যবধান অনেক বেশি। যা বৈষম্যকে প্রকট আকারে নিয়েছে। ক্ষোভে ফুয়েল দিয়েছে। বেতন গ্রেডের সংখ্যারও সংস্কার করা জরুরি। বড়জোর ১০টি টায়ারে কিংবা আরো কমিয়ে সমন্বয় করলে বিদ্যমান বৈষম্য অনেকটা লাঘব হবে। প্রাথমিক-মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো ঘোষণা করা যায় কি না-সেটা নিয়েও ভাবা যেতে পারে। সমাজে শিক্ষকের মূল্যায়ন কেবল বেতন দিয়ে নয় বরং সম্মান দিয়েও হয়। সেখানে শিক্ষককে যদি মাসের শেষে হাত পাততে হয়, ঋণের সুদের ফাঁদে পড়তে হয় তবে সে শিক্ষকের নৈতিক মনোবল ভেঙে যায়। শিক্ষকদের বেতনের চেয়ে সম্মানের প্রশ্নটি বেশি প্রাসঙ্গিক। শিক্ষকদের মধ্যে তৃতীয়-দ্বিতীয় ও প্রথম শ্রেণির বিভাজন করলে এটাও আত্মসম্মানের বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে। বেতন যাই হোক, শিক্ষকের মর্যদা প্রথম শ্রেণির হওয়া যৌক্তিক।
বিদ্যমান ৮ম পে=স্কেল ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত হয়েছিলো। তৎকালীন বাস্তবতায় বেতনের পরিমাণ পর্যাপ্ত ছিলো। জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কিছু কিছু সঞ্চয় করার পরেও স্বাচ্ছন্দ্যে জীবিকা নির্বাহ করা যেতো। সেই বেতন স্কেলের পরে দীর্ঘ ৯ বছর অতিবাহিত হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের দাম তিনগুণ-পাঁচগুণ বেড়েছে। ব্যয়ের খাত বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বেতনের যে একটি মাত্র খাত সেটি ব্যয়ের শাখা-প্রশাখার তুলনায় চারার পর্যায়ে রয়ে গেছে। যাদের সঞ্চয় ছিলো তারা সেটা ভাঙতে বাধ্য হচ্ছে। যাদের ভরসা শুধু বেতনে তার ঋণের জালে বন্দি হতে বাধ্য হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের সরকারের সময়েও বেতন বৃদ্ধি করার দাবিটি গুঞ্জনের পর্যায়ে ছিলো। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে, ভয়-দমনীতির প্রয়োগে এই দাবিটি তেমনভাবে প্রকাশ্যে আলোচিত হয়নি। যেহেতু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কারের ইশতেহারে রাষ্ট্রের নানাবিধ সমস্যায় দৃষ্টি দিয়েছে, সুতরাং বিশেষ কোনো শ্রেণিকে বাড়তি সুবিধা না দিয়ে বরং সার্বিক সংস্কারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয়তার সাপেক্ষে নবম পে-স্কেল ঘোষণা করতে পারে। এতে বহুবিধ সমস্যা ও সংকটের সমাধান হবে। সে উদ্যোগটি নেয়ার এটাই সর্বোত্তম সময়। কোনো বিশেষ গ্রুপের দাবি কিংবা চাপের প্রেক্ষিতে আলাদা আলাদা করে দাবি পূরণ নয় বরং সার্বিক প্রয়োজনীয়তা ও ন্যায্যতা বিবেচনায় সবার মঙ্গল হয়, সম্মানজনক জীবিকার উৎস পায়-এমন কোনো স্থায়ী সমাধানের পথে হাঁটা দরকার। রাষ্ট্র কোনো অস্থায়ী সমাধান দিয়ে সার্বিক শৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখতে পারে না। বরং অরাজকতা বৃদ্ধির আশঙ্কা জন্মাবে।
যারা যা দাবি তুলছে তা শুনে আংশিক অংশ কিংবা সম্পূর্ণও যদি মেনে নেয়া হয় তবে ওই টায়ারের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট অংশীজন তাদের নতুন দাবি, উন্নতির দাবি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হবে। কোনো একটি গ্রেডে বিদ্যমনার যদি তার পূর্ববর্তী গ্রেড কিংবা লম্ফ দিয়ে আরো একাধিক পূর্বের গ্রেডে চলে আসে তবে যারা মধ্যখানে থাকে তাদের দাবি-দাওয়া নতুন করে যৌক্তিক হবে। সুতরাং যদি সংস্কারের সম্পূর্ণ ইচ্ছা থাকে এবং বাস্তবতা মেনে সেটা করতে হয় তবে প্রচলিত নিয়ম ভেঙে আবার নতুন করে যুগোপযোগী হিসেবে গোটা সিস্টেমকে গড়ে তুলতে হবে। আংশিকভাবে জোড়াতালি দিয়ে কোনো সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। বৃহত্তর স্টেকহোল্ডারের কোনো দাবি চাপে কিংবা যৌক্তিক কারণে মেনে যাওয়া হলে যারা সংখ্যায় অল্প, দাবির স্বর নিম্ন তাদেরকে বঞ্চিত করে, বৈষম্যে ফেলে সিদ্ধান্ত নেয়া নৈতিকভাবে ঠিক নয়। নতুন নতুন দাবি উঠবে, যার যা ন্যায্যতা, যার যা যোগ্যতা তাকে সেটুকু দিতে হবে। সবকিছুর পরেও মাথায় রাখতে হবে একজন চাকরিজীবী মানেই একটি সংসার আর অনেকগুলো স্বপ্ন। রাষ্ট্র যাতে তার অংশীজনকে স্বাচ্ছন্দ্য উপহার দিতে এবং মানসিক ও আর্থিক শান্তি প্রতিষ্ঠার সামর্থ্য রাখার পরেও দাবি পূরণে কার্পণ্য না করে।
চাকরিজীবীরা ঘুষ খায়, দুর্নীতি করে-প্রচলিত সত্য অভিযোগ। যাদেরকে ঘুষের নেশায় ধরেছে শাস্তি দেয়া ছাড়া, কর্ম থেকে মুক্তি দেয়া ছাড়া তাদেরকে এই পাপ থেকে ফেরানো যাবে? তবে বেতনে কুলাচ্ছে না বলে যারা দুপয়সা এদিক-সেদিক করে তাদেরকে এই গুরুপাপের দণ্ড দেয়ার আগে যুগের সঙ্গে যুতসই বেতনাঙ্ক নিশ্চিত করা জরুরি। শুধু সরকারি চাকরিজীবীদেরকে নতুন পেস্কেলের আওতায় আনলে বেসরকারি খাতের আয় ও শ্রমিকের বেতন অটোমেটিক বদলে যেতে বাধ্য হবে। রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক সক্ষমতার ক্রাইসিস চলছে। তবে সে ক্রাইসিস মূলত ডলার কেন্দ্রিক। চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি করলে সেই টাকা দেশের বাজারে নতুন অর্থের সৃষ্টি করবে। মানুষ আসলে শান্তিতে থাকার আশায় চাকরি করতে বাধ্য হয়। শখের বসে চাকরি করে এমন সংখ্যা সামান্য। কিন্তু বেতন এবং পণ্যের দাম তুলনা করে নির্ধারণ করে দিলে ভালো হতো। মোটকথা আয়ে কুলাচ্ছে না। রাষ্ট্রের নজর ও সহানুভূতি প্রয়োজন।
নয়া সরকারের কাছে জোর দাবি থাকবে নতুন পে-স্কেল ঘোষণার। আমি ব্যক্তিগতভাবে আশাবাদী, তারা এটা করবে। যারা গ্রেড ও বেতন বৃদ্ধির আন্দোলন করছে-মূলকথা আন্দোলনের ফ্লোর পাচ্ছে তাদের কাছে পে-স্কেল ঘোষণার সংবাদ পৌঁছালে যাপিত জীবনে স্বস্তি নেমে আসবে। চলমান বেতন কাঠামোতে কোথাও অসমতা থাকলেও তা নতুন পে-স্কেলে সমন্বয় করে নেয়া সম্ভব। কিন্তু চলমান পরিস্থিতে কাউকে আলাদা আলাদা কিছু দিলে অন্যরাও লাইন ধরবে। কারণ, সবাই সবার অংশীজন। প্রচলিত শৃঙ্খলা ভাঙলে পরিস্থিতি বিশৃঙ্খল হতে পারে। কাজেই গ্রেডসমূহের মধ্যে বেতনের বৈষম্য যৌক্তিক করে, যোগ্যতা ও গুরুত্ব অনুযায়ী বেতন নির্ধারণ করে তবেই সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান করা হোক। চাকরির সার্কুলারে যে পদের জন্য যা বেতন তা দেখেই প্রার্থী আবেদন করে। কাজেই চাকরিতে প্রবেশ করেই বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন, অফিস অচল করে দেয়া- এই ব্যাপারেও নীতিমালা থাকা উচিত। অনেকের চাহিদাই নিজের যোগ্যতা ও রাষ্ট্রের সামর্থ্যের অধিক। এটাকে প্রশ্রয় দিতে থাকলে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলাও ভেঙে পড়বে।
লেখক: কলাম লেখক