নতুন শিক্ষাক্রমে আমাদের শিক্ষার্থীর কী কী শিখছেন এটা নিয়ে আমাদের চিন্তার অন্ত নেই। আমরা বলছি শিক্ষার্থী কিছুই শিখছেন না। আসলে কি শিক্ষার্থী কিছুই শিখছেন না? তাহলে শ্রেণিকক্ষে তিনি কী করছেন? আসুন জেনে নেয়া যাক আমদের শিক্ষার্থীরা ক্লাসে বাংলা বিষয়ে কী কী শিখছেন।
বর্তমানে ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী বাংলা পাঠ্যবই আছে। পাশাপাশি শিক্ষকদের জন্য রয়েছে বাংলা বিষয়ের শিক্ষক সহায়িকা। একজন শিক্ষক তার নির্ধারিত শ্রেণিতে শিক্ষক সহায়িকা অনুসরণ করে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন শিখন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ১০টি যোগ্যতা অর্জন করবেন। বাংলা বিষয়ে ৭টি যোগ্যতা অর্জন করবেন। বাংলা পাঠ্যবইয়ের প্রতিটি শিখন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই একজন শিক্ষার্থী যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হবেন।
কী আছে বাংলা পাঠ্যবইয়ে? প্রমিত ভাষায় শিক্ষার্থী যেনো দক্ষতা অর্জন করতে পারেন সেভাবেই ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে বিষয়বস্তু দেয়া হয়েছে। একটু ব্যাখ্য করে বলি, আমরা প্রায় বেশিরভাগ মানুষ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলি। প্রমিত ভাষায় কথা বলার দক্ষতা আমদের নেই বললেই চলে। আঞ্চলিক ও চলিত রীতির মিশ্রণে এক জগাখিচুড়ি ভাষায় কথা বলি আমরা এবং শিক্ষার্থীরা। যেকোনো কাজই চর্চার মাধ্যমে শেখা যায়। প্রমিত ভাষায় কথা বলা চর্চা করার অভ্যাস তৈরি করতেই বাংলা পাঠ্যবইয়ে কিছু নমুনা ভূমিকাভিনয় দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এই ভূমিকাভিনয়ের মাধ্যমে প্রমিত ভাষায় কথা বলা এবং মর্যাদা বজায় রেখে কথা বলা শিখবেন। অর্থাৎ বড়োদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় তা চর্চা করবেন। মুচির সঙ্গে, দোকানদারের সঙ্গে, আত্মীয়ের সঙ্গে, বন্ধুর সঙ্গে, মা-বাবার সঙ্গে মর্যাদা বজায় রেখে প্রমিত ভাষায় কথা বলবেন। এ ছাড়া বিভিন্ন লেখা পড়ে, বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে প্রমিত ভাষায় দক্ষতা অর্জন করবেন। ধ্বনির উচ্চারণ বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে শিখে প্রমিত ভাষায় কথা বলতেও পারবেন শিক্ষার্থীরা।
ব্যাকরণ ততোটুকুই শিখবেন যতোটুকু তার প্রয়োজন। চারিপাশের বিভিন্ন লেখা দেখে তিনি তার প্রয়োজনে এসব লেখার ব্যবহার করতে পারবেন। যেমন-ব্যানার, ফেস্টুন সাইনবোর্ড ইত্যাদি। সাহিত্য চর্চার বিষয়টি তিনি অন্যভাবে শিখবেন। এতোদিন শুধুমাত্র প্রশ্নের উত্তর লেখার জন্য সাহিত্য শিখতেন শিক্ষার্থীরা। এখন একজন শিক্ষার্থী সাহিত্য পড়ে নিজেই কবিতা, গল্প, ছড়া, প্রবন্ধ, নাটক রচনা করতে পারবেন। ভাল হলো কি মন্দ হলো সেটার বিচার পরে। আগে তিনি নিজে নিজে লিখতে শিখবেন। তারপর সঠিকভাবে সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য বুঝে লিখতে শিখবেন। অন্যের লেখা পড়ে ও মূল্যায়ন করে মতামত দিতে পারবেস। কোনো বিষয়ের বিবরণ লিখতে পারবেন। বিষয় বিশ্লেষণ করতে পারবেন এবং বিশ্লেষণমূলক লেখা লিখতে পারবেন। বিতর্ক, সমালোচনা ইত্যাদি শিখবেন। সমালোচনা মানে অন্যের নিন্দা না। কোনো একটি বিষয়ের সবল- দুর্বল দিক বিশ্লেষণ করতে পারার দক্ষতা অর্জন করবেন।
প্রশ্ন করার কৌশল শিখবেন। যেকোনো বই পড়ে তিনি বইটি পর্যালোচনা করার দক্ষতাও অর্জন করবেন। আর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে দুটো গান আছে। শিক্ষার্থীরা আনন্দের সঙ্গে গানের মূল বিষয় বুঝে বিশ্লেষণ করতে পারবেন। গানের সঙ্গে জীবনের মিল-অমিল খুঁজে বের করতে পারবেন।
বাংলা বিষয়কে নিজের মধ্যে ধারণ করার ব্যবস্থা আমাদের সময় ছিলো না। আমরা শুধু পড়তাম আর মূলভাব মুখস্থ করতাম। কখনো বিষয়বস্তু বুঝতাম আবার কখনো বুঝতাম না! পরীক্ষার জন্য রচনার কতো পয়েন্ট মুখস্থ করতে হতো! এইতো এসএসসি ২০২৪-এর বাংলা ১ম পত্র পরীক্ষায় সৃজনশীল সাতটি প্রশ্নের উত্তর লিখতে হিমশিম খাচ্ছিলেন শিক্ষার্থীরা। অনেকে লিখে শেষ করতেও পারেননি। না বুঝে কি সাহিত্য বোঝা যায়? যায় না।
নতুন শিক্ষাক্রমে বাংলা বিষয়ে শিক্ষার্থী প্রতিটি শিখন অভিজ্ঞতায় বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে দক্ষতা অর্জন করে। দলীয় কাজের মাধ্যমে তাদের মধ্যে সহযোগিতামূলক মনোভাব বৃদ্ধি পায়। দলের কাজের মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করে। ক্লাসের সবচেয়ে কম কথা বলা শিক্ষার্থীও কথা বলে এখন। শিক্ষার্থীর বিভিন্ন কাজ উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে তার কোনোকিছু সহজ ও সাবলীলভাবে উপস্থাপন করার দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
বাংলা ভাষা মুখস্থ করার বিষয় নয়। এটি চর্চার মাধ্যমে নিজের মধ্যে ধারণ করতে হয়। নতুন শিক্ষাক্রমে বাংলা বিষয়ে শিক্ষার্থী শিখন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই শিখবে এবং যোগ্যতা অর্জন করবে।
নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের পড়া শ্রেণিতেই শেষ করা হয়। তারমানে এই না যে বাসায় কোনো পড়া নেই। শ্রেণিতে যা শিখলেন সেগুলো চর্চা করবে। পরীক্ষা আর পরীক্ষার চাপে যে শিক্ষার্থী অন্য কোনো সৃজনশীল কাজ করার সময় পেতেন না আজ তাকে সেগুলো শেখার সুযোগ দিতে হবে।
লেখক: সিনিয়র শিক্ষক, গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল, ঢাকা