গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে দীর্ঘদিনের দুর্নীতি আর অপশাসনের বিরুদ্ধে যে ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান ঘটে গেলো, তা বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর ইতিহাসেই একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। দেশে দেশে ছাত্র-জনতার এই গৌরবগাঁথা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। আলোচনা হচ্ছে নতুন করে সবকিছু শুরু করার। সংস্কার করার। কারণ, এখানকার সবকিছু দীর্ঘদিনের দুঃশাসন দিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে। এই ভেঙে ফেলার হাত থেকে রেহাই পায়নি এদেশের শিক্ষাব্যবস্থাও। এখন নতুন করে সেটারও পরিবর্তন চাচ্ছেন সবাই।
বাংলাদেশে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে একটা নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। এটি ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২২’ নামেই সমধিক পরিচিত। তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে নতুন এই শিক্ষাক্রমকে জাতির সামনে পরিচিত করানো হয়েছিলো একটি মৌলিক পরিবর্তন বা যুগান্তকারী পরিবর্তন হিসেবে। কিন্তু শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাক্রমটি চালু হলে দেশের ছাত্র-শিক্ষক থেকে শুরু করে সব সচেতন মহলে ব্যাপকভাবে সমালোচনার মুখে পড়ে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো থেকে ধার করে আনা এই শিক্ষাক্রম বাংলাদেশের মতো একটা অসচ্ছল দেশে কতোটুকু বাস্তবায়নযোগ্য তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলেও অনেক প্রশ্ন ওঠে। অনেকে তখন একধাপ এগিয়ে গিয়ে দাবি করেছিলেন, যেনো অনতিবিলম্বে শিক্ষাক্রমটি বাতিল করা হয়।
এখন বাংলাদেশে ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকারের কাছে এখন তাই নতুন করে অনেকে শিক্ষাক্রমটি বাতিলের দাবি করছেন। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা এ বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে এবং কীভাবে আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়া যায় সেটা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। উপদেষ্টার এই বক্তব্য জাতির জন্য অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। কিন্তু পরে তিনি আর একটি কথা যোগ করে বলেছেন, আমরা আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাবো। কিন্তু এমনভাবে ফিরে যাবো যাতে কোনো শিক্ষার্থীর পড়ালেখায় কোনো অস্বস্তি না হয়।
এখন, এ কথায় জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, তাহলে কি নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল না হয়ে পরিমার্জিত হতে যাচ্ছে? বিষয়টি যদি তাই হয়ে থাকে তবে সেটা খুব একটা ভালো সিদ্ধান্ত হবে বলে আমি মনে করি না। কারণ, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের আগের শিক্ষাক্রম আর ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের পরের নতুন শিক্ষাক্রম এর মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। দুটো শিক্ষাক্রমের শিক্ষা তত্ত্ব, পাঠের বিষয়বস্তু, শিখন-শেখানো পদ্ধতি ও কৌশল, মূল্যায়ন প্রক্রিয়া, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের ভূমিকা, অবকাঠামোগত অবস্থা ইত্যাদিতে তেমন মিল নেই। তাইলে নতুন এই শিক্ষাক্রম চালু রেখেই কীভাবে আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়া সম্ভব? যে দুটো জিনিসের মধ্যে কোনো মিলই নেই, সেখানে তাদের মধ্যে সমন্বয় করে পাঠদান করা এবং সেখান থেকে শিখন ফল অর্জন করা কীভাবে সম্ভব? এমনটি করলে তো সেখানে পুরোপুরি জগাখিচুড়ি বেধে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। এজন্য একইসঙ্গে দুটো শিক্ষাক্রম চালু করার কোনো সুযোগ নেই। বরং নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল করার পেছনে অনেক যুক্তি আছে।
ক. নতুন শিক্ষাক্রমে লিখিত পরীক্ষা না থাকায় শিক্ষার্থীরা বাসায় বই নিয়ে বসছে না। পড়তে বললে উত্তরে তারা বলছে যে পড়ার তেমন কিছু নেই। খ. স্কুল থেকে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন রকমের দলীয় কাজ দেয়া হচ্ছে যা সমাধান করতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নানা ঝামেলা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এসব ঝামেলার মধ্যে আছে-স্কুল ছুটির পর সহপাঠীদের বাসায় গিয়ে দলীয় কাজ সমাধান করা, দলীয় কাজে অনেক সময় ব্যয় হওয়া, দলীয় কাজের উপকরণ ক্রয়ে অনেক টাকা ব্যয় হওয়া, দলীয় কাজের অজুহাত দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের অনিয়ন্ত্রিত ডিভাইস ব্যবহার করা ইত্যাদি। গ. অভিভাবকেরা নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় পরিচালিত শ্রেণি কার্যক্রম তেমন বুঝতে পারছেন না এবং এজন্য তারা তাদের শিশুদের পড়ালেখায় সাহায্য করতে পারছেন না। ঘ. নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন প্রক্রিয়া তাদের কাছে এখনো অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ মনে হচ্ছে। অভিভাবকেরা মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার বিস্তারিত জানতে শিক্ষকদের শরণাপন্ন হলে তারাও এ বিষয়ে তেমন স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না। ঙ. নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের জন্য গভীর জ্ঞান অর্জনের পথ বন্ধ করে ভাসা ভাসা জ্ঞান অর্জনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে হাতে-কলমে শেখানোর নাম করে কোমলমতি শিশুদের দিয়ে ডিম ভাজি ও আলু ভর্তা করার মতো কাজ শেখানো হচ্ছে।
এসব অভিযোগ বা প্রশ্ন কিন্তু আর ঘরের মধ্যে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙিনায় সীমাবদ্ধ নেই। এখন ‘সচেতন অভিভাবক’-এর ব্যানারে রাজপথে এসব অভিযোগ করা হচ্ছে। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ভিডিয়ো ফুটেজের কল্যাণে দেখা যাচ্ছে, অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক রাস্তায় নেমে নতুন এ শিক্ষাক্রম বাতিলের দাবিতে সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধন করছেন। তারা অবিলম্বে এ শিক্ষাক্রম বাতিলের দাবি করছেন।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক-অবকাঠামোগত বাস্তবতায় নতুন শিক্ষাক্রমের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা নিয়ে যে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে তা অযৌক্তিক নয়। অভিজ্ঞতাভিত্তিক নতুন এ শিক্ষাক্রমের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে আমার কাছে সবসময় মনে হয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত দুর্বলতা এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের পথে প্রধান অন্তরায়। বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তীব্র শিক্ষক সংকট রয়েছে, রয়েছে শ্রেণিকক্ষের অস্বাভাবিক আকারের মতো মারাত্মক সব সমস্যা। অথচ নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় একটি শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার্থীর মোট সংখ্যা কোনো ক্রমেই ৪০ এর বেশি হওয়ার কথা নয়। নতুন এ শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই এবং শিখন-শেখানো কার্যক্রমগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, একটি নির্ধারিত সময়ে একজন শিক্ষক কোনোভাবেই ৪০ জনের বেশি শিক্ষার্থীকে সুষ্ঠুভাবে নির্দেশনা প্রদান, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করতে পারবেন না।
নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই ও শিখন-শেখানোর কার্যক্রমগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, সেগুলো আগের শিক্ষাক্রমের মতো মুখস্থনির্ভর ও তাত্ত্বিক নয়, বরং এগুলো যোগ্যতাভিত্তিক ও ব্যবহারিক। এ কাজগুলো শ্রেণিকক্ষে বা শ্রেণিকক্ষের বাইরে হাতে-কলমে সম্পাদন করতে শিক্ষার্থীদের প্রচুর পরিমাণে শিক্ষা উপকরণ ও শিক্ষাসহায়ক উপকরণ ব্যবহার করতে হচ্ছে যেগুলো ব্যয়বহুল এবং বাংলাদেশের সব প্রান্তে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে সহজলভ্য নয়। গ্রামের বেশির ভাগ পরিবার অসচেতন ও অসচ্ছল হওয়ায় তারা এসব উপকরণ ক্রয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। আবার এসব উপকরণ ছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমের শিখন-শেখানো কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করাও সম্ভব হচ্ছে না। এ সমস্যা সমাধানের নিমিত্তে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উপকরণ সরবরাহের আদেশ দিলেও সব প্রতিষ্ঠানে সেটি তেমন সাড়া ফেলেনি। ব্যয়বহুল শিক্ষা উপকরণ যে এখন নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তা সচেতন অভিভাবকদের বিক্ষোভ থেকেও উচ্চারিত হচ্ছে।
নতুন শিক্ষাক্রমের দিকে দ্রুতবেগে ছুটে আসা সবচেয়ে বড় সমালোচনা হলো এর মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে। এ মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় সামষ্টিক মূল্যায়নের ওপর জোর না দিয়ে শিখনকালীন বা ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। শিখনকালীন মূল্যায়ন পদ্ধতি মুখস্থনির্ভর সামষ্টিক মূল্যায়নের চেয়ে ভালো পদ্ধতি হলেও বাংলাদেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর শিক্ষাগত মান বিবেচনায় এবং অভিভাবক, শিক্ষক, সুধীজনের মধ্যে শিক্ষা নিয়ে যথেষ্ট ভাবনার অভাবে এটি সেভাবে হালে পানি পাচ্ছে না। সেই সঙ্গে এ দেশের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিনের লিখিত পরীক্ষার চল থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। লিখিত পরীক্ষা না থাকায় অনেকের মধ্যে আবার শুদ্ধভাবে লেখার দক্ষতা গড়ে উঠছে না। অনেকে ঠিক বানানে বাক্য লেখার দক্ষতাও তৈরি করতে পারছে না। আগের ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষার সংস্কৃতি তাদের সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি এসব ভাষাগত দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করতো। যদিও অনেক আলোচনা-সমালোচনার পরে কর্তৃপক্ষ সাম্প্রতিক কিছু লিখিত মূল্যায়নের সুযোগ তৈরি করেছে, কিন্তু সেটা কোনোভাবেই পর্যাপ্ত নয়।
ইউরোপ-আমেরিকা থেকে আমদানিকৃত অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও যোগ্যতাভিত্তিক শিখন-শেখানোর এ ধারণা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জনপ্রিয় ও ফলপ্রসূ হওয়া কঠিন। এর জন্য যে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার তা আমাদের নেই। আমাদের বর্তমানে নিয়োজিত শিক্ষকমণ্ডলীও নতুন এই পদ্ধতিতে খুব একটা অভ্যস্ত নন। তাই নতুন এই শিক্ষাক্রম নিয়ে উদ্ভূত সমস্যা নিরসনে ত্বরিত ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রশাসনকে।
‘শিক্ষাক্রম’ হলো একটি আয়নাস্বরূপ যার মধ্যে একটি দেশের মানুষ তাদের ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। এজন্য একটি নিখুঁত শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নের কাজটি সে দেশের নাগরিকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি নিখুঁত আয়না যেমন একজন ব্যক্তির একটি নিখুঁত প্রতিবিম্ব তৈরি করতে পারে, ঠিক সেভাবে একটি নিখুঁত শিক্ষাক্রম অনায়াসে একটি জাতিকে তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে। এখন কথা হলো, একটি দেশের এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে যদি সবার মনে সংশয়, সন্দেহ থাকে কিংবা অস্পষ্টতা থাকে, তবে সেটি নিঃসন্দেহে পরিহারযোগ্য। এজন্য নতুন শিক্ষাক্রম সম্পূর্ণ বাতিল করে পূর্বের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়াই হবে আপাতত আমাদের জন্য সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
লেখক: সহকারী শিক্ষক, পাইকগাছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, খুলনা